Tuesday, May 20, 2008

প্রসঙ্গঃ নারী, এবং আমরা

-মঞ্জীরে এলাহী

আমার জন্ম গ্রামে। খুব কাছ থেকেই আমি দেখেছি গ্রামের মানুষের জীবনাচরণ। সেই জীবন পদ্ধতিকে আমি প্রায়ই চিন-া করতাম এবং এখনও করি। কত যে প্রশ্ন মাথার ভেতরে জমাট বাধত! কতক জবাব পেতাম, কতক পেতাম না। আসলে মানুষের শৈশব যে তাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা কেউই কাউকে বোঝাতে পারে না। সবাই ই তার নিজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে। আমি সে সময়ের মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে বেশ চিন-া করেছি। বেশ ভালভাবেই বুঝলাম সেখানকার সবচেয়ে মানুষিকভাবে পরাধীন থাকে নারীরা।
আমার মনে হয়েছে খুব কম সময়েই মৌলিক মানবিক দিকে তাদের সুখ দুঃখকে নূন্যতম মূল্য দেয়া হয়। পড়াশুনা, সামাজিক কাজকর্ম, পারিবারিক কাজ, বিয়ে, এসব ক্ষেত্রে মতামত দেয়া বা নিজেদের এসবে সিদ্ধান- নেয়ার ক্ষেত্রে তারা খুব কমই স্বাধীনতা ভোগ করে। এ সবের মত প্রতিটা ক্ষেত্রেই তারা পুরুষদের, বিশেষকরে তাদের কর্তা পুরুষদের মুখাপেক্ষী থাকতে বাধ্য হয়। কারণ নিশ্চয়ই আছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল তারা প্রায় সবাই ই বুঝতে পারে না যে তারা তাদের কর্তাব্যাক্তিদের মুখাপেক্ষী। আবার কেউবা বুঝলেও তা মেনে নেয়। কারণ তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আমি বলব না যে এটা এই জন্যই যে কোন বিশেষ পুরুষ বা কোন পুরুষ গোষ্ঠী তাদেরকে এই একচ্ছত্র আধিপাত্যের অধীন থাকতে বাধ্য করে। বরং এটা বলব যে গ্রমের সবাই (বিশেষ করে নারীরা) এমন একটা পরিবেশের মধ্যে আছে , এমন একটা প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে আছে, এমন একটা মানুষিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আছে যে তারা এই অধীনতার মধ্যে থাকছে। আর আমার কাছে মনে হয়েছে যে নারীরা বেশ স্বাভাবিকভাবেই এই জীবনে অভ্যস- হয় খুব ছোটবেলা থেকেই।
আবার আপনি যদি গ্রামের কোন মহিলাকে এ ব্যাপরে জিগ্যেস করেন, দেখবেন বেশিরভাগ নারীই এই অধীনতার ব্যাপারে ক্ষোভ দেখাবে। তারা পুরোটা দোষ দিবে হয় পুরুষদের উপর নাহয় নিজেদের কপালের উপর। তাদের কেউ একবারও ভেবে দেখবে না যে এ ব্যাপারে তারা নারীরা কতটুক দায়ী। এধরণের উদহরণ অহরহ আমাদের সামনে চাক্ষুষ। ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি। ধরুন কোন গৃহসে-র মেয়ের সাথে তার শাশুড়ী ঝগড়া বাধায়। তাকে মারধর পর্যন- করে। প্রায়ই মেয়েটা বাপের বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে। এই গৃহসে-র কর্তী তার বেয়াইনকেই এক্ষেত্রে সব অপরাধের মালিক করবে। খূব কম ক্ষেত্রেই সে তার মেয়েকে দোষারোপ করবে। সে তার বেয়াইনকেই ‘খবিশ’ বলবে। কিন' দেখা যায় যে ঐ গৃহস-কর্তীই তার পুত্রবধুর সাথে নিয়মিত ঝগড়া করে। নির্যাতন করে। সে কিন' একবারও ভেবে দেখে না যে যার সাথে সে ঝগড়া করছে বা যাকে সে নির্যাতন করছে সেও তার মেয়ের মত কারো মেয়ে। এক্ষেত্রে সেও কিন' তার বেয়াইন থেকে কম যান না। হা! হা! ব্যাপারটা এরকম, “তোমার বিচার আমি মানছি ঠিকই, তবে তালগাছটা কিন' আমার!”
হয়ত অনেকে বলবেন এটাতো গ্রামের কথা। শহর এখন অনেক আধুনিক। সেখানে দিন বদলে গেছে। আগের মত নেই আর। শহরের সাথে সাথে এখানকার মেয়েরাও বেশ আধুনিক হয়ে গেছে আজকাল। হয়ত কথাটা ঠিক। তবে এখানে দেখেছি মিশ্র মানুসিকতা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি। আমার সাথের বেশির ভাগ মেয়েকেই দেখতাম যেন কোন রকমে অনার্সটা পাশ দিতে পারলেই হল। ব্যাস এসে গেল তাদের বিয়ে। আর মাস্টার্স পাশ পর্যন- বিয়েটা খুব কম জনেরই আটকায়। বন্ধুদের বেশিরভাগেরই মাস্টার্সএর আগেই বিয়ে হয়ে যায়।
হা! হা! বিয়ে হয়ে যায়। একবারও হয়ত ওদের মনে এই প্রশ্নটা জাগে না যে কেন ওদের বিয়ে হয়, আর ছেলেরা বিয়ে করে। এখানে কি একটা অধিপতিশীল ধারণা গোপনে হলেও খুব শক্তিশালীভাবে কাজ করছে না? হয়ত মেয়েরা এটা বুঝতেই পারছে না। আর পুরুষেরাও হয়ত বুঝতে পারছে না। আর সত্যি বলতে কি পুরুষদের এই ব্যাপারটা বোঝার দরকারও পড়ে না। কারণ আমাদের এই তথাকথিত প্রগতির নামে চরম গোড়া ও একপেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের কেবল এই মজাদার আধিপাত্যটাই পেলে হল। এর বাইরে, এটা বৈধ না অবৈধ, তাদের জন্যএটা মঙ্গলময় না অমঙ্গল, এটা কোন ধরণের প্রগতি বা এই শ্রেনীবিভক্ত সমাজের জন্য কোন কারণটই বা দায়ী তা তাদের জানার কোন দরকার নেই।
সে যাইহোক। আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতাম যে মেয়েদের মানুসিকতাটা এরকম যে কোনরকমে তাদের বিয়েটা ঘটে গেলেই হল। তারপর “ছেলেদের ঘাড়ের উপর বসে জীবনটা নিশ্চিনে- পার করে দাও”। বেশ অনেকবারই আমি আমার মেয়ে সহপাঠিদের মুখে শুনেছি এ ধরণের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মেয়েদের মুখে এ ধরণের কথা শুনে বা তাদের মনে এ ধরণের মানুসিকতা দেখে আমি আসলেই বেশ অবাক হয়েছি। ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এর আসল কারণটা কি। হয়ত এটা ওদের একটা খেয়াল। হয়ত এই ব্যাপারটা ওরা বেশ ‘এনজয়’ করছে। হয়ত আমি যা ভাবছি এসবের কিছুই না। কিন' এটাওতো ঠিক যে এ পর্যায়ের মেয়েদের মধ্যে এ ধরণের ভাবনা থাকাটা মেয়েদের কতখানি সীমাবদ্ধ অবস'ার কথা জানিয়ে দেয়!
অনেকে বলেন নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে এ ধরণের ভয়াবহ অবস'া থেকে নারী’রা মুক্তি পাবে। বেশ ভাল কথা। শুনে ভাল লাগে। নারী বন্দি বা এ ধরণের ভয়াবহ অবস'াটা কারও কাম্য নয়। নারী মুক্তি বা এ ধরণের ভয়াবহ অবস'ার আশু সমাধান আমিও প্রচন্ড ভাবে কামনা করি। কিন-ু কিছুতেই আমার বুঝে আসে না যে অনেকের দেয়া এই অর্থনৈতিক ফর্মূলা বা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার তত্ত্ব এই ভয়াবহ অবস'ার কি রকম অবসান করবে। এখনতো পৃথিবীর নারীদের মধ্যে আমেরিকা, য়্যূরোপের নারীরাই সবচেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে। তো কে বুক উচিয়ে বলতে পারবে যে সেখানকার নারীরা বেশ নিরাপদেই আছে? রাত বারটার সময়েও কোন নারী নির্ভয়ে মাথা উচিয়ে সদর রাস-া দিয়ে হন হন করে হেটে যেতে পারে? অথচ পুরুষরাতো ঠিকই পারে। সত্যি বলতে কি আমাদের নারীরা যেরকম সামাজিক অনিরাপত্তার মধ্যে জীবন পার করে দিচ্ছে তেমনি পৃথিবীর সব নারীরাই একই সামাজিক অনিরাপত্তার মধ্যে জীবন পার করছে। একটুও ব্যতিক্রম আর পৃথিবীর কোথাও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ক্লাস নিচ্ছিলেন আমাদের নৃবিজ্ঞান কোর্সের স্যার(নাসি-ক)। বিভিন্ন আলোচনা করতে করতে সে হঠাৎ যে প্রশ্নটা করলেন তাতে আমরা চমকে উঠলাম। সে আমাদের বলল “আচ্ছা ধরে নাও গভীর রাত। নির্জন রাস-ায় একজন স্বাস'্যবতী সুন্দরী মেয়ে হেটে যাচ্ছে। হঠাৎ সে দুজন জোয়ান লোকের সামনে পড়ে গেল। তো, কি করে ঐ সুন্দরী তার লাঞ্চনাকে ঠেকাবে, হ্যা ?” আমরাতো থমথমে। হতবাক হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি ঘেমে গেলাম। এই যখন অবস'া স্যারই তখন বললেন “পারলে না! এটাতো খুব সহজ। লোকদুটো সংযমী হলেইতো হয়ে গেল।” স্যার উত্তরটা বলার সাথে সাথেই আমরা ধপাস করে ঠিক বোকা বনে গেলাম। এত সহজ উত্তর! আসলেই কত সহজ উত্তর! আর আমাদের মথায়ই আসল না ব্যাপারটা!
ঠিক এরকমই হয় আমাদের। খুব সহজ ব্যাপারটা আমাদের মাথাতেই আসে না। আমরা সবসময়েই যাই যত সব জটিল জটিল ফর্মূলায়। আমরা যখন এই প্রসঙ্গে আসি অর্থাৎ নারী প্রসঙ্গে আসি তখন প্রথমেই মনের ভেতরে ঠিক অবচেতনেই কাজ করে যে ‘নারীরা অসহায়! তাদের এইরকম ঘৃণ্য অসহায়ত্বকে সরানোর জন্য একটা ফর্মূলা বের করতেই হবে।’ মানেটা কি দাড়াল! ঠিক শুরুতেই মহা ভুল দিয়েই যাত্রা করলাম। এটাকি সত্য নয় যে আমরা নিজেদের ‘মানুষ’ হিসেবে না দেখে যদি ‘নারী’ আর ‘পুরুষ’ হিসেবে দেখতে থাকি তাহলে কখনই এই শ্রেনী বিভক্তির অবসান হবে না। হওয়ার তো কোন কারণও থাকতে পারে না। কারণ সমাজ যদি মানুষ দিয়ে না হয়ে নারী আর পুরুষ দিয়ে হয় তাহলে আবশ্যিকভাবেই সমাজ বর্তমানের মত গোড়া পুরুষতান্ত্রিক হবে অথবা মর্গানের তত্ত্ব দেয়া আদিমকালের চধষধবড়ষরঃযরপ সংস্কৃতির মত গোড়া মাতৃতান্ত্রিক হবে, যেখানে সন-ান আর পুরুষেরা নারীদের পরিচয়ে পরিচিত হবেন। সম্পত্তি মালিক আর বণ্টনকারী ছিলেন নারীরা।
অনেকে হয়ত বলতে পারেন যে সেই অবস'াতেই যাওয়া হল নারীস্বাধীনতার বা এই ভয়াবহ অবস'ার অবসানের মোক্ষম পথ। কিন-ু তাদের বেশ হতাশ করেই বলতে হচ্ছে যে চাইলেই কেউ সেই অবস'ায় হুটকরে যেতে পারবেন না বা কোন বিশাল বিপ্লবের মাধ্যমেও সেই অবস'ায় যাওয়া সম্ভব নয়। খোদ মর্গানই বলেছেন যে মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হয়েছে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায়, নানা প্রেক্ষাপটগত ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণে।
সে যাই হোক। আমি সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার ধারণা সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হোক বা পিতৃতান্ত্রিক হোক কোনটাতেই সমস্যা নেই যদিবা সেখানে নারী পুরুষের পরিচয় প্রাধান্য না পেয়ে বরং ‘মানুষ’ পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে। সমাজ যদি কেবল মাতৃতান্ত্রিক হয় বা পিতৃতান্ত্রিক হয় তাহলে কখনই এই সামাজিক শ্রেনীকরণের অবসান হবে না। সেখানে হয় নারী অধিপতিশীল হবে নাহয় পুরুষ অধিপতিশীল হবে। সেখানে হয় পুরুষ কতৃক নারী লাঞ্চিত হবে নাহয় নারী কতৃক পুরুষ লাঞ্চিত হবে। এটা কখনও কোন সমাধানের ব্যাপার হতে পারে না। আসলে সমাজটা এমন হলেই কেবল সবারশানি- আসতে পারে যে সেখানে কেউ কারও উপর অধিপতিশীল হতে চাইবে না। সমাজের ভিত্তিটাই হবে সহানুভূতির উপর। যে সমাজে কোন আইন করে নারী নির্যাতন বন্ধ করা দরকার হবে না। সামাজিক শিক্ষার সামগ্রিক ভিত্তিটাই হবে সব রকম নির্যাতনের বিরুদ্ধে। যেখানে মানুষ ‘মানুষ’ই থাকবে। অমানুষ হয়ে যাবে না।
সেই সমাজটাতে থাকা চাই নৈতিকতার সুষম শিক্ষা যার মাধ্যমে রাতের নির্জনে স্বাস'বতী সুন্দরী নারীই কেবল নিরাপত্তা পাবে না বরং একান- নিরালায় মানুষ তার নিজ মনটাকেও কুৎসিকতা, বন্যতা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে। যেখানে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় কেউ তালগাছ দাবী করবে না বরং বিবেক আর ন্যায়বোধের মাধ্যমেই সবাই পরিচালিত হবে। অন্যের দোষ খোজার সাথে সাথে নিজেকেও সংশোধন করবে।
এমন সমাজটা যদি আমরা গড়তেই পারি যার মূল প্রাণ হল নৈতিকতা আর সংযম, তাহলে কেবল আমাদের এই মহা সংগ্রামের নারী মুক্তিই নয় বরং সাথে সাথে পৃথিবীর মানুূষগুলোর মুক্তিও নিশ্চিত। আর সত্যি বলতে কি নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্যই হোক আর পর্দা পালনের জন্যই হোক নারীরা যে এখন বোরখায় মুখ ঢেকে রাখছে তারও প্রয়োজন পড়বে না তখন। কারণ জ্যান- মানুষগুলোর মধ্যে কেউই কোন নারী বা পুরুষের দিকে লালসা আর প্রবৃত্তির মানসে তাকাবেও না।
হয়ত বিশ্বাস হবে না আমার কথা। হয়ত আমাকে কল্পনা বিলাসী অথবা পাগলও ভাবতে পারেন কেউ কেউ। আমি তাদের বোঝাতেও চাইব না বা তাদের দোষও দেয়ার ইচ্ছা নেই আমার। তবে এটুকুতো অনুরোধ করতে পারি যে প্লিজ ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখুন! ভাবলেতো আর পয়সা লাগে না। প্লিজ ভাবুন। আসুন দেখি সেরকম সমাজ জন্মানোর কোন ফর্মূলা আমরা কোন উপায়ে বের করতে পারি কি না। ॥

Sunday, April 6, 2008

মুনিরা-৭

- হাঁ হাঁ, তারা আলাদা জায়গায় থাকে, আলাদা জিনিস খায় ৷ তাদের গরুর মাংস দেয়া হয় না ৷

নন্দিতা হেসে বলল, না না ওতে আমার অসুবিধা নেই ৷ গো মাংসে আমার অরুচি নেই, নফর দাদা!

গজনফর এবার তুড়ি মেরে বলে উঠল, তবে তো মিটেই গেল ৷ আবার কি যাবি তাহলে?

- তুমি নিয়ে যাবে?

- তুই যদি যাস তো নিয়ে যাব না মানে ? একশোবার নিয়ে যাব ৷

- যাব ৷ বলে নন্দিতা জেন্দা বাবার উদ্দেশ্যে আবার ভক্তিভরে দুটি হাত কপালে ঠেকাল ৷ এই পদ্ধতিটি গজনফরের আগে জানা ছিল না ৷ নন্দিতা কে ওটা বারবার করতে দেখে সেও যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে, চোখ বন্ধ করে বাবার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করল ৷



সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ন'টা অব্দি পথ-ঘাটগুলিতে নতুন প্রাণ-চাঞ্চল্যের পরশ লাগে ৷ বাস-ট্যাকসি-রিক্সার তুমুল শোরগোল ওঠে ৷ বুড়ো কাছিমের মতন পিঠঅলা মান্ধাতা যুগের চোখবোঁজা-বাসগুলো খুবলে খাওয়া-পিচঢালা রাজপথে হামাগুড়ি দেয় ৷ পেটের মধ্যে এবং কোলে-কাঁখে সাধ্যতীত যাত্রী নিয়ে ক্ষয়ে-যাওয়া অঙ্গ-প্রতঙ্গ ভর করে যখন বাসগুলি নড়তে-চড়তে শুরু করে, তখন তাদের সধ্যাতীত ত্রাহি আর্তনাদের শব্দ আকাশে-বাতাসে অঁও অঁও করে বাজতে থাকে ৷ নির্দয় বাস কাণ্ডাক্টররা মুরগী ভর্তি-খাঁচার মতন অফিস-যাত্রী বোঝাই করে নেয় ৷ দৃষ্টিতাদের পয়সার দিকে, গাড়ির বা যাত্রীর দিকে নয় ৷ বাদুড়-ঝোলা ঝুলে মানুষকে অফিস যেতে হয় ৷ জীবন রক্ষার তাগিদেই তো অফিস ছোটা ৷ ঐ ছোটা ছুটির মধ্যে জীবনের দামটির কথা কারুরই স্বরন থাকে না ৷ বরং জীবনটাই হয়ে ওঠে নিতান্ত তুচ্ছ ৷ ছোট্ট একটা হাতল ধরে জনা দশেক মানুষ ঝুলছে দরজার কাছে ৷ হাতলটা ছিড়ে কিংবা হাত ফসকে পড়ে গেলেই চিত্পাত ৷ তারপরেই কুপোকাৎ ৷ জীবন রক্ষার জন্যেই মানুষ জীবনকে কী আশ্চর্য রকম বাজি রাখছে ৷


এই দৃশ্য দেখতে দেখতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল রওশন ৷ মাথায় গামছার ফ্যাটা বাধা হেলপারটা ঢক ঢক করে ছ্যাকড়া গাড়ির ওপর কিল দিচ্ছে আর চেল্লাচ্ছে বেদম ৷ চেল্লানির চোটে ওর গলায় খ্যারখেরে আওয়াজ উঠেছে ৷ হরেন, হরেন, মিয়াবাই, হরেন ৷ চাক্কার তলে পইরা গেলে, ফটা কইরা জব্বর একটা-আওয়াজ অইব ৷


একটা আওয়াজ মাত্র ৷ খুবই সংক্ষিপ্ত সেই সমাপ্তি আয়োজন ৷

কৌতুক ভরে ঐ মর্মান্তিক হুশিয়ারীটি শুনতে শুনতে রওশন রাস্তা পার হয়ে ওপারে উচু ফুটপাতে গিয়ে উঠল ৷ ডানহাতি কোণার দোকানটির নাম বাংলা অক্ষরে লেখা আছে হানিমুন ৷ দোকানের সুনাম হানিমুন রাখার পেছনে হাকীকতটা কী, রওশনের মাথায় ঢুকছে না ৷ শব্দ-প্রীতির নমুনা দেখ রওশন বেশ আশ্চর্য্য হল ৷ কিছুদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে এই বিষয়ে তার সম্যক ধারনা ছিল না ৷ রাস্তার দুপাশের দোকানের সাইনবোর্ড গুলিতে একুশে ফেব্রুয়ারী ষ্মৃতি দীপ্যমান ৷ বোডের ওপর থেকে ইংরেজী হরফ গুলো ভয়ে ভেগেছে ৷ সেখানে বাংলা হরফে ইংরেজী নামগুলি ঝকমক করছে ৷ রওশন একদিক থেকে পড়তে লাগল, রাইজিং সান স্টেশনারী, ইন্টিমেট হেয়ার ড্রেসার, সিজার্স ফাইট টেইলার্স, সিগমা ডেন্টাল ক্লিনিক, লিজা এন্টারপ্রাইজ, প্যানত্রাম স্টুডিও ৷ ধন্য তুমি বাংগালী! ধন্য তোমার সেই একুশে ফেব্রুয়ারী প্রীতি ৷


ধন্যবাদের এই অনুচ্চারিত শব্দটি মনে মনে আউড়াতে আউড়াতে রওশন কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে ডাইনের একাটি মাঝারি ধরনের বাই লেনে ঢুকে পড়ল ৷ বেশ কিছুদিন থেকে মাহতাবের সাথে তার দেখা হচ্ছে না ৷ মেজবুর শরীরটা চার পাঁচ দিন আগে খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল ৷ মাঝে মাঝে বুকের ব্যাথা সেই থেকে কমছে বাড়ছে ৷ হার্ট স্পেশালিষ্ট এর মনোভাব দেখে আন্দাজ হয়, তিনি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছেন ৷ মেজবুর চোখে ও তা ধরা পড়েছে ৷ কিছুদিন থেকে মেজবু হোমীওপ্যাথি করার জন্যে চাপ দিচ্ছেন ৷ আহমদ আনসারীর ছেলেটির রোগমুক্তি দেখে, হোমিওপ্যাথির ওপর তাঁর বিশ্বাস টা মজবুত হয়ে উঠেছে ৷ আড়াই বছরের ছেলেটি বলা নেই কাওয়া নেই হঠাৎ দুম করে পড়ে খিঁচুনি শুরু করত ৷ মুখ ভর্তি ফেনা উঠত ৷ শহরের নাম করা সব ডাক্তারকেই দেখানো হয়েছিল ৷ কিছু হয়নি ৷ বাড়ির লোকেও ওর ভাল হওয়ার আশা ত্যাগ করেছিল ৷ ডাক্তাররা বলেছিল, এপিলেপ্সী ৷ বড় হলে সেরে যেতে পারে ৷ কবে বড় হবে আর কবে সারবে? ওর বাবা আহমদ সাহেব আত্মীয় স্বজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজন হোমীও ডাক্তার দেখিয়েছিলেন ৷ ছেলেটি আজ এক বছর ধরে সম্পূর্ন সুস্থ আছে ৷ তাই দেখে মেজুবুর জিদ চেপেছে, তিনি হোমিওপ্যাথিই করাবেন ৷ রওশন সেই ডাক্তারের কাছেই গিয়েছিল ৷ ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট সেরে মাহতাবের বাসা হয়ে তার বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ৷


মাহতাবের বাসায় এলে রওশনের মনটা বিষাদময় হয়ে ওঠে ৷ মুনীরা চলে যাবার পর, এই বাসায় একটা সকরুন শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে ৷ সেই শূন্যতা রওশনের মনটাকে স্পর্শ করলে, ওর বুকের ভিতরে খাঁ খাঁ করতে থাকে ৷ মাহতাব শূন্যতাকে কেমন ভাবে গ্রহন করেছে সেই জানে ৷ রওশন নিজের মনের মধ্যে কেন যেন অনর্থক পীড়া অনুভব করেছে ৷ মুনীরা রওশনের বন্ধু-পত্নী ৷ তার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া কিছুতেই সঙ্গত নয় ৷ কিন্তু মুনীরাকে দেখার পর অদ্ভুত একটা অনুভূতি রওশনের মনের ভিতর তোলপাড় করে উঠেছিল৷ অথচ মাহতাব এর বিয়ের প্রধান উদ্দোক্তা তো ছিল রওশন নিজেই ৷ যত দিন সে মুনীরাকে দেখে নি, ততদিন তার মনে কোনই ভাবনা জাগে নি ৷ লিবিয়া থেকে ফিরে যে দিন সে প্রথম মুনীরাকে দেখল, হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই রওশনের বুকটার মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠেল ৷ কী অসাধারন সুন্দরী! কী অনিন্দ্য সুন্দর নারী দেহ! রওশন এমনই অভিভুত হয়ে পড়েছিল , যে, মনে মনে সে চিন্তা করে দেখল, মুনীরার সাথে তার দেখা না হওয়াই ভাল ছিল ৷ অথচ সেই দেখাটা হয়েই গেল ৷ শুধু তাই নয়, বেশ কিছুদিন মুনীরার সান্নিধ্যে বসার, তার সাথে চোখা-চোখি হওয়ার উপলক্ষ্যও রওশনের জুটে গিয়েছিল ৷ কথাবার্তা বলার এবং মনের ভাব বিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল৷ সেই কটি দিন রওশনের আনন্দ-বেদনা মেশানো এক অনুভূতি নিয়ে মনের মনি কোঠায় অম্লান হয়ে আছে ৷ রওশনের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছে ৷ রওশন প্রশ্ন করেছে, সে কি মুনীরাকে ভালবেসে ফেলেছে? মনের গভীর তলদেশে তার প্রশ্নের ইতিবাচক জবাবের অস্তিত্ব অনুভব করে সে লজ্জিত বোধ করল ৷ মুনীরাও কি রওশনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল? রওশন তার স্পষ্ট প্রমান কখনো পায় নি সে কথা ঠিক, কিন্তু একথাও তো সে অতল দীঘির মায়াবী মুগ্ধতা কেমন যেন সুম্পুর্ন মিথ্যে তো নয় ৷


রওশন এর বুক জুড়িয়ে সেই সময় ঝড়ো মেঘের ভয়ানক আনা গোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল ৷ প্রবল একটা ঝড় উঠব উঠব করছিল! সেই ঝড়ে রওশন হয়ত তচনচ হয়ে যেত ৷ কিন্তু সেই বিপদের হাত থেকে মুনীরা ওকে বাঁচিয়ে গেছে ৷ রওশকে সে সত্যি সত্যিই বাঁচিয়েছে ৷ মুনীরাকে খুঁজতে গিয়ে ওর বার বার তাই মনে হয়েছে, ওকে যেন আর কখনো না পাওয়া যায় ৷ সে-ই ভাল হবে ৷


টপটপ দুটো দুটো সিড়ি ভেঙ্গে রওশন তিন তলায় উঠে পড়ল ৷ মাহতাব বাসায় আছে বুঝতে পেরে ওর মাথার একরাশ ভাবনার কিলবিলে পোকা এক মুহুর্তের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে গেল ৷ মাহতাব বাসায় না থাকলে তার প্রমান স্বরূপ দরজায় একটা মস্ত বড়ো তালা ঝুলত ৷ মুনীরা যাবার পর ঐ তালাটা আমদানী হয়েছে ৷ এই মহুর্তে সেই চায়নিজ লকটিকে ঝুলতে না দেখে রওশন নিশ্চিত হয়ে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল একবার, দুবার, তিনবার ৷ না, কোন সাড়া শব্দ নেই ৷ আবার চাপ দিল বাতামে ৷ এবারও কোন সাড়া পাওয়া গেল না ৷ রওশন বিরক্ত মুখে ফিরে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় দরজার ফাঁকে রওশন দেখল, একজন তন্বী-তরুণী মুখ বাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ৷ মেয়েটির চোখ-মুখে ঘুম জড়ানো থম থমে ভাব জড়িত গলায় সে প্রশ্ন করল, কাকে চান? রওশন তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল, মাহতাব বাসায় নেই?


-জ্বি না ৷

- কোথায় গেছে বলতে পারেন?

মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, আমি তো ভাল জানি না ৷ আমাকে বলেও যাননি ওঁর স্টেনোর মায়ের নাকি খুব অসুখ ৷ মরনাপন্ন অবস্থা ৷ কাল রাতে একবার সে কথা বলতে শুনেছিলাম ৷ সেইখানেই গেলেন কিনা...

- তাহলে? প্রশ্ন করে রওশন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইল৷

জিনিয়াও সঠিক জবাব দিতে না পেরে চুপ করে রইল৷

দুমুহুর্ত নীরবতার মধ্যে কাটার পর জিনিয়াই মুখ খুলল, আপনাকে আমি কখনো দিখ নি ৷ তাই চিনতে পারছি না৷ আপনার পরিচয়টা দিয়ে যান, মাতু ভাই এলে বলব৷

রওশন সামান্য ইতস্তত করে বলল, মাহতাব এলে বলবেন, রওশন এসেছিল ৷ আমার নাম রওশন, মাহতাব আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, নাম বললেই সে চিনতে পারবে৷

- আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু? কই, মাতু ভাই তো সে কথা বলেন নি কোন দিন? আপনার নাম তার মুখে আগে তো কখনো শুনি নি?

- রওশন মৃদু হেসে বলল, আপনি বোধকরি অল্পদিন হল এসেছেন৷ তাছাড়া আমিও তো এখানে আজকাল বড় একটা আসি না৷ আমার সময়ই হয় না৷ তাই....

- জিনিয়ার মনে পড়ে গেল, বেশ কিছুদিন আগে এমনি একটা কন্ঠস্বর সে ড্রয়িং রুমে শুনেছিল৷ মাহতাব কেন যেন সেদিন ওকে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেননি৷

জিনিয়া বলল, দাড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসুন তাহলে৷

- মাহতাব কখন যে ফিরবে, তার তো কো ঠিক-ঠিকানা নেই৷ যদি জানতাম এতটা সময়ের মধ্যে আসবে, তাহলে না হয় অপেক্ষা করা যেত৷

- তা ঠিক, সময়টা মাতু ভাই নির্দিষ্ট করে বলে যান নি৷ জিনিয়া বিনীত মুখে হাসল৷

রওশন বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, আজ চলি ৷ অন্য এক সময় আসব ধন্যবাদ৷

জিনিয়া সালাম দিয়ে হাসি মুখে রওশনের বিদায় পথের দিকে তাকিয়ে রইল ৷ রওশন হন হন করে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগল ৷ কিন্তু দশ বারোটা সিড়ি নীচে নেমেই আবার সে থমকে দাড়াল৷ তারপর আবার উপরে উঠে এলো৷ জিনিয়া এতক্ষণ দাড়িয়েই ছিল৷ ওকে ফিরতে দেখে মৃদু হাসিতে ওর দুটি চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷


রওশন বলল, আবার আমাকে ফিরে আসতে হল্ কিছু মনে নেবেন না৷ আমার তো পরিচয় দিলাম, কিন্তু আপনারটা তো আমার জানা হল না৷ বলেই রওশন মনে মনে দারুণ লজ্জা অনুভব করল৷ ভাবল, মেয়েটির পরিচয় নেওয়ার কী অধিকার তার আছে? চিন্তাটা আগে ওর মাথায় আসে নি৷ এলে নিশ্চয়ই সে এমন ভাবে ফিরে আসত না ৷


জিনিয়ার মুখ দেখে রওশনের মনে হল, ওর কথায় সে মনে কিছু করে নি মানুষের বিরক্তিটা চেহারায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে ৷

জিনিয়া হাসি মুখে বলল, আমার কী পরিচয় আছে যে দেব, বলুন্

- আপনি কি মাহতাবের বোন?

জিনয়া সামান্য ইতস্তত করে জবাব দিল, হ্যাঁ৷

- ও, তাই? আচ্ছা আচ্ছা, আসি তাহলে ৷ বলেই এবার বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে রওশন টপাটপ সিড়ি ভেঙ্গে নীচে নামতে লাগল৷ সিড়ির বাঁক নেওয়ার মুখে এসে পৌছতেই ওর সাথে মাহতাবের মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল৷

- মাহতাব ওকে দেখে খুশী হয়ে উঠল ৷ বলল, কিরে এতদিনে তোর মনে পড়ল?

- মেজবুর শরীরটা বড্ডো খারাপ হয়ে যাচ্ছেরে ৷ ওকে নিয়ে দারুণ মুছিবতে আছি ৷ বড় বড় হার্ট স্পেশালিস্ট দিয়ে কিছু হল না৷ এখন মেজবু ঐ সব ওষুধপত্তর আর ছুতেই চাচ্ছেন না ৷

- তাহলে কী করবেন?

- বলছেন, হোমিওপ্যাথি করাবেন৷

- এ ড্রাউনিং ম্যান ক্যাচেস এট এ স্ট্র ৷ দেখ, হোমিওপ্যাথি করে কী হয়৷

রওশন বলল, তা বলে নয় রে৷ আজকাল হোমিওপ্যাতিথে মারভেলাস ট্রিটমেন্ট হচ্ছে৷

- মেজবুকে নিয়ে গিয়েছিলি নাকি ডাক্তারের কাছে? মাহতাব প্রশ্ন করল৷

- না, নিয়ে যাব কি? গেলেই সাথে সাথে চান্স পাওয়া যায় নাকি? দারুণ ভীড়৷ প্রথমে এপয়েন্টমেন্ট করে ফিরছি ৷ ফেরার পথে ভাবলাম তোর সাথে দেখাটা করেই যাই ৷

- ভালই করেছিস চল বসে বসে কথা বলি ৷ বলেই মাহতাব কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে লাগল ! বলল, বাসায় গিয়ে কী হবে? বাসায় তো সেই মেয়ে লোকটা নেই ৷ তারচে চল রেস্টুরেন্টে বসে একটু চা খাই আর কথা বলি৷

রওশন মাহতাব কে চমকে দিয়ে বলল, কেন বাসায় তো মানুষ আছে দেখলাম৷

- কে ? মাহতাব শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল৷

- একজন তরুনী ৷ বলল, তোর নাকি বোন হয়৷

-ও, জিনিয়ার কথা বলছিস ? ঘুম থেকে তুই ওকে ওঠাতে পারছিস ? আরে বাবা, তুই দেখছি অসাধ্য সাধন করেছিস৷ ঐ ছুঁড়িটা যা ঘুম-কাতুরে ওকে ডেকে জাগানোই এক মস্ত বড় ফ্যাসাদ ৷ তা যদি জেগে থাকে তাহলে চল বাসাতেই বসি৷

দুজন ওপরে উঠে এলো ৷ মাহতাব কলিং বেলের বোতাম চাপ দিতেই সাথে সাথে জিনিয়া দরজা খুলে দিয়ে বলল, এই মুহুর্তে তোমার এক বন্ধু এসে চলে গেলেন... হঠাৎ রওশনের দিকে চোখ পড়তেই বলল, ও দেখা হয়েছে তাহলে? আসুন ভেতরে আসুন ৷ বলে জিনিয়া ওদের পথ ছেড়ে দিয়ে দরজার একপাশে গিয়ে দাড়াল ।


ঘরে ঢুকে মাহতাব সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, আমার স্টেনোটার মার সাংঘাতিক অসুখ ৷ তাই একটু দেখা করতে গিয়ে ছিলাম ৷

-স্টেনোর নিজের নয় , তার মার অসুখ? তাঁকেই তুই দেখতে গিয়েছিল? রওশন প্রশ্ন করল৷

- কেন, দোষটা কি? মানবতা বলে একটা কথা আছে না?

-তা তো আছেই ৷ তোর স্টেনোটা পুরুষ না মহিলা?

মাহতাব তড়াক করে সোজা হয়ে উঠে বসল ৷ বসে বলল, শালা তোর বাঁকা চিন্তাটা মগজ থেকে আর গেল না দেখছি৷

রওশন কৃত্রিম গম্ভীর মুখে বলল, আরে বল না শুনি ! মহিলা নিশ্চয় ৷ কী বলিস?

মাহতাব প্রশ্নর জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চা খাবি, না কফি?

রওশন নির্লিপ্ত মুখে বলল, না আমার কিছুই লাগবে না৷

ওদের কথার মাঝখানে হঠাৎ জিনিয়া এসে দাড়াল৷ মাহতাবকে সে প্রশ্ন করল, মহিলাটি কি মারা গেছেন, মাতু ভাই ?

মাহতাব অনেকটা উপেক্ষার ভঙ্গিতে বলল, না ৷ তারপর জিনিয়াকে এড়িয়ে রওশনকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেসা করল, কিরে , কি খাবি বল৷

- বললাম তো কিছুই লাগবে না৷ তোর তো ঘরে মানুষ নেই, চাকর বাকরও সব পালিয়েছে ৷ হাঙ্গামা করে লাভ নেই৷

জিনিয়া দাড়িয়েই ছিল কথাটা লুফে নিয়ে হাসি মুখে বলল, চাকর বাকর না থাকুক আমি তো আছি৷ কী খাবেন, বলুন না ৷ চা-কফি যা চান আমি ঠিক পছন্দমতই বানাতে পারব ৷ কিচ্ছু অসুবিধা হবে না ৷

- ধন্যবাদ ৷ কিন্তু সত্যি সত্যি বলছি আমি চা নাশতা সেরেই পথে বেরিয়েছি ৷ আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনা৷

জিনিয়া আব্দার করে বলল, তা কি কখনো হয় ? মাতু ভাই বাসায় ছিলনা বলেই তো তখন আমি জোড় কারি নি ৷ আপনি বাসায় এসে খালি মুখে যাবেন, সেটা কি সম্ভব ? শীগগীর বলে ফেলুন। না বললে ,ওরে আমার যা খুশি হবে, আমি তাই নিয়ে আসব কিন্তু ৷

ওরশন এবার উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল৷ বলল, ওরে বাপরে , দারুন নাছোড় বান্দা দেখছি আপনি ? আচ্ছা, আনুন আনুন ৷ আপনার যা খুশি তাই আনুন, তাই ভাল জিনিয়া খুশি মনে লীলায়ীত ভঙ্গিমায় ভেতরে চলে গেল ৷

তার যাওয়ার দিকে মুহুর্ত খানিক দৃষ্টি রেখে রওশন প্রশ্ন করল, তোর যে একটা বোন আছে, সে কথা তো কখনো বলিস নি মাহতাব?

- তেমন প্রসঙ্গ উঠেছে বলে মনে হয় না ৷ মাহতাব নির্লিপ্ত মুখে জবাব দিল৷

- বলিস কী? প্রসঙ্গ ওঠে নি মানে ? তুই তো সব সময় বলে আসছিস, তিন-কুলে তোর আপন বলতে কেউ নেই...

- আপন যে আছে এখনো কি বলেছি?

-তাহলে তাহলে এই মেয়েটি তোর কে ?

মাহতাব তেমনি নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিল, সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন৷

মুনীরার অন্তর্ধানের পর মাহতাব তার আপন নয়, চাচাতো বোনকে এনে বাসায় রেখেছে এবং সে কথাটি রওশনের কাছে আজও পৌঁছানি, ব্যাপারটি রওশনের কাছে গভীর রহস্যময় ঠেকেছে ৷ অথচ এই মেয়েটি কোন সাধারন মেয়ে নয়৷ কথাবার্তায় আচার আচারনে বিদূষী বলে ধারনা করতে একটুকুও অসুবিধা হবে না৷ বিষয়টি একটু ভাবনা-চিন্তার পর, রওশন ঐ ডেলিকেট প্রসঙ্গটাই চাপা দিয়ে গেল ৷ আর সে ঘাঁটাল না৷ মুখে শুধূ বলল , তাই বল্ ৷ আমি আবার ধরে নিয়েছিলাম , তোর আপন বোন-টোন হবে বোধ হয় ৷


মাহতাবের মনের ওপরকার গুরুভারটা রওশনের কথার পর খানিকটা হালকা হয়ে গেল ৷ আরও স্বচ্ছন্দ হবার মানসে বলল, তুই তো আগেও জানতিস , আমার আপন ভাই বোন কেউ নেই৷ ও হচ্ছে হেড স্যারের মেয়ে ৷ আমার বোনের মতই৷ নাম ওর জিনিয়া ৷ ঢাকা থেকেই পড়াশুনা করছে৷ গোলমাল হয়ে কলেজ-টলেজ সব বন্ধ এখন কী করবে? বাকস -পেটরা নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিল ৷ তা দেখে আমি বললাম, তোর সেই একশো নব্বুই মাইল পথ মাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তোকে আসতে হবে৷ তারচে তুই এক কাজ কর এখানেই থেকে যা ৷ তোর ভাবী নেই কাজের ছোঁড়াও পালিয়েছে৷ একটু হেলপ হলেও হবে৷ ও থাকতে হেজিটেট করছিল৷ আমিই প্রেসার দিয়ে বললাম, তোর হতভাগা ভাইটা এখানে খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করবে, আর তুই বাড়িতে গিয়ে মজা করে খাবি৷ শুনে ও নরম হয়ে গেল৷ যে ভাত রাধার ভয়ে পালাতে চেয়েছিল৷ এখন দিব্যি সেই ভাত রাধা, তরকারী রাধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ৷ সময় মত চা-টা কফিটাও বানাচ্ছে ৷ দেখলি তো কেমন প্রম? তবে ভারী ঘুম কাতরে ৷ দরজা লাগিয়ে একবার শুল কি মরল৷ ভুমিকম্পে সব ওলট-পালট হয়ে গেলে ও ওর সেই কুমভকর্ণ-নিদ্রার কোন ব্যত্যয় হবে না৷ ওর ভাব-চক্কর দেখে আমিও বলে দিয়েছি, রাত্রির বেলায় তুই তোর ঘরে খিল দিয়ে ঘুমাবি ৷ আমার ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা মারা থাকবে ৷ খবার-দাবার সব টেবিলে রেখে যাবি। সুবিধা মত আমি বাইরে থেকে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ব একথা গুলো বলতে পেরে মাহতাব খুবই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে লাগল৷


রওশন গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনল৷ শুনে বলল, এখন তোর ঐ সব কাহিনী রেখে দে৷ যেটা জানতে এসেছি, সেইটা আগে বল৷ তোর বৌর খবর বল৷ তার খোঁজ-টোজ কি কিছু পেলি?

- উঁহুঁ, পাই নি৷ মাঝখানে একদিন ও ভাই এসেছিল ৷ আরে বাবা, বোনকে না পেয়ে রেগে মেগে একেবারে ফায়ার ৷ আমাকে ভয় দেখিয়ে শাসিয়ে গেছে, সে নাকি আমার জিভ উপড়ে ফেলবে৷ ফেলুক না একবার দেখি , কেমন কেমন বাপের বেটা ৷

- ওর ভাই তাহলে কোন কিছু জানে না মনে হচ্ছে?

মাহতাব খানিকটা হতাশা ব্যাঞ্জক সুরে বলল, তাই তো মনে হচ্ছে ৷

রওশন এক মুহুর্তে কী যেন ভবল৷ তারপর বলল, বৌকে তুই তাহলে ছেড়ে দিলি নাকি?

মাহতাব ঝটপট পাল্টা প্রশ্ন করল, ছেড়ে দিলে কি তুই নিকে করে নিবি নাকি? নিলে বল্ দিই ছেড়ে ৷ বলে সে দাঁত বার করে হাসতে লাগল৷

সে-হাসিতে যোগ না দিয়ে রওশন ক্ষোভে মেশানো গলায় বলল, তোর রসিকতা বড্ডো স্থুল রসিকতা, বুঝলি মাহতাব ?
মানুষটা তুই জাত-বেহায়া । তুই কি ভুলে গিয়েছিস যে তোর বিয়ের প্রধান উদ্দোক্তাই ছিলাম আমি ৷ বিয়ে করতে চাইলে তো আগেই চাইতে পারতাম ৷

- তোর তখন পছন্দ হয়নি না?

রওশন সোজা-সুজি জবাব দিল, না হয় নি৷

- কিন্তু তুমি শালা সে কথা গোপন করে গেছ ৷ চালাক আদমী তো ৷ কিন্তু পছন্দ হয় নি কেন রে? প্রথম দৃষ্টিতে তো দারুন পছন্দ হওয়ার কথা ! তোর চোখ, মালা, চোখ তো নয়, একেবারে একস-রে ৷ ও যে ধমান্ধ-ফ্যানাটিক, তুই আগে বাগেই টের পেয়েছিস, তাই না?

রওশন কোন প্রত্যুত্তর করল না ৷ সে-যে আগে কখনো মুনীরাকে দেখে নি, সে-কথাটি মনের মধ্যেই গোপন করল৷
জিনিয়া গাছ -কোমর করে শাড়ী পরে, দুহাতে একখানি ট্রে নিয়ে ওদের সামনের টি-টেবিলে রাখল৷ মাহতাব পিরিচ থেকে এক ষ্লাইস কেক তুলে নিয়ে রওশন কে বলল, নে নে, শুরু কর৷

জিনিয়া চলে যাচ্ছিল , রওশন তাকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি চলে যাচ্ছেন যে! আপনি ও আসুন ৷ জিনিয়া থমকে দাড়িয়ে ফিরে তাকাল৷ হাসি মুখে বলল, আমি তো এখন খাব না ৷ আপনারা খান৷

-কেন, খাবেন না কেন?

-আপনাদের সাথে খেতে গেলে লজ্জা লাগবে না?

- বা রে , লজ্জা লাগবে কেন? খাওয়া ছাড়া আর কী হচ্ছে যে, লজ্জা লাগবে?

জিনিয়া হেসে উঠে বলল, আপনাদের সামনে গিলতে থাকব, আর আপনারা গলা দিয়ে কেমন করে খাবার নামছে , তা যদি পরখ করে দেখতে থাকেন, তখন? সে একাটা ভারি বিশ্রী ব্যাপার হবে না?

মাহতাব এই রকম রঙ্গ-রসিকতায় ভেতরে ভেতরে একটু বিরক্ত হয়ে উঠছিল ৷ বলল, ঐ সব তোর ভ্যান-ভ্যানানি রাখ তো ৷ বসিস তো বসে যা, আর না বসিস তো ভাগ এখান থেকে ৷

রওশন বলল, কেন, ভাগবে কেন,

- খাবেও না ভাগবেও না, তো কী করবে? ভেরেন্ডা ভাজবে নাকি? তাকিয়ে থাকলে, শালা, পেটে অসুখ হয়ে যাবে না?

জিনিয়া সর্বাঙ্গ ভরে খিল খিল করে হেসে উঠল৷ বলল, ঠিক ধরেছে মাতু ভাই, আমাদের ভাবী নেই ঘরে ৷ পেট টেট ডিসঅর্ডার হয়ে গেলে শেষে ডাক্তার-কোবরেজ, পথ্যাপথ্য করতে গিয়ে আমারই জ্বালা বাড়বে৷ ডাইনীটার শীগগীর ভাগাই ভালো ৷ বলে তেমনি হাসতে হাসতে দ্রুত পায়ে সে অন্য ঘরে পালিয়ে গেল৷


মাহতাব কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, মুজাফফর যেরকম রেগে গিয়ে ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড না বাধিয়ে হয়ত সে ছাড়বে না৷ এমনি দেখতে তো ঠিক ভ্যাদা মাছ, কিন্তু জানিস তো ভ্যাদা মাছই জাল ছেঁড়ার যম ৷ ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমার মনে হচ্ছে, সে ওর ভাই-এর বাড়িতেই গিয়ে উঠেছে৷ না হলে একটা কিছু করত না সে ব্যাটা ? তোর কী মনে হয়?


রওশন কোন মন্তব্য করল না৷ হাতের কাপটি পিরিচের ওপর আস্তে করে নামিয়ে রাখল৷

মাহতাব বলল, করুক না যা করবার৷ আমি ও কি ছেড়ে দেব নাকি ভেবেছিস? ছেড়ে দেবার ছেলে আমি নই। পৃথিবীটা কার? পৃথিবীটা টাকার। বুঝেছিস?

রওশন কী একটা কথা বলবার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহুর্ত টং করে কলিং বেলটি বেজে উঠল ৷ রওশন কথা না বলে মাহতাব এর মুখের দিকে তাকাল৷ মাহতাব উঠে গিয়ে দরজার সিটকানিটা খুলে দিল৷ একজন মাঝ-বয়সী লোক দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি জনাব মাহতাব উদ্দীন সাহেবের বাসা?

-জি হ্যাঁ৷ মাহতাব জবাব দিল,

- তাঁর সাথে একটু দরকার ছিল৷ দেখা হবে কি?

- জি, বলুন৷

- আপনিই কি মাহতাব উদ্দীন সাহেব?

- জি হ্যা ৷

- আপনার সাথে বসে একটু আলাপ করতে চাই ৷ বলেই ভদ্রলোক একটু নিরিবিলি জায়গার সন্ধান করতে লাগলেন৷

ভদ্রলোক ইতস্তত করতে করতে আসন গ্রহন করলেন, মাহতাব কাপে কফি ঢেলে তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন্, একটু কফি খান৷

ভদ্রলোক আপত্তি করে বললেন, ধন্যবাদ, আমি চা কফি খাই না৷

মাহতাব এবার জিজ্ঞাসু চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল৷

ভদ্রলোক রওশনের উপস্থিতির কারণে একটু উসখুস করতে লাগলেন ৷ তারপর বিচিত্রভাবে চারিদিকে দৃষ্টি ফেলে দেখে নিয়ে বললেন, আমি এন্টিকরাপশন থেকে আসছি৷ সি, আই, বুরো অব এন্টিকরাপশন থেকে আসছি৷


মাহতাব বলল ও, আচ্ছা আচ্ছা ৷ দরকারটা বলুন৷ ভদ্রলোক এক মুহুর্ত চুপ করে রইলেন৷ তারপর বললেন, আমরা জানতে পেরেছি আপনি মাহতাব উদ্দীন আহমদ, আজ সকালে এন, টি, আর এর নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে দশ হাজার টাকার অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছেন৷


ভদ্রলোকের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দরজার সামনে জন তিনেক সশস্ত্র পুলিশ এসে দাড়াল৷

ভদ্রলোক বললেন,আপনার বাসা তল্লাশির আগে আপনার শরীর তল্লাশি করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত ৷

এই ধরনের কথা শুনে রওশনের মেজাজটা খিচড়ে উঠেছিল ৷ সে প্রবল আপত্তির জন্যে তৈরী হতে গিয়ে মাহতাবের মুখের দিকে চোখ পড়তেই সহসা মিইয়ে পড়ল ৷

মাহতাব কতকটা আড়ষ্ট গলায় বলল, আমি যে অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছি, তার প্রমানটা কি?

ভদ্রলোক কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, প্রমান অবশ্যই আছে ৷ অবৈধ টাকা গুলির প্রত্যেকটি নোটে আমাদের দস্তখত রয়েছে৷

মাহতাব উদ্ভ্রান্তের মতন ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷

ভদ্রলোক বললেন, টাকাটা যদি সঙ্গে থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের বের করে দিন৷ এক্ষুণি আমরা প্রমাণটা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি ৷ আপনি শিক্ষিত মানুষ৷ আশা করি আমাদের সহায়তা করতে আপত্তি করবেন না৷ আমরা অযথা আপনাকে বিব্রত করতে চাই না ৷

রওশন আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ সে মুখ খুলল, একজন সমভ্রান্ত মানুষকে নিয়ে আপনি এ কী যা তা কাণ্ড শুরু করেছেন?

ভদ্রলোক রওশনের কথায় কোনই কর্ণপাত করলেন না৷ মাহতাবকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন, দেরি করছেন মনে হচ্ছে ৷

মুহতাব এবার বাইরে দাড়িয়ে থাকা বন্দুকধারীদের দিকে কাতর চোখে তাকাল ৷ তারপর কম্পিত হাতে প্যান্টের হিপ পকেট থেকে নোটের কয়েকটি তোড়া বের করে ভদ্রলোকের সামনে ধরল৷

ভদ্রলোক বললেন, টেবিলের ওপর রাখুন৷

মাহতাব টাকার বাণ্ডিল কটি টেবিলের ওপর রেখে পাংশু মুখে বসে রইল৷ ভদ্রলোক একটার পর একটা নোট দেখিয়ে বললেন৷ এই যে দেখুন প্রত্যেকটি নোটে আমাদের দস্তখত৷ এগুলো নেবার সময় দস্তখতটি নিশ্চয়ই আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে৷ বলে ভদ্রলোক আবার কাষ্ঠ হাসি হাসলেন ৷ তারপর বললেন, দেখুন, এরপর আপনাকে আমরা আর কাস্টোডিতে না নিয়ে পারি না৷ আপনার ছোট খাটো কোন প্রস্তুতি থাকলে সেটা সেরে তৈরী হয়ে নিন ৷


মাহতাব কাতর চোখে চারদিক দেখে নিল ৷ অস্বস্তি ও অস্থিরতার মধ্যে নন্দিতার কথা তার মনে পড়ে গেল৷ নন্দিতার ষড়যন্ত্রের কথা ধাঁ করে মাহতাব বুঝে ফেলল৷ একটা বিশ্বাসঘাতিনী মেয়েলোক তাকে ডোবানোর জন্যে বহু দিন ধরে এই ভাবে গভীর গর্ত খুড়েছে ৷ আর এই ভাবে গজনফরের অভিলাষও এবার পূর্ন হয়েছে৷ চোখ দুটি তার ছলছল করে উঠল৷


মাহতাবের সমস্ত দুনিয়া এক মুহুর্তে বিষবাষ্পে ভরে গেছে৷ চারদিক থেকে অন্ধকার ঘিরে আসছে৷ টাকা কড়ি, ধন দৌলত, স্বাস্থ্য যৌবন, জ্ঞান গরিমা সবই যেন এই মুহুর্তে বাতাসের তোড়ে শুকনো তুলোর মতন শূণ্যে উড়ে যাচ্ছে ৷ কোন কিছুই আর আবশিষ্ট থাকবে না৷৷


ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে যাবার সময় মাহতাব আশ্চর্য্য রকম শান্ত ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ একটিবারও সে আর পেছন ফিরে চাইল না৷


রওশন ও জিনিয়া শুষ্ক মুখে দরজার সামনে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই দৃশ্যটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে রইল৷


সকালের রোদ্দুর দক্ষিণের জানালা দিয়ে খাটের উপর এসে পড়েছে৷ মাস তিনেক বয়েসের একটি কচি শিশু সেই মিষ্টি রোদের ওমে চুপ করে শুয়ে আছে। ছোট্ট একটি গোলাপী রঙের নাইলন নেটে ঢাকা আছে তার শরীর ৷ চোখের কাজল লেপ্টে লেগে আছে তার গালে, চিবুকে৷ বুকের ওপর পাতলা একখানি নকসি কাথা৷ মাথায় গাঢ় লাল রঙের পশমী টুপী৷ টুপীর ঘের উপচে কালো কোকড়ানো চুলে কপাল পর্যন্ত ঢেকে আছে। পৌঁষের এই দাঁতালো শীতে খুব সকালে ওর কচি মুখখানি কালচে ছিল৷ এখন মিষ্টি রোদের ছোয়ায় তা গোলাপী হয়ে উঠেছে৷


মুনীরা এতক্ষণ শিশুটির মুখের দিকে অনিমেষে তাকিয়েছিল৷ ফুটফুটে চেহারা ৷ মুখটি যেন একটা সদ্য ফোটা ইরানী গোলাপ৷ ঘুমের আগে কিছুক্ষণ ধরে মায়ের দুধ খেতে গিয়ে মুখ ঘষেচে বলে চোখের কাজল গেছে ধেপড়ে ৷ গালে মুখে সে কাজল ছাড়িয়ে পড়ে চেহারাখানি ভারি অদ্ভুত করে তুলেছে৷ সেটা চোখে পড়তেই মুনীরার ঠোটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল৷ ধীরে ধীরে সে খাটের ওপর উঠে গেল৷ তারপর হামাগুড়ি দিয়ে শিশুর কাছে গিয়ে মশারিটি গুটিয়ে দিল৷ অসাবধানতায় শরীরে একটু স্পর্শ লাগতেই শিশুটি চমকে উঠল৷ মুনীরা ওর কাছে শুয়ে, বুকের কাছে ওকে টেনে নিয়ে, খুব আস্তে আস্তে থাবা দিয়ে , বাবা বাবা বলে আদর করতে লাগল৷ মায়ের হাতের কোমল স্পর্শে শুভ্র শিশুটি আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ আঁচলের প্রান্ত দিয়ে খুব সন্তর্পণে মুনীরা শিশুটির লেপ্টে যাওয়া চোখের কাজল মুছে মুছে পরিপাটি করে তুলতে লাগল৷


আপন দেহের মধ্যে যার প্রথম অস্তিত্বের খবার পেয়ে মুনীরা হতচকিত হয়ে উঠেছিল, যার প্রাত্যহিক অস্তিত্ব মরমে মরমে উপলদ্বি করে দেহ মন ব্যথা রোমাঞ্চের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল, এই মুহুর্তে তার মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে মুনীরার হৃদয় সীমাহীন আনন্দ ও বেদনায় পরিপূর্ন হয়ে উঠেছে ৷ মাহতাবকে মুনীরা বাধ্য হয়েই ছেড়ে এসেছে৷ তার দুর্ব্যবহারের কথা মনে করে , মুনীরার সর্বাঙ্গ এতদিন বিষে জর্জরিত বলে মনে হয়েছে। আজ সেই মাহতাবের সন্তানকে বুকে নিয়ে , মুখে চুমো দিতে গিয়ে, মাতৃত্বের সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দিতে গিয়ে মুনীরার প্রতিটি মুহুর্ত যেন আনন্দ শিহরনের ভরে উঠেছে৷


মুনীরার গায়ে একখানি ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরী শাল জড়ানো৷ দুদিন হাড় কাপানো শীতে পড়েছে৷ কুয়াশা কাটা রোদেও সেই শীত কাটতে চাইছে না৷ মায়ের বুকের মিষ্টি ওম না পেলে শিশুর জুত্সই ঘুম হয় না৷ চট করে জেগে ওঠে৷ তা পা ছুড়ে গায়ের কাথা কাপড় লাথি মেরে মেরে ফেলে দেয় ৷ ভারি দুষ্ট ৷ মুনীরা মনে মনে ভাবে আর মৃদু হাসির আভায় চোখ মুখ তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷


ঘুমন্ত শিশুটির কাছে কাৎ হয়ে শুয়ে মৃদু মৃদু হাত বুলাতে থাকে মুনীরা৷
মায়ের বুকের ওমে শিশুটিরই যে পরম পরিতৃপ্তির ঘুম আসে, শুধু তাই নয়, মায়েরও বুকের ভেতরে অপুর্ব এক মধুর অনুভুতি শির শির করতে থাকে৷ মুনীরা ওকে আরো কাছে টেনে নেয়৷ আরো নিবিড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ৷


আসমা বেগম নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে মা ও ছেলেকে ঐ ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কয়েক মিনিট চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলেন৷ একটু সুক্ষ গুন-গুনানি শব্দ শিউলী ফুলের গন্ধের মতন ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে৷ অত্যন্ত মিষ্টি আমেজ ঝরছে মায়ের ক্ষীণ কন্ঠের-ঘুম পড়ানি গানের ভেতর দিয়ে ৷ আসমা বেগম ফিরে যেতে চেয়েছিলেন ৷ কিন্তু পায়ে কী একটা ঠেকার আওয়াজে মুনীরা চমকে উঠল৷ ঘাড় তুলে তাকিয়ে বলল, কে, ভাবী?


- ঘুমুস নি মনি? ভাবছি বুঝি ঘুমিয়ে গেছিস৷

- না ঘুমাই নি৷ বাবু জেগে উঠবে ভেবে থাবা দিচ্ছি৷

- দে, আমি এখন যাই৷ বলে আসমা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন৷

মুনীরা জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে ওটা কী?

আসামা বেগম থমকে দাড়ালেন৷ বললেন, খবরের কাগজ ৷ একটা খবর তোকে দেখাব ভেবে এসেছিলাম ৷

- আমাকে ? মুনীরা সন্তর্পণে উঠে বসল৷ কী খবর দেখাবে?

আসমা বেগম ফিরে এলেন৷ এই দ্যাখ বলে একটি দাগ দেয়া বকস করা খবর দেখিয়ে, কাগজখানি তিনি মুনীরার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ সেখানি হাসি মুখে হাতে নিয়ে পড়তে গিয়েই মুনীরার সাহসা বিবর্ণ হয়ে উঠল৷

আসমা বেগম ওর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, দেখিছিস তো, পাপ বাপকেও ছাড়ে না৷ লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ৷

মুনীরা কম্পিত হাতে কগজখানি আসমা বেগম কে ফেরত দিল৷ তারপর নির্বাক মুখে চুপ চাপ বসে রইল৷

আসমা বেগম স্বগতোক্তির মতন বলতে লাগলেন, অন্তর দিয়ে যাকে স্নেহ করতাম, ভালবাসতাম, সেই মানুষ এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল৷ এই অন্যায়, এই পাপ কি সহ্য হয় ? বিচার না হয়ে যায়? যাগ গে সে কথা ৷ যাতে করেছি ছি, তাতে আর আছে কী ৷ বলে আসমা বেগম মুনীরার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলেন৷ মুনীরার চুখ দুটো ছল ছল করছে৷ আসমা বেগম এর ধারনা ছিল না, যে, মাহতাবের এরেষ্ট হওয়ার খবর শুনে মুনীরা ব্যাথা পাবে ৷


বরং তিনি মনে করেছিলেন, একজন দুরাচারী মানুষের শাস্তির খবর শুনিয়ে তিনি মুনীরার কলিজাটি শীতল করে দেবেন৷ অথচ বিপরীত অবস্থাটি দেখে নিজেই তিনি লজ্জিত হয়ে পড়লেন৷ এক মুহুর্ত কী ভাবলেন তারপর বললেন, খবরটায় চোখ পড়ে গেল বলেই তোকে দেখালাম ৷ নইলে ওর খবর পড়তেও আমার ঘেন্না করে ৷ এখন সে এরেস্ট হোক জেলে যাক, যে যেমন তার তেমন শাস্তি হোক তা নিয়ে আমাদের আর মাথা ব্যাথা নেই৷


মুনীরার বুকের ভেতরে ধক করে উঠল৷ ওর চোখের সামনে বড় বড় হরফে জ্বল জ্বল করছে, ঘুষ গ্রহনের দায়ে হিসাব নিরীক্ষা অফিসার গ্রেফতার ! কানের ভেতর ধ্বনিত হতে লাগল , এরেস্ট হোক, জেলে যাক, যে যেমন তার তেমন শাস্তি হোক, তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই৷ কিন্তু এই শিশুর? মরুক বাঁচুক, জেলে যাক সে যে ওর বাপ ওর আত্মাপরিচয়৷ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে ওই মানুষটিই যে ওর পরিচয়ের উত্স৷ মুনীরার নাড়ী ছেড়া ধন এই শিশুর সেই-ই তো সব! ভাবতে গিয়ে মুনীরার বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠল৷ চোখ দুটি জ্বালা করে অশ্রু গোপন করে নিল৷


আসমা বেগম এত সব কিছুই বুঝলেন না৷ শিশুটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাবু যে বেদম ঘুমুচ্ছে রে৷ দুধ খাইয়েছিস তো?

শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে মুনীরা বলল, ঘুম থেকে জাগেই নি দুধ খাওয়াব কি?

আসমা বেগম বললেন, বাবু কিন্তু ভারী ঠান্ডা রে, মনি৷ ঐ বয়সে খসরুটা কী ভীষণ জ্বালাত! দিন-রাত্রির এক-নাগাড়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করত ৷ তোর কি মনে নেই? বাবু কিন্তু একটুও কাঁদে না ৷ ব্যাপারটা কী জানিস? খসরূ আমার বুকের দুধ পেত না৷ ডিব্বার দুধ খাইয়ে রাখতে হত কিনা, সেই জন্যেই ঐ রকম করে কাঁদত৷ আর বাবু তো অঢেল দুধ পায়৷ কাঁদবে কিসের জন্যে? আমার মনে হচ্ছে, ওর ডিব্বার দুধ লাগবেই না৷ তোর কী মনে হয় ৷


মুনীরা মৃদু হেসে বলল, দুধ তো আছে এখনও ৷ পরে কী হয়ে, কী করে বলব?

-দুধ যার হয়, তার শুরুতেই হয়৷ তোকে তো ওষুধ-পত্তর খেতে হয় নি৷
ওষুধ-পত্তর খেলে দুধ শুকিয়ে যায়৷

ওদের কথার মাঝখানে ছোট্ট শিশুটি শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে উঠে পড়ল! কাদছে না, কেবল ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে ৷ ওকে ঐ রকম তাকাতে দেখে আসমা বেগম খাটের ওপর ওঠে গেলেন৷ মুনীরা একটু সরে বসল৷

আসমা বেগম শিশুটির বিছানার কাছে বসে, ওর তাকানো দেখে বললেন, দ্যাখ, কী রকম আশ্চর্য ব্যাপার-স্যাপার! ঐ টুকুনি ছেলে ঘুম থেকে যে কাদে না, সে আমি বাবার কালেও দেখি নি৷ কী আশ্চর্য রকমের শান্ত-শিষ্ট তাই দেখ! বাপের কিছু পায় নি৷
তা বলে মায়ের ও যে পেয়েছে, তাও মনে হয় না! তুমিও তো কম রাগী নও৷ বলেই বাবা এসো রে , মানিক এসো রে, বলতে বলতে শিশুটিকে আসমা বেগম কোলে তুলে নিয়ে চুমা দিয়ে আদর করতে লাগলেন৷ খানিকক্ষণ আদর করার পর বললেন, বাবাকে প্যান্টি পরিয়ে দিস নি? তোর ভাইজান এসে, কোন কিছু খেয়াল করে না ফস করে কোলে নেবে, আর ও ঝুরুক করে কল ছেড়ে দিবে৷ সেদিন কোলে নেওয়ার সাথে সাথেই দিয়েছে ছেড়ে ৷ এমনি জোড়ে দিয়েছে যে বুকের পাঞ্জাবী তো ভাসিয়েছেই৷ শেষ পর্যন্ত বেচারার দাড়ি পর্যন্ত....ই হি হি হি ৷ বেচারা হেসে উঠে বলল, বাপের পক্ষ নিয়ে শোধ নিচ্ছে বেটা৷


মুনীরা হাসি মুখে বলল, ভারী পাজি হয়েছে৷

আসমা বেগম শিশুটির গালে আরেকবার চুমো দিয়ে বললেন, এই, খবরদার! আমার আব্বুকে পাজি-পাজি বলবি না, বলে দিচ্ছি পাজি বলতে শুনলে তোর ভাইজান ভীষন রেগে যাবে, ঘরে এলেই ওকে বুকে নিয়ে লোকটা কেমন মেতে ওঠে দেখিস নি? কেমন বার বার মুখে চুমো দেয় ? পাজি বলতে শুনলে পিত্তি সে গেলে দেবে দেখো, হ্যাঁ ৷

মুনীরা যেন দিশেহারা হয়ে গেছে৷ একটি কথাও আর মুখে আসছে না৷

আসমা বেগম বলতে লাগলেন, খুব মাথা খাটিয়ে নাম দিয়েছে কী?

মুনীরুদ্দীন আহমমদ৷ মায়ের নাম তো থাকবেই কিন্তু বাপেরটাও বাদ যাবে না৷ শুধালাম, ঐ বদমাশটার নামটা আবার জুড়তে গেলে কেন? আমার কথা শুনে বলল. কী জানিস? বলল, বদমাশ হোক আর যাই হোক, সেই তো ওর বাপ৷ এই শিশুর ধমনীতে তারই যে রক্ত-ধারা বয়ে যাচ্ছে ৷ আমি তার পিতৃ-পরিচয় ভুলিয়ে দেব, এত বড় দুঃসাহস আমার কি আছে?


মুনীরা বিহবল দৃষ্টি মেলে ভাবীর দিকে এক পলক চেয়েই দৃষ্টিটা নামিয়ে নিল৷

আসমা বেগম বলতে লাগলেন, সকালবেলা ঐ শয়তানটার এরেস্ট হবার সংবাদটা দেখে আমাকে সে বলল, এই জিনিসটারই আমি বার বার আশঙ্কা করছিলাম, বেগম ৷ ঐ পথটার শেষপ্রান্তটি এই দুনিয়াতে আল্লাহ পাক ঐ পর্যন্তই টেনে নিয়ে গেছেন ৷ সে যদি মানুষ হয়, তাহলে অবশ্যি একদিন না একদিন বুঝতে পারবে, কেন তাকে পাকড়াও করা হয়েছিল ৷ আর যদি সত্যি সত্যি একটা গাধা হয়, তবে কেন তাকে পাকড়াও করা আর কেন যে ছেড়ে দেওয়া-তার কিছুই সে বুঝতে পারবে না৷ বলেই আসমা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ওরে, দে রে আমার আব্বুকে দুধ দে৷ খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে৷ কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে দ্যাখ্ ৷


মুনীরার এ এক নতুন রূপান্তর ৷ এই ক্ষুদ্র মাংস পিণ্ডটির ক্ষুদ্রতম হৃদপিণ্ডের অস্থির স্পন্দন এখন তার নিজের বুকের মধ্যেও প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ৷ মুনীরার নিরাশ জীবনে আশার শূভ্র আলো জ্বেলে দিয়েছে এই ক্ষুদ্র জীবন সত্তাটি৷ একটি ছোট্ট দেহ, দুখানি ছোট্ট ছোট্ট হাত, দুখানি পা, পিট পিট করে তাকনো একজোড়া নীলাভ চোখ, পাতলা পাতলা ঠোঁট অলা ছোট্ট একখানি মুখ, সবকিছু মিলে যে ক্ষুদ্র একটি জীবন-সত্তা তাকে জড়িয়ে মুনীরারও জীবন-লতাটি বেড়ে ওঠবার এক আশ্চর্য্য অবলম্বন লাভ করেছে৷ আশা-আনন্দে তাই তার হৃদয়খানি এখন পলে পলে আন্দোলিত হয়ে উঠছে৷


মাহতাব এর সংবাদটি শুনে মুনীরার বুকের ভেতরে একবার মোচড় দিয়ে উঠছিল৷ যে-মানুষটির সাথে তার একদিন সাহচর্য্য হয়েছিল, যাকে নিবিড় ভাবে আত্মার আত্মীয় বলে একদিন তাকে গ্রহন করতে হয়েছিল, যার সুখে-দুঃখে মুনীরার নিজের মনেও একদিন সুখ-দুঃখের অনুভূতি জাগত, তার এই দুসংবাদ কী মুহুর্তের জন্যেও হৃদয়কে আলোড়িত করবে না? তারই শিশু- মুনীরার নয়নের মণি, দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর বেড়ে উঠবে, হাটতে শিখবে, কথা বলতে শিখবে, তারপর একদিন হয়ত সব কিছু জানতে চাইবে৷ সেদিন কি সে পাবে সব কিছু গোপন করতে?


মুনীরা শিশুটিকে আর একবার নিবিড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরল! ওর ক্যাতকেতে নরম শরীরের মিষ্টি আস্বাদন মায়ের প্রতিটি রক্ত-কণিকায় যেন বিদ্যুৎ প্রবাহের মতন পরিব্যাপ্ত হয়ে গেল ৷ শিশু চুক চুক করে দুধ চুষে খাচ্ছে ৷ মুখের উঞ্চতায় মায়ের মনে অপূর্ব শিহরণ জাগছে৷ তারই মধুর আস্বাদন দ্রুত মুনীরার হৃদপিণ্ডে পৌঁছে যাচ্ছে ৷ কত মিষ্টি মধুর অনুভুতি !

সেই অনুভুতিতে আপ্লুত মুনীরা স্বপ্নাবিষ্টের মতন শিশুটির মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল৷





সেদিন জুমার নামায শেষ হলে মাহতাব বইরে এসে দেখল, দু’তিন জন লোক ওপাশের চত্বরে খানিকটা জয়গা ঝাড়ু- দিয়ে পরিষ্কার করছে৷ মাহতাব আগে থেকে জানত, ঐখানে মজলিস-এর সেক্রেটারী সাহেবের দারসের মাহফিল হবে৷ মাহতাব এক পা দু পা করে এগিয়ে গিয়ে ওদের কাজ দেখতে লাগল এমন সময় কোথা থেকে বাঘা এসে বলল, আজকে সেক্রেটারী নয়, খোদ আমীর সাহেবই দরসে কোরআন পেশ করবেন৷


- কে বলল, তোকে ? মাহতাব প্রশ্ন করল৷

সেক্রেটারী সাহেবই জানিয়ে দিয়েছেন৷ আপনাকে আজকে ঐ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে৷

- আমি তুই? তুই কী করবি? মাহতাব বাঘাকে প্রশ্ন করল৷

বাঘা হেসে উঠে বলল, আমার অনেক কাজ, মাহাতাব ভাই৷ যাদের দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, তারা তো আপনার মতন অত পড়শুনা করা মানুষ নয়৷ তাই তারা মজলিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না৷ এটা যে মানব-জীবনে অবশ্য করণীয় কাজ, সেটা ভালভাবে না বুঝলে ওদের আগ্রহ জাগবে কেন? দাওয়াতী লোকেরাও অনেকে সেই জন্যে ঠিক সময়ে হাজির হয় না৷ ওদের কাছে দ্বীন হকের সঠিক দাওয়াত পৌঁছাতে হলে, ডেকে নিয়ে হাজির করতে হবে৷ আমি ঠিক করেছি, আপনি অনুষ্ঠান শুরু করবেন, আর আমি ওদের ডেকে ডেকে হাজির করব৷


বাঘার এই উত্সাহ দেখে মাহতাবও উত্সাহিত হয়ে বলল, ঠিক আছে তাই হবে ৷


মাহতাবের সাথে কথাবার্তা সেরে বাঘা নিশ্চিত হয়ে চলে গেল৷

বাঘার যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকেত এই মুহুর্তে মাহতাবের অনেক কথা মনে পরে গেল৷ এই সেই বাঘা, একদিন যে অসৎ সংসর্গে পড়ে একটা হিংস্র পশুতে পরিনত হয়েছিল৷

প্রথম প্রথম জেলে এসে ওর চেহারা দেখে মাহতাবের মনে হত, কোথায় যেন সে ওকে দেখেছে৷ কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সে-কথা সে কিছুতেই মনে করতে পারত না৷ এমনি করে ভাবতে ভাবতেই মাহতাবের বেশ কিছুদিন কেটে যায়৷

একদিন বাঘাকে নিভৃতে পেয়ে মাহতাব জিজ্ঞেস করেছল, কোথায় যেন আপনাকে দেখেছি মনে হয়৷ আচ্ছা, আপনি কি কখনো আমাকে দেখেছেন বলে মনে করেন?

বাঘা হেসে উঠৈ বলছিল, আমারও তো ভাই মনে হয়৷ আপনাকে দেখার পর বহুদিন থেকে আমি ভাবছি, কোথায় যেন দেখেছি৷ কিন্তু কোন কুল কিনারা করতে পারি নি৷ সেