Saturday, December 22, 2007

মুনিরা-১

মুনিরা


জামেদ আলী

মুকাররম ভিলার একতলা বাড়িটায় মাহতাবের জন্য যে এতটা আকর্ষন লুকিয়ে ছিল তা সে আগে কখনোই জানত না । কলেজ পড়ুয়া মাহতাব থাকত তখন এক ঘিঞ্জি এলাকায়। অলি গলি ঘুরে, নর্দমার দুর্গন্ধ থেকে রুমাল চেপে নাক বাঁচিয়ে ও এসে পৌঁছত এই খোদাদাদ খান রোডে । মুকাররম ভিলা বাঁয়ে রেখে একেবারে চলে যেত সোজা নদীর ধারে । তারপর নদী তীরে পুলিশ রেস্ট হাউসের সামনে চুপচাপ বসে বসে বিকালটা তার কেটে যেত । ফিরত সন্ধ্যের পর । কোন কোন দিন খোদাদাদ খান রোডের ওপাশে নারকেল গাছের পত্র -পংক্তির মাঝ বরাবর দেখা যেত চাঁদ । তা বড় একটা দৃষ্টি আকর্ষন করার মতন কিছু ছিল না মাহতাবের কাছে । কিন্তু একদিন সে দেখল মুকাররম ভিলার একতলা বাড়িটার ছাদে দিনের আলোতেই চাঁদ উঠেছে। সূর্যমূখীর মতন ফুটে আছে ছাদখানি আলো করে ।


কোর্ট পাড়ায় থাকার সময় একদিন মাহতাবের সাথে পরিচয় হয়ে ছিল রওশনের । ছিমছাম ছোকরা । উজ্জ্বল শ্যমলা গায়ের রঙ। পুরুষ্ট দেহের গঠন। তীক্ষ্ম নাক ও আয়ত স্বপ্নীল চোখ । প্রথম দিন যখন দেখে মাহতাব ওকে দেখে তখন ভুল করে বসেছিল । সারি সারি মেসের সিট । ওর সিটে রওশন ছিল বসে । ওকে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল মাহাতাবের মধুপুরের সেই ক্লাসফ্রেন্ড মঞ্জুর কথা । তেমনি মাথায় কোঁকড়ানো চুল । উঁচু গলা, টানটান ঋজু কাঁধ । গায়ে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবী। মনে হচ্ছিল একেবারে সেই । শুধু রওশনের হাতে ছিল বাড়তি জিনিসের মধ্যে তললা বাঁশের একখানি আড় বাঁশি ।


ওর কাছে না পৌছেই ‘‌কিরে মঞ্জুর, আরে শা’ বলেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল মাহতাব । আরে এতো মঞ্জুর নয় ! সম্পূর্ণ অপরিচিত লোক বলে মনে হচ্ছে।


লজ্জা পেয়ে মাহাতাব বলেছিল এক্সকিউস মী, ব্রাদার ! আমি আপনাকে চিনতে পারিনি । আমার এক বাল্যবন্ধু আছে। এক সাথে আমরা পড়াশুনা করছি । আপনি দেখতে তারই মতন । তাই.......

তাই হাসি মুখে রওশন বলে উঠেছিল, ভালই তো হল। আমিও আপনার বন্ধু হয়ে গেলাম ।

মাহতাব জানতে চেয়েছিল, আপনি কিসে আছেন ?

- এবার থার্ড ইয়ারে ভর্তি হয়েছি । গতবার রাজশাহী থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি । আপনি?

- আমিও তো এবার থার্ড ইয়ারে, কমার্সে । আপনি কি সায়েন্সে ?

-না আর্টসে ।

- ও তাই বুঝি হাতে আড় বাঁশি ? সিম্বল অব আটর্স ! রসিকতা করল মাহতাব ।

- তাই নাকি ?

- মাহতাব বলল, আর্ট মানে তো কলা । আর কলার সাথে শুনি বাশির ভারি সম্পর্ক। আর বাঁশি তাই আটর্স পড়ুয়fদের হাতেই ভাল মানায়।

- কলাটা পাকা কলা হলে চমৎকার হত। টপ করে মুখে পুরে দেয়া যেত । কিন্তু তাতো নয় । মনে হচ্ছে এটা কাঁচকলা । আর হাতে যে বস্তুটি দেখছেন , এটা আমার কাছে সেফ বাঁশ । বাঁশির কাজ নেয়ার সাধ্য আমার এখনও হয়নি । আমি বাজাতেই জানিনে।

- তবে এটা হাতে নিয়ে ঘুরছেন যে?

- এখানে একজনের আসার কথা আছে । এ বস্তুটি তারই প্রয়োজন । তার জন্যেই এই অপেক্ষা।

তাহলে আর একটু অপেক্ষা করুন । দেখা যাক একটু চায়ের বন্দোবস্ত করা যায় কিনা ।

রওশন বলল, চা? কিন্তু তার তো আজ সময় হবে না, ব্রাদার ! নটার আগে আমাকে গীতবিতানে পৌঁছতেই হবে । এখন তো প্রায় সাড়ে আট ।

- সেখানে কেন?

- প্রোগ্রাম আছে।

- কিসের প্রোগ্রাম?

- গানের ।

- আপনি গান জানেন ?

রওশন হাসি মুখে বলল, জানি বলার দুঃসাহস করি কেমন করে ? একটু আধটু হাউ হাউ করি মাত্র।

- ওরে বাসরে , তাহলে তো সাংঘাতিক গুণী মানুষ দেখেছি, আপনি!

তাই নাকি ? আগে আগে গুণী গুণী বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেবেন না ।

এই ঘটনার পর থেকে রওশনের সাথে মাহতাবের নিবিড় সম্পর্ক হয়ে গেল । ধীরে ধীরে ওরা আপনি থেকে তুইতে নামল । দুজেনের বাসা দুদিকে, কিন্তু ছুটির পর ওরা মানিকজোড় হয়ে যায় ।


একজন আসে রেনউইক সাহেবের কুঠির দিক থেকে । অন্য জন আসে বড়বাজার স্টেশন রোড থেকে । সিরাজুদ্দৌলা রোড ধরে এসে খোদাদাদ খান লেন হয়ে দুজনে এসে বসে পুলিশ ক্লাবের সামনের চত্বরটায়। একটা গোল মতন সিমেন্ট করা বসার জায়গা । সামনে নদী । ওপারে ঝোপঝোপ গ্রাম । সেই গ্রামের কলাবনের বাউরি বাতাস ঢেউ তোলে নদীর বুকে । ঐ নদীকে সামনে রেখে দুই বন্ধু গল্প করে সুখ দুঃখের ।


কথা ওঠে মুকাররম ভিলার । মুকাররম ভিলার আসল মালিক মৌলবি মুকাররম হোসাইন গতায়ু। তাঁর বড় ছেলে মুজাফফর হোসাইন এখন এই বাড়ীর মালিক । ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার মুজাফফর খুব ভদ্র ও শালীন । একজন ইঞ্জিনিয়ার হলে যেমনটি সাধারণত হয়, তেমন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে ওঠেননি তিনি। বাপের একতলা বাড়ী শহরের ওপারে । মাইনেও যা পান তাতে সংসারের টানা কষা নেই । আসমা বেগম, ছোট বোন, একটি ছেলে আর তাঁকে নিয়ে চারটে মাত্র প্রাণী ওদের সংসারে। খাই খাই নেই আর থাকলেও তার মুখে বল্গা লাগানোর শক্তি মরহুম আব্বাজানর কাছ থেকেই মুজাফফর অভ্যাস করে নিয়েছেন ।


একমাত্র বোন মুনীরা, ম্যাট্রিক পাশ করেছে । মুজাফফর মনে করলেন এটাই যথেষ্ট হয়েছে । দেশ কালের যা অবস্থা তাতে মুনীরাকে কলেজে পাঠানো ঠিক নয়। মরহুম আব্বাজান অবশ্যি মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন, কিন্তু শিক্ষার নামে বেলেল্লাপনা তিনি বরদাশত করতেন না । মুকাররম হোসাইন বলতেন, যে বাপ তার কন্যা সন্তান কে পদার্য় রাখতে পারেনি, সে দায়ুস। সে বাপ বেহেশতের সু-ঘ্রাণও পাবে না । বাপের আদর্শ ছিল অটল । আসমা যখন ক্লাস সেভেনে পড়তেন সেই সময় মুকাররম হোসাইন তাকে পুত্রবধু করে ঘরে এনেছিলেন। তারপর বই পুস্তক কিনে এনে নিজেই বসে গিয়েছিলেন তার শিক্ষাদীক্ষায়। আসমা বেগমের ডিগ্রী নেই । কিন্তু কোন ডিগ্রীঅলা মেয়েও জ্ঞানে গরিমায় যেন তাকে হারাতে না পারে, সেই দিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল । সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম সব বিষয়ে মুকাররম হোসাইন আসমা বেগমকে দক্ষ করে তুলেছিলেন । ডিগ্রী কি দরকার ? শিক্ষাই তো আসল জিনিস ।


মুনীরার দিকে বলতে গেলে হঠাৎ করেই চোখ পড়ে গিয়েছিল মাহতাবের । ম্যাট্রিক ফাস্ট ডিভিশানে পাশ করে পাড়াগেঁয়ে মাহতাব ভর্তি হলো কলেজে। বাপের আর্থিক সংগতি ছিল না বলে শেষ পযর্ন্ত জায়গীর থাকতে হল। কোর্ট পাড়ার একটি বাড়িতে । দোতালা বাড়ির নিচে সবটুকু জায়গায় জুড়ে কাঠের আড়ৎ। একটা বড় সড়ো জিরাফের গলার মতন করাতকল । তার অল্প একটু দুরে একটা চৌচলা টীনের ঘরে তখন মাহতাব থাকতো। শহরের লোকেরা ঢিলে- ঢালা হাই ওয়ান সার্ট ছেড়ে সাফারি স্যুট ধরেছে । মাহতাব ঢোল মার্কা হাইওয়ান সার্ট পরে যখন এলো, জায়গীর বাড়ির ছেলেমেয়েরা তা দেখে হেসেই খুন। মাহাতাবের মাথায় চট করে খেয়াল হলো এই পোশাক তাকে শীঘ্রই বদল করে ফেলতে হবে। স্টাইপেন্ডের টাকা ছিল স্যুটকেসে । কড়কড়ে নোটগুলো ভাঙ্গিয়ে মেরিন রঙের সাফারি স্যুট তৈরি করল আর বাটার দোকান থেকে উঁচু হিল কাবুলী জুতোও কিনল একজোড়া । মানুষ হয়ে উঠল সে রাতারাতি ।


সেই সাফারি স্যুট পরে খোদাদাদ খান রোড হয়ে একদিন পুলিশ ক্লাবের চত্বরে যাচ্ছিল মাহতাব । হঠাৎ একতলার রেলিং ঘেরা ছাদ থেকে একটি ফুটবল এসে থপ করে ড্রেনের কাদায় পড়ল। কাদা পানি ছিটকে মাহতাবের নতুন সাফারি স্যুট আর কাবলি জুতো একেবারে যাচ্ছে তাই হয়ে গেল । ছাদের দিকে তাকিয়ে মাহতাব দেখল একটি বছর পাঁচেকের শিশু আর একটি ফুটফুটে সুন্দরী কিশোরী দাঁড়িয়ে । ভয়ে দুজনের মুখ চুন । মাহতাব উত্তেজিত হয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু ওদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই নিবার্ক হয়ে গেল । লজ্জা শরমে মেয়েটি তখন হতবাক হয়ে গেছে।


মেয়েটি সরে যেতে পারত । গেলে কিইবা করার ছিল মাহতাবের ? কিন্তু না, মেয়েটি এই অপরাধের পর পালিয়ে যায়নি। সে যে নিজেকে দারুণ অপরাধী ভাবছে, তা তার মুখের দিকে চেয়েই মাহতাব বুঝে নিল; আর তাই ওড়নার ঘোমটায় কপাল পযর্ন্ত ঢাকা এই অনিন্দ-সুন্দর কিশোরীর প্রতি ওর সব রাগ মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে গেল। সে শুধু বলল, আমাকে একটু পানি দিতে পারেন? প্যান্টটা ধুয়ে নিতাম?


মেয়েটির যেন সম্বিৎ ফিরে এলো। পানি? তাড়াহুড়ো করে ছাদ থেকে নিচে নেমে নিজেই সে জগে করে এক জগ পানি নিয়ে ছোট ছেলেটিকে বলল, খসরু, এই পানিটুকু ওঁকে দিয়ে আয় তো। আর তোর অপরাধের জন্যে ওঁর কাছে মাফ চেয়ে নিস।


ছোট্ট ছেলেটি পানির জগটি মাহতাবের সামনে নামিয়ে লজ্জা জড়িত গলায় বলেছিল, আমাকে মাফ করেন। আমার আব্বা জানলে আমার ওপর খুব রাগ করবেন। আমি কখনো এমন কাজ করব না।

মাহতাব হেসে বলেছিল, আরে, এর জন্যে মাফ চাওয়ার কি আছে? তুমি তো আর ইচ্ছে করে করোনি।

আমার ফুফুআম্মাও মাফ চেয়েছেন। খসরু বলেছিল।

মাতাব হাসিমুখে বলেছিল, তাঁকে বো’লো তিনিও কোন অপরাধ করেন নি। মাফ চাইতে হবে না।

ঘটনাটি খুব সামান্য এবং মুহূর্তের। মুনিরার দেয়া পানিতে সাফারি স্যুট ধুয়ে সেদিন কাপড়ের দাগ অবশ্যি তুলে ফেলেছিল কিন্তু মনের কোণায় যে দাগটি লেগেছিল, সেটি দগদগে হয়েই রইল তখন থেকে।


ঘটনাটির প্রথম শ্রোতা ছিল রওশন। মনের দুর্বলতাটুকু শেষ পর্যন্ত ওকে বলেই মাহতাব মনটাকে হাল্কা করল। রওশন মন দিয়ে শুনল সবকিছু। তারপর বল্ল, তুই তো স্কলার বয়, মাহতাব! আমার মনে হচ্ছে প্রস্তাবটি ওরা আগ্রাহ্য করবে না।


মাহতাব বলে উঠল, আজকাল স্কলার বয়কে পাত্তা কে দেয় বল? এখন মানি ইজ দ্যা ম্যাটার। যার হাতে কড়ি আছে, সেই কেবল দড়ি লাগাতে পারে। আমার তো লবডঙ্কা।

রওশন ওর কথা কানে না নিয়ে বলল, তুই চুপ করে থাক। আমি ওর ভাইকে বলব। বলায় তো আর দোষ নেই। তার বোন আছে বিয়ে না দিয়ে ঘরে পুষবে নাকি? বলে দেখি। কামড়াতে তো আর পারবে না?

মেয়েটিকে দেখার পর থেকে কেমন একটা আকর্ষণ তিল তিল করে জড়িয়ে ধরছিল। চৌচালা টিনের ঘরে শুয়ে, ঝিঁ ঝিঁর ডাক শুনে, ঘরের চালে পথ-হারা এক জোনাকির আলো দেখে অথবা রাতভর বৃষ্টির ঝমঝম একটানা শব্দ শুনে ওর অনেকগুলি রাত্রি পার হয়ে গেল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অসহ্য ক্লান্তি আর ঝিমুনি তাকে জীর্ণ করে ফেলতে লাগল।
ঠিক এই রকম এক সকালে রওশন এসে কড়া নাড়ল।


- কে? মাহতাব ঘরের ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করল।

- আমি রওশন, দরজা খোল, মাহতাব ।

দরজা খুলেই রওশনের হাসি মুখ দেখে মাহতাব বলল, কিরে আজ যে খুব সকাল সকাল !

- কাজ আছে। রতনের দোকানে গরম গরম ডালপুরি ভাজছে, আন শীগগীর । আর চা । চা টা একটু দেরী করে দিতে বলিস।

- সাত সকালে এই রকম মুন্ডুপাতের হেতুটা কি জানতে পারি ?

- হেতু শুভ । মরি বাঁচি করে কাল ঐ ইঞ্জিনিয়ারের কাছে পাড়লাম কথাটা ।

আমি তো চ্যাংড়া মানুষ, ঐ মিজান মোক্তারকে বললাম, ভাই, এই উপকারটা যে করেই হোক করে দিতে হবে । মীজান মোক্তার শোনে তো খুশীতে একেবারে বাগেবাগ । বলল, আমার সাথে মুজাফফরের আলাপ আছে । আমি মাঝে মধ্যেই সেখানে যাই । লোকটা চা নাশতা না খাইয়ে ছাড়ে না । বন্ধুত্বই হয়ে গেছে । একথা তাকে বলতে আমার কোন অসুবিধা হবে না।


মাহতাব একটু ভেবে চিন্তে বলল, এবার কিন্তু ব্যাপারটা তিন কানে পৌঁছল। শালার উকিল মোক্তার আমি দু’চোখে দেখতে পারি না । ওরা পোড়াদ’র কাক ।

- মানে? পোড়াদ’র কাক মানে?

- জানিস নি? পোড়াদ’র কাকের পাল্লায় পড়িসনি কখনো? একেবারে ট্রেনের কামরায় ঢুকে ছোঁ মেরে যাত্রীদের ঠোঙা থেকে লুচি - মিষ্টি নিয়ে চম্পট!

- ও, এই কথা ? বলে রওশন হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামিয়ে বলল, না না তা হবে না । আই এম শিওর তা সে করতে পারবে না । আরে শালা আমরা স্টুডেন্ট না? এ দেশের স্টুডেন্টের কথা শুনলে যমের পিলে চমকায়। ও তো ব্যাটা মীজান মোক্তার । আমি খোজ খবর নিয়েছি । ঠিক মতই সে প্রসিড করেছে! সেদিন সুধান্যর দোকানে ওকে দুজোড়া কড়া পাকের পোড়াবাড়ি খাইয়েছি । ব্যাটা তিনটে গেলার পরই একেবারে হাল ছেড়ে দিল। কাজ ঠিক মতন না করলে ঐ চম চম আস্তই একষ্ট্রাক্ট করব না?

এবার মাহতাবের ঔৎসুক্যটা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে গেল। বলল, কী বলল সেই ইঞ্জিনিয়ার ?

- আরে যা না আগে । ডালপুরীর অর্ডারটা সেরে আয় না, ব্রাদার! দিতেও তো ব্যাটা আধ ঘন্টা কাবার করবে। আচ্ছা তুই থাম । আমিই বলে আসি। বলেই হন হন করে রওশন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর ঝড়ের মতনই ফিরে এসে চৌকির ওপর জুৎসই হয়ে বলল, লাকী চ্যাপ ইউ আর । ইঞ্জিনিয়ার তোর কথা শুনেই তোকে চিনতে পেরেছে। ওঁর বেগম সাহেবাও নাকি তোকে চেনেন। নামও জানেন । তোর গায়ে কাদা লাগিয়ে ওরা তোকে একেবারে মনের মনি - কোঠায় বসিয়ে নিয়েছে। ভাগি্স সেদিন তুই রেগে মেগে যাসনি। তোর ব্যবহারেও সন্তুষ্ট। মীজান মোক্তার বার বার ওদের বলেছে , ছেলাটা শুধু কি ভাল বলতে ভাল ? আই কমে এবার স্ট্যান্ড করেছে । শুনেই ভদ্রলোক একেবারে কাৎ। বলেছে, মোক্তার সাহেব ! বোনের বিয়ে তো দিতেই হবে । আমরা একটা ভাল ছেলের কথাই অনেক দিন ভাবছি । তবে এও ঠিক এ ছেলে যে কোন ছেলে থেকে ভাল হবে । সুযোগ পেলে হায়ার এডুকেশনও সে নিতে পারবে । মোক্তারটা বড় ত্যাঁদোড় । বলেছে কী জানিস ? বলেছে ছেলে তো হাজার হাজার পাওয়া যায়, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ! কিন্তু ঐ রকম স্ট্যান্ড করা ছেলে কয় জন পাওয়া যায়? শুনে ইঞ্জিনিয়ারও একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে । বলেছে তা ঠিক, তা ঠিক ।


- মেয়েটির নামও শুনলাম রে দোস্ত!

- কী নাম?

- মুনীরা ।

নামটা মাহতাবের কানেই যেতেই সে মনের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার উচ্চরণ করতে লাগল । সেই মুহূর্তেই মুনীরা থেকে সেই নাম ধীরে ধীরে নীরাতে রূপান্তর লাভ করল। বারবার সে তার মনের মধ্যে ঐ নামের ভ্রমর গুঞ্জন শুনতে লাগল - নীরা, নীরা, নীরা, ..........


আষাঢ়ের বারো তারিখে মাহতাবের রেজাল্ট আউট হল । কমার্সে সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে । আর সেদিন বিকেলেই মুকাররম ভিলায় ওর দাওয়াতের ও বন্দোবস্ত হয়ে গেল। সমস্ত বাহাদুরিটা মীজান মোক্তারের । না, সুধান্যর দোকানের চমচম টা বেকার যায়নি । মীজান মোক্তার করিতকর্মা মানুষ । তার প্রচেষ্টায় সেদিন সেই বষার্ন মুখর সন্ধ্যাতেই মাহতাবের সাথে মুনীরার বিয়ে হয়ে গেল।


কিন্তু ঠিক বিয়ের দিনে এ বিয়ের সবচাইতে উদ্যোগী মানুষটি রয়ে গেল বিদেশে । হঠাৎ করেই দিন কয়েক আগে রওশনকে চাকুরী নিয়ে চলে যেতে হয়েছে লিবীয়ায়।


রওশন অবশ্যি মুনীরাকে কোনদিনই দেখেনি । দেখার খুব একটা সুযোগও ছিল না । মাহতাবের ভাষায় পরিবারটি বড্ডো গোঁড়া । আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষত মানুষকে এমন গোঁড়া হতে মাহতাব কোনদিনই দেখেনি ।


মুনীরার সুন্দর মুখ আর সুগঠিত দেহ মাহতাবকে যেমন খুশি করেছিল, তেমনি অল্পদিনের ভেতরই ওর চারিত্রক দৃঢ়তা মাহতাবকে পীড়িত করে তুলল। সে এই সত্যনিষ্ঠাকে গোঁড়ামী বলে ধরে নিল ।


মাহতাব ভেবেছিল সুন্দরী স্ত্রী শুধু দেখারই সামগ্রী নয়, তা দেখানোরও সামগ্রী বটে । হাতা-কাটা শ্লিভ লেস ব্লাউজ আর ফিনফিনে শাড়ী পরিয়ে, পিঠ পেটের গুরুত্ব পূর্ণ স্থানগুলি উদোম করে ঠোঁটে মুখে রুজ লিপিস্টিক লাগিয়ে ভদ্রলোকেরা মাঝারি ধরণের বৌকেও চমৎকার প্রদর্শনীর সামগ্রী বানায় । তারপর তাকে আগে আগে নিয়ে তোয়ালের মধ্যে সদ্যজাত সন্তানটি মুড়িয়ে বাজারের অলিতে গলিতে কৃতার্থের মতন বৌয়ের পেছনে পেছনে হাঁটে । দৃশ্যটি মাহতাবের খুবই পছন্দ । মুনীরা তো সাধারন মেয়ে নয় । রুপ-যৌবন- দেহ-স্বাস্থ্যে সে অপূর্ব লাবণ্যময়ী । তাকে রাস্তায় বের করলে রাস্তার ছোকরারা চোখ ধাঁধাঁনো পতঙ্গের মতন পিল পিল করতে থাকবে । মুনীরার স্বামী হিসাবে মাহতাবের বুক খানি গর্বে ফুলে উঠবে । কিন্তু না, ওকে নিয়ে সেটি করবার জো নেই। দারুণ গোঁড়া আর ঘুরকোণা । সিনেমা থিয়েটার তো দুরের কথা, বন্ধুদের সামনেও সে যেতে নারাজ। বাইরে কোথাও যেতে হ’লে সারা শরীর মুড়িয়ে বোরকা পরবে । তার ওপর টাইট করে মুখে পেচাবে কাপড় । একেবারে যাচ্ছে তাই।


সেদিন সকাল বেলা । মুনীরা বারান্দার টবে লাগানো পাম গাছের গোড়ার আগাছাগুলি উপরে দিচ্ছিল । হঠাৎ চটি জুতার শব্দ শুনে পিছনে ফিরে দেখে মুজাফফর আসছেন। ভাইজানকে দেখেই সরতে গিয়েছিলেন মুনীরা । মুজাফফর ডাকলেন, এই মনি,দাঁড়া, শোন!

মুনীরা থামকে দাঁড়িয়ে গেল।

মুজাফফর বললেন, কিরে তোর শরীর খারাপ নাকি ? জ্বর টর হয়েছিল?

মুখখানি যে শুকনো লাগছে ? কী ব্যাপার ?

মুজাফফর হোসাইনের ঐ এক খেয়াল । বোনকে একবেলা না দেখলেই তাঁর মনে হবে হয়ত জ্বর হয়েছে, নয়ত আর কোন অসুখ বিসুখ করেছে । নইলে মুখখানি শুকনো লাগছে কেন? ভাইজানের এইসব কথা শুনে সত্যিসত্যি নিজের মুখ
দেখবার জন্যে ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নাটায় সে দাঁড়িয়েও গেছে এক একদিন। । কই না, একটুকু তো শুকনো লাগছে না।
সে আগে যেমন ছিল তেমনি তো আছে ।


লজ্জায় অধোবদন মুনীরা মৃদু হেসে বলল, না, ভাইজান, অসুখ হয়নি!

মুজাফফর আস্বস্ত হয়ে বললেন, যাক সেও ভাল! আরে, আমাদের মাহতাব কোথায় রে? ওকে দেখি না কেন? ও কি খুব ব্যস্ত থাকে? সকালে উঠে সে কোথায় গেছে?


মুনীরা লজ্জাবনত মুখে বলল, এখনো ওঠেনি, শুয়েই আছে ।

মুজাফফর অবাক হয়ে বললেন, এত বেলায় শুয়ে ? ওর আবার অসুখ বিসুখ নাকি ?

-অসুখ নয় । এমনি শুয়ে আছে ।

- মানে ? এত বেলায় এমনি ই শুয়ে আছে মানে? মুজাফফরের গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ল ।

ভাই জানের প্রশ্নের মুখে মুনীরা হতভম্ব হয়ে গেল । কোনই জবাব দিতে পারল না ।এই মুহুর্তে ভাইজান আবার কী বলবেন মুনীরা সেটাও আন্দাজ করে নিয়েছে । মুজাফফর ধীরে ধীরে একেবারে মুনীরার কাছে এগিয়ে এলেন । তার পর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, হ্যাঁরে, মাহতাব কি সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেই না?

মুনীরা মিথ্যা বলে না । বলল, না, অনেকক্ষন পর্যন্ত ঘুমিয়ে ই থাকে ।

- ফজরের নামায ?

- নামায তো পড়ে না ।

- বলিস কী ? নামাযই পড়ে না ?

- মুনীরা ভয়ে ভয়ে শুকনো মুখে বলল , জ্বি না ।

- তুই ওকে নামায পড়তে বলেছিস কখনো ?

- বললে বলে ,আমি কি পাপ করি যে নামায পড়ব ?

মুজাফফরের ভ্রুটা সহসা কুচকে গেল। কপালের ওপর সার সার কয়েকটি রেখা স্পষ্টতর হয়ে উঠল । অস্ফুট গলায় বললেন, ফেরেশতা নাকি তাহলে ? বলেই বোনের মুখের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি সোজা শোবার ঘরে ফিরে গেলেন । তার পর খাটের ওপর সটান শুয়ে পড়লেন ।


আসমা বেগম ঘরে ঢুকে স্বামীকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলেন, অসময়ে শুলে যে ! শরীর খারাপ করেছে নাকি ?

মুজাফফর মাথাটা চেপে ধরে বললেন, মাথাটা বড্ড ধরেছে ।

-একটু কড়া চা করে আনি ?

-না থাক । বার বার চা খাব না ।

- তাহলে দাও একটু টিপে দিই ।

আসমা বেগমের হাতখানি ভেজা ছিল । আচঁলে মুছে নিয়ে স্বামীর কপাল টিপতে টিপতে বললেন, তোমার তো সেই সানডে হেডেক ছিল । সেটা আবার ফিরল নাকি ?

- অনেক দিন তো হয়নি ।

- কিন্তু ফিরতে কতক্ষন ?

- তা ঠিক । বলে মুজাফফর চুপ করে গেলেন । দু’মুহুর্ত চুপ করে থাকার পর বললেন, আচছা বেগম আমাদের মাহতাবকে
সত্যি সত্যি কেমন মনে হয় তোমার ?

- কেন, ভাল । হঠাৎ একথা শুধাচ্ছ যে ?

- শুনছি ও নাকি নামাযই পড়ে না ?

- কে বলল সে কথা ?

- মনিই তো বলল ।

- মনি কি নিজের থেকে তোমাকে বলল ?

- না না, তা কেন বলবে ? মাহতাব এখন ও ঘুমিয়ে আছে দেখে আমিই মনি কে জিজ্ঞেস করলাম ।

আসমা বেগম হেসে উঠে বললেন,ও তোমার গিয়ে ছেলে মানুষ । জ্ঞান বুদ্ধি হলেই সব সেরে যাবে ?

- বলো কী বেগম? একজন গ্রাজুয়েটকে তুমি ছেলে মানুষ বল ? তা নয়, এটা বরং ওর বিদ্রোহ । আমি বুঝতে পারছি । ওর যদি এটার পরিবর্তন না হয় , নসিবে বড়ই দু:খ আছে ।

আসমা বেগম মাথা টিপতে টিপতে বললেন, দোয়া করো যেন দোষটা ওর সেরে যায় । এমনি তো মানুষ ভাল ! ভদ্র শান্ত-

-ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহশায়ি ওয়াল মুনকার - নিশ্চয় নামায মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে । ও যখন সেই নামাযই ছেড়েছে, তখন ওকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার আর কেউ রইল না বেগম ! আমার বড়ই দুংখ হয় । আমি বোধ হয় কাঁচকে হীরা মনে করেছিলাম । অল দ্যাট গ্লিটার্স ইজ নট গোল্ড।

- তুমি অযথা বেশি চিন্তিত হচ্ছ, খসরুর বাপ! ও শীগগীর ঠিক ঠাক হয়ে যাবে তুমি দেখে নিও।

মুজাফফর দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাই হলেই বাঁচি, দোয়া করি আল্লাহ যেন তাই করেন ।

আসমা বেগম মুজাফফরের কথার ভেতর বোনের জন্য সুগভীর ভালবাসা লক্ষ্য করে নীরব হয়ে রইলেন ।

মুনীরা ঘরে ঢুকে দেখল মাহতাব তখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে । দুষ্টুমী করে আঁচলের একটা সরু সুতো ছিঁড়ে নিয়ে ওর কানের মধ্যে সুড়সুড়ি দিল। সুড়সুড়ি পেয়ে ঘুমের মধ্যেই বাঁ হাত দিয়ে মাহতাব কানটা একবার চুলকিয়ে নিয়ে পাশ ফিরে শুল। একটু পরে আবার মুনীরা ওর কানের ওপর সুড়সুড়ি দিতেই সে জেগে উঠে খপ করে ওর হাতখানি চেপে ধরে বলল, ও, এই মাছির কান্ড? আমি ভাবছি বুঝি সত্যি একটা মাছি এমন করে জ্বালাচ্ছে।


মুনীরা ছটফট করতে বলল, এই, হাত, ছাড়! ওরে বপরে, এমন করে ধরলে হাতটা যে ভেঙ্গে যাবে!

- দাঁড়াও মাছিটাকে আগে জব্দ করে নিই। আমার এই সুখের ঘুমে ..

- এই, হাত ছেড়ে কথা শোন। তোমার এই সুখের ঘুম নিয়ে যা কেলেঙ্কারী হয়ে গেল, তার কি কিছু খবর রাখো, সাহেব?

- কেলেঙ্কারী!কী ব্যাপার? বলেই সহসা মুনীরার হতখানি সে ছেড়ে দিল ।

- হ্যাঁ, সাহেব, কেলেঙ্কারীই। তোমাকে চৌদ্দদিন বলি, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠো, নামায পড়ো । তা তোমার মোটেই কানে যায় না। আজ ভাইজান আমাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, সে কোথায় গেছে? বললাম, শুয়ে আছে। ভাইজান অবাক হয়ে বললেন, এখনো শুয়ে মানে? জানো গো তুমি যে নামায পড়ো না সেই কথাটা আমি ভাইজানের কাছে বলে ফেলেছি।

- বলে ফেলেছ?

- হ্যাঁ গো .. মুনীরা বোকার মতন হাসতে লাগল।

- তোমার ভাইজানটা যা কনজারভেটিভ না? এরকম ননসেস্ন পন্ডিত আর আমি কখনো দেখিনি, নীরা! একেবারে যাচ্ছে তাই । ওঁকে স্যাটিসফাই করবার জন্যে বললেই পারতে নামায- টামায পড়ে ও আবার শুয়েছে।

- মিথ্যে কথা বলবো? ভাইজানকে? বল কি গো, জিভটা আমার খসে পড়বে না?

- হ্যাঁ, তাতো পড়বেই। তোমার ভাই-বোনরা সব সত্য যুগের মানুষ যে। মিথ্যে বললে জিভ কেন মুন্ডুও তোমাদের খসে পড়তে পারে। ভাইয়েরই শুধু মান-সম্মান নিয়ে ভাবো, স্বামীর কোন মূল্য নেই তোমার কাছে। অপমান অসম্মান যা ইচ্ছে তাই তুমি আমাকে নিয়ে করতে পারো।

মুনীরা অবাক হয়ে দেখল মাহতাবকে । ওর সমস্ত মুখমন্ডলে রাগের চিহ্ন ফুটে উঠেছে। সে আহত গলায় বলে উঠল, এসব তুমি কি বলছ? আমি কি অতশত বুঝে বলেছি?

মাহতাব তেমনি ঝাঁঝের সাথেই বলল, স্বামীর মান অপমানটা বুঝতে পারবে কেন? কচিখুকি যে, ভাইয়েরটা তো পুরোপুরিই বুঝতে পারো। সে জ্ঞান তো টনটনে।

আহত মুনীরার সুন্দর মুখখানি সহসা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ওর মনে হল জীবনে এই প্রথম একটা বিষাক্ত ছুরি হৃদপিন্ডের মধ্যে ধীরে ধীরে গেঁথে যাচ্ছে। আর তারই নিদারুন জ্বালায় বুকটা ঝিমঝিম করে উঠেছে। মাহতাবকে অসম্মান করবে, তার অমর্যাদা হবে, এটা কি মুনীরা চাইতে পারে? মাহতাবকে বিয়ে করার ব্যাপারে মুনীরার নিজেরও কি আগ্রহ ছিল না ? ভাবী বিয়ে সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলে, সে তড়িঘড়ি করে প্রায় নির্লজ্জের মতই কি মত দেয়নি? হয়ত ভাবী ওর এই রকম মত দেয়াটাকেই কতটা বেহায়ার মতই মনে করেছিলেন। তবু লজ্জা শরম কাটিয়ে সে ভাবীকে হ্যাঁ সুচক জবাবই দিয়েছিল। সে তো একমাত্র এই জন্যেই যে, মুনীরার চোখের সামনে মাহতাব সে দিন অপমানিত হয়েছিল। খসরু একেবারে ছেলে মানুষ । তার অপরাধটাও মুনীরা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়ে অপরাধী সেজেছিল । অপরাধের জন্যে আসামীর মত সে মাহতাবের কাছে ক্ষামাও চেয়েছিল। এ সবই কি মাহতাবকে অপমান করার জন্যে? মুনীরার অবুঝ মন এসব কথা ভাবতে গিয়ে ছটফট করে উঠল।



মাহতাব বলে উঠল, না, এ ঘরজামাইগিরি আমার আর সইবে না। একটা বাসা দেখে আমি সেখানেই উঠে যাব।

এতদিন এখানে ঘরজামাই থাকাটা মাহতাবের অপছন্দ হয়নি। ইদানিং চাকরিতে বেশ উপরি পাওনা জুটছে। তা নিয়ে মুজাফফর হোসাইন একদিন মুনীরার ভাবীকে বলেছিলেন, মানুষের চরিত্রটাই হচ্ছে আসল জিনিস । সেটা মজবুত না হলে তার ভাঙ্গা দরজা দিয়ে ন্যায় অন্যায়ের সমস্ত আর্বজনা হু হু করে ঢুকে পড়ে । যে মানুষ আল্লাহকে ফাঁকি দিতে সাহস করে, সে অন্য কাউকে ফাঁকি দেবে তাতে আর আশ্চর্য কি? আমার কেন যেন ভয় হচ্ছে, মাহতাব আল্লার ফর্মাবদারীর ব্যাপারে উদাসীন। মুনীরার এখন মনে হচ্ছে, হ্যাঁ, ভাইজান ঠিকই অনুমান করেছিলেন। মাহতাবের কাজ কাম দেখে ধারণা করা হয়, ওর মনে আখেরাতের কোনই ভয়ভীতি নেই।


ওকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহতাব বলল কি, তুমি রাজি আছ তো ?


মুনীরা মনের আগুন ছাইচাপা দিয়ে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি যেখানে আমাকে নিতে চাও সেখানেই যেতে আমি রাজী।

মুনীরার জবাবে মাহতাবের অন্তরের আগুনে যেন একটু পানির ছিটা লাগল। খুশী হয়ে বলল, সেই ভাল। এখানে এই শত সহস্র বিধি নিষেধের বেড়া জালে আমার দমটা যেন আটকে আসছে । অবাক লাগে যখন আমি শুনি, ভাবীর সাথে আলাপ করা যাবেনা, কথা বলা যাবে না। একেবারে আবসার্ড মধ্যযুগীয় কারবার । ঐ লোকটা যুগের হাওয়ার উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করেছে । লেখাপড়া জানা মানুষ এমন একটা অচল মাল হয়ে উঠবে ভাবাই মুশকিল।


ভাইজানকে ‘ঐ লোকটা’ বলতে শুনে মুনীরার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। মুনীরা সাধারনত বেশী কথা কাটাকাটি পছন্দ করে না। একথাটা নিয়ে ও তাই সে আর উচ্চ বাচ্য না করে চুপ করেই রইল ।

মাহতাব বলল, তাহলে কথা এই হল, আমরা খুব শীগগীর এখান থেকে শিফট করছি, কী বল ?

মুনীরা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলল, ঠিক আছে, তুমি বাসা ঠিক কর। আমার কোন আপত্তি নেই ।

বাসা ঠিক করে স্হানান্তরিত হবার আগেই ভাগ্য ক্রমে মাহতাব বদলী হয়ে গেল ঢাকায় তাই ওদের বাসা ছেড়ে যাওয়ার কারনে ভাই এর বাসায় বড় একটা ঝামেলাও হল না । খুশী মনেই মুজাফফর হোসাইন ওদের বিদায় দিলেন ।
যাওয়ার সময় উপদেশ দিয়ে বললেন, সৎ জীবন যাপনের সাধনা করবে, আল্লাহ প্রকৃত বান্দা হয়ে বাঁচা মরার মধ্যেই সার্থকতা এই কথাটি মনে রাখবে ।


মুনীরা, যত মনোযোগ দিয়ে শুনুক, নতুন বাসায় এসে পা দিতে না দিতেই মাহতাব ঐ উপদেশের সবটুকুই বেমালুম ভুলে গেল। ঢাকার একটা অভিজাত এলাকায় তিন তলা বাড়ির ফাস্ট ফ্লোর ওদের বাসা । বাড়িটা নতুন । একটু বাগান ও আছে সামনে, রেলিঙ ঘেরা । ভেতরটা ডিসটেস্পার করা বড় সড়ো গোটা তিনেক কামরা । লাগোয়া বাথ, কিচেন । সমস্ত মেঝে পরিপাটি করে মোজাইক করা । বাইরে রেলিঙ ঘেরা ব্যালকনী । বাসা হিসাবে মুনীরার বেশ পছন্দ হল ।


ভোর বেলা যখন ওরা এ বাসায় এসে পৌছল, তখন ঘরগুলি শূন্য খাঁ খাঁ করছিল। কিন্তু দুপুর নাগাদ খাট, জাজিম, তোষক, সোফা সেট, ড্রেসিং টেবিল প্রভৃতি যাবতীয় সরঞ্জামে শূন্য জায়গাগুলি ঝকেঝকে হয়ে উঠল।


ভাবি, ভাই আর খসরুর জন্যে একটু আধটু মন খারাপ করা ছাড়া মোটামুটি আনন্দই পেল মুনীরা ।

পরদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মাহতাব মুনীরা কে বলল, আজ এক নতুন জগতে তোমাকে নিয়ে যাব।

মুনীরা হেসে বলল, নতুন জগত? সে আবার কোথায় ? আমার কাছে এই শহরটাই তো নতুন জগত!

- এই জগতের ভেতরও আরেকটা জগত আছে। যখন দেখবে তখনই সেটা বুঝতে পারবে । তোমার ঐ কাঠমোল্লা ভাই-এর বাড়িতে সে জগতের কোনদিন তুমি সন্ধানই পাওনি, নীরা!

- বলই না সেটা কোথায়?

-- মাহতাব পকেট থেকে দু খানি গোলাপী রঙের টিকিট বের করে বলল, এই যে আগাম টিকিট কিনে এনেছি । আজকের নাইট শো’তে যাব।

-- মানে?

-- মানে সিনেমায় গো, সিনেমায়। তুমিও তো সেই রকম কিনা। ঐ সুন্দর চেহারাটা না থাকলে কী যে হত । হয়ত বাজারে বিকোতেই পারতে না।

মুনীরা হেসে বলল, কিন্তু তাও তো প্রথম খদ্দেরই একেবারে মজনু হয়ে উঠেছিল।

- বললাম তো, সে কেবল ঐ সুন্দর মুখখানির জন্যে । তা ছাড়া আর যা কিছু তোমার সবই একেবারে পুরোনো সেকেলে বস্তাপচা এবং বাজে । ঐ বাড়ির গোঁড়ামীটা তুমি ঝেড়ে ফেল, বুঝলে? একটু যদি মর্ডান হতে পার তাহলেই তুমি ইউনিক হয়ে উঠবে । আমি যে শুধু ঐটুকুই চাই । তোমাকে সিনেমায় নিয়ে যেতে চাই, এ জন্যে যে, মেয়েরা কি করে সব দিক থেকে সুন্দর হয়ে উঠতে পারে তার নমুনা তুমি সেখানেই পাবে । আর তাই দেখে আধুনিকতাটা ভাল ভাবেই রপ্ত করতে পারবে ।

- আজ থাক না গো। কাল রাস্তায় বড্ডো ধকল গেছে। এমনি ঐসব দেখার অভ্যাস আমার নেই । ক্লান্তিতে হয়ত হাঁপিয়েই উঠব।

- বলছ কী তুমি? সিনেমায় যাওয়ার কথা শুনলে মেয়েদের হৃদয় আনন্দে মেতে ওঠে। আর তুমি বলছ থাক? তুমি কী যে আউটডেটেড মেয়ে মানুষ ! আমি অবাক হয়ে যাই তোমার কথা শুনে ।

মুনীরা শুকনো হাসি হেসে বলল, এখন আর তো আমি আউটডেটেড থাকছি না। একটু রয়ে সয়ে মর্ডান হতে হবে তো, নইলে অনভ্যাসের ফোঁটায় কপাল চড়চড় করবে যে ।

- কিন্তু তাই বলে তুমি সিনেমায় যাওয়ার ব্যাপারে পাশ কাটাতে পারবে না, বলে দিলাম । আজকে বইটার লাস্টডেট । বাংলাদেশে এমন সুপার হিপ বই তৈরী হয় তা না দেখলে একেবারে বিশ্বাসই হয় না। নাচ গান ফাইটিং-এ একেবারে ঠাসা । ফুল অব থ্রিলিং । নায়িকার একসেলেন্ট একখান নাচ আছে । দেখে সারা শহরের মানুষ হল-এ ভেঙে পড়ে । সব সময় হাউস ফুল । যা এক খানা বই বানিয়েছে না?

- তুমি আগেও দেখেছ নাকি সে বই?

- দেখিনি মানে? ফোর টাইমস। নায়িকার ডান্সটা যা না ইশ! বার বার ইচ্ছে করে দেখতে । তুমি যদি ঐরকম একটা ডান্স শিখতে পারতে নীরা! তাহলে আমার জীবন সার্থক হয়ে যেত ।

- ছিঃ! ভাল মেয়েরা কখনও ডান্স শেখে?

তা শিখবে কেন? ভাল মেয়েরা শুধু হলুদ বাটতে শেখে। যত্তো সব ইয়ে। তোমার ঐরূপ যৌবন নিয়ে তুমি শুধু হলুদই বাটো, বুঝলে? তুমি যে একেবারেই মাকাল ফল তা কি আগে জানতাম?

মুনীরা হেসে উঠে বলল, মাকাল ফল দেখতে ভাল, ওপরে লাল ভেতরে কাল। জানলে কি করতে গো?

- হাসির কথা নয়, নীরা! তোমার গলার আওয়াজ সুন্দর, শরীরের গঠনও চমৎকার । তুমি গান শিখতেও পারবে ,ডান্স শিখতেও পারবে । মুনীরা বলল, মুসলমান মেয়েরা নাচ-গান শিখবে কি গো?

- ওরে আমার মুমিন মুসলমান রে! তোমার ভাই আর তুমিই শুধু মাত্র জগতে মুসলমান আছ, তাই না? বলেই সে অবলীলায় এক ডজন চিত্র তারকা এবং গায়িকার নাম কয়ে গেল গড় গড় করে। তারপর বলল, এরা মুসলমান না? এরা সব দোজখে যাবে, আর তোমার ভাই বোনেরাই ক’জন বেহেশতে যাবে?

মুনীরা তেমনি হাসি মুখে বলল, দোজখে যাবে কি বেহেশতে যাবে তা কি আর আমি জানি ? যিনি বেহেশত দোজখের মালিক তিনিই সব ভাল জানেন। ওটা আমাকে জিজ্ঞেস করে কি লাভ?

--- জিজ্ঞেস করব না? তোমরা দোজখ বেহেশতের সোল এজেন্সি নিয়েছ যে।

মুনীরা এবার খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, মিথ্যে কথাটাও এমন সুন্দর করে বলতে পারো যে, শুনে একেবারে
সত্যি মনে হয়। আমি কোন কিছুরই এজেন্সী নিইনি।

মুনীরা সুন্দর হাসে । সরু এবং পরিপাটি দাঁতগুলি ওর হাসির সময় মুক্তোর মতন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মাহতাবের জিদ চাপে এমন সুন্দরী নারীকে সে ঐ রকম মাকল ফল হয়ে থাকতে দেবে না কিছুতেই । নাচ গান শিখিয়ে তাকে সে অপসরা করে তুলবে । মাহতাবের এখন অতীতের সেই দুর্দিন নেই । টাকা পয়সার অভাব নেই । আজকাল হাজার হাজার টাকায় দুহাত ভরে যায়। টাকা যত লাগে পরোয়া নেই ।


মাহতাব বলল, তা’হলে যাচ্ছ তো সিনেমায়?

মুনীরার চোখের ওপর ভাইজানের দু’টি চোখ হঠাৎ ভেসে উঠল। বড় সুন্দর বড় দরদী সেই দু’টি চোখ। মুনীরার জন্যে দরদ যেন উপচে পড়ছে সেখান থেকে।


মুনীরা বলল, সত্যি শরীরটা আজ ভাল নেই, অন্য একদিন নিয়ে যেও।

অন্যদিন তো এই বইটা থাকবে না। আজকেই শেষ দিন। কাল আসছে শরৎ চাটুজ্জের কী একটা বই। শালা সারাটাক্ষন মেয়েরা বসেবসে ফিচ ফিচ করে আর চোখ মোছে। যত্তো সব ন্যাকামী আর প্যান-প্যানানি। আজকের ছবিটায় তোমার অনেক কিছু শেখার আছে। আমি চাই ঐ নায়িকার মতন ঠিকঠাক তুমি একজন মডার্ণ গার্ল হয়ে ওঠো।


- না হলে আমাকে তোমার ভাল লাগছে না তাই না?

- ভাল না লাগলে কি মজনু হয়ে বিয়ে করতাম ? তা নয়। আমি চাই যে তুমি টপ ক্লাস হয়ে ওঠো। একেবারে অলরাউন্ডার । মডার্ণ সোসাইটিতে বন্ধুবান্ধবের কাছে যেন খাটো হতে না হয়।

মুনীরা বলল, ঠিক আছে, তুমি রেডি হয়ে নাও, আমিও কাপড় পড়ে নিচ্ছি। চল তোমার সিনেমাই দেখে আসি আগে ।< br/>
- রাগ করলে?

- মুনীরা বলল, ওটার বেশী অভ্যাস আমার নেই, তাতো তুমি জানোই।

--ভেরি গুড। বলেই মাহতাব বাম হাতের তালুর ওপর ডান হাতের তালু দিয়ে আঘাত করে বলল, এইতো চাই ডালিং ! কাপড় চোপড় পড়ে মুনীরা যখন সামনে এসে দাঁড়াল, তখন ওকে দেখে মাহতাব একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। অবাক গলায় বলল, আরে আরে, এটা কি হল?

-মুনীরা চমকে উঠে বলল, কী হল? কিছু হয়নি তো

- কিছুই হয়নি?

- আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। কী হল বলবে তো?

- তুমি বোরকা পড়ে কোথায় যাচ্ছো? সিনেমায়? আরে ছিঃছিঃ

মুনীরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি বোরকা ছেড়ে বাইরে যেতে বলছ আমাকে?

- না, না, তা যাবে কেন? বোরকায় ঢুকে ডুলিবৌ হয়ে সিনেমায় যাবে । কিন্তু ভাবছি কার সাথে তুমি যাবে ।

- কেন? তোমার সাথে? কার সাথে মানে?

- উঁহু ঐ বোরকা সুন্দরীর পার্শ্বচর হওয়া আমার পোষাবে না।

মুনীরা স্তব্দ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল! মনে হচ্ছে ওর চোখের সামনে ভাইজানের দুটি চোখ কেমন আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে । এক ঝলক আগুন যেন ঠিকরে পড়ছে তার চোখ থেকে । মুনীরা কাঁপতে কাঁপতে বলল ,বোরকা ছেড়ে গেলে আমি যে হাঁটতে পারব না । হাত পা কেঁপে হয়ত পড়েই যাব মানুষের মধ্যে ।


- হাজার হাজার মেয়ে মানুষ রাস্তার দিন রাত পড়েই যে যাচ্ছে! যত্তোসব ইয়ে..

- তাদের কথা আলাদা । আমার যে ছোট বেলা থেকেই অভ্যেস নেই !

-অভ্যেস হয়ে যাবে । শরীরের নাম মহাশয় , যা সহাও তাইই সয় । বোরকা রেখে দাও ।

কিন্তু তবু মুনীরা বিমূঢ়ের মতন দাড়িয়ে রইল । ওর পা দুটি যেন কিছুতেই নড়তে চাইছে না । মাহতাব নিজেই উঠে গিয়ে বলল , দাড়াও আমিই খুলে দিচ্ছি। এই প্রগতির অনাবিল আলোতে তোমাকে উদ্ভাসিত করা তো আমারই দায়িত্ব । আমি যে তোমার স্বামী --

মুনীরা পাথরের মতন দাড়িয়ে রইল । মাহতাব নিজ হাতে ওর বোরকা খুলে দিয়ে বলল , বাব্বা , আবার লম্বা হাতা ব্লাউজও পরেছ? তোমার সেই শ্লিভ লেস ব্লাউজ কই ?

-সেতো কেবল তোমার সামনে পরব বলেই রেখেছি । বাইরে নয় ।

-শুধু আমার সামনে নয় । বাইরেও পরবে । যাও পরে এসো । শীগগীর যাও ....

মুনীরা এবার হাত জোড় করে দাড়াল । এই ভাবে দাড়ালে আর যাই হোক ওর মুখখানি ভারি পবিত্র মনে হয় । ঢল ঢল মুখ । বোকা বোকা এবং স্নিগ্ধ ।

মাহতাব নরম হয়ে বলল, আহারে, জোড় হাত কেন ? যাও যাও তাড়াতাড়ি করো বলছি ...

মুনীরা মিনতি করে বলল, আমাকে মাফ কর । এই জিনিস টা আজ আমি কিছুতেই পারব না । আজকের মত আমি তোমার কাছে মাফ চাই ।

-আচ্ছা ঠিক আছে । আজকের মতন মাফ করলাম । চলো ।

ওদের নিয়ে স্কুটারটা সিনেমা হলের সামনে পৌছে গেলে ওরা বুঝতে পারল ছবি শুরু হওয়ার বেশ খানিক দেরি আছে । সিনেমা হল-এর সামনে ঢাউস একটা ছবি টাঙানো । একজন পেট উদোম মেয়ে ঊর্ধে হাত তুলে নৃত্যের মুদ্রা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে । ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই মুনীরার সারা শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল ।মেয়ে মানুষকে অমন বেহায়ার মতন প্রদর্শনীর পোষ্টারে দেখে মুনীরার দারুন ঘেন্না লাগল । অথচ ঐ ছবিটাই মাহতাব অনেকক্ষেন ধরে হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । কয়েকজন উঠতি বয়সের ছোকরা একটা পান বিড়ির দোকানে এতক্ষন জটলা করে দাড়িয়ে ছিল । হঠাৎ মুনীরার দিকে নজর পড়তেই জটলা ভেঙে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মুনীরার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগল। ওদের দেখে মুনীরার বুকটা ভয়ে কেমন যেন তির তির করছে । এত মানুষজনের ভীড়ে মাহতাবের হাত ধরতে ওর ভীষন লজ্জা করছে । কিন্তু ভয়ে ভয়ে শেষ পর্যন্ত সে ওর একখানি হাত টেনে ধরল । এই অভাবনীয় ব্যবহারে মাহতাব হঠাৎ মনে মনে খুশী হয়ে উঠেছে ।


মাহতাব মুনীরাকে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে ?

-ভাল । সংক্ষিপ্ত জবাব দিল মুনীরা। ভাল লাগছে না বললে ও হয়ত বার বার তার কারন জিজ্ঞেস করে ওকে খুব ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে । ভয়েই জবাবটি সে সংক্ষিপ্ত করে ফেলল ।

মাহতাব খুশী হয়ে বলল, বলেছিলাম না যে ভাল তোমার লাগবেই ? শুধু ঘর কুনো হয়ে থাকলে কি মেয়েদের চলে ?
খোলামেলা চলাফেরা করলে মেয়েদের স্মার্টনেস বাড়ে । মনটাও উদার হয় । তোমার ভাই তোমাকে একেবারে কুয়োর ব্যাঙ করে রেখেছে ।


ভাইজানের প্রসঙ্গটা উঠতেই মুনীরার মনের ভেতর দারুন বেদনা জাগে । ছোটবেলা থেকেই মুজাফফর হোসাইনকে সে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এসেছে । ওর জন্যে ভাইজানের মনে কী অপরীসীম স্নেহ । ছোট বোন নয়, বরং আপন মেয়ের মতন করেই স্নেহ - যত্নে ভাইজান ওকে মানুয় করেছেন । খেতে বসে প্রতিদিন ভাবীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, মনি কই, ওর খাওয়া হয়েছে ?
ভাবী হয়ত রসিকতা করে বলেছেন, মনি কি পুরুষ মানুষ যে সবার আগে খাবে?


ভাইজানের মুখখানি ভার হয়ে উঠেছে। একটু বিরক্তির সুরে ভাবিকে বলেছেন, মেয়ে হওয়াটাই যত অপরাধ, তাই না? ও যদি আগে খেয়ে নেয় তবে কি কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে?

হাসিমুখে ভাবি বলছেন, মেয়ে মানুষ কার ঘরে যাবে তার ঠিক নেই, এত আদর করতে নেই ।

আড়াল থেকে মুনীরা দেখেছে ভাবীর কথা শুনে ভাই জানের মুখ-খানি ব্যথাতুর হয়ে উঠেছে ।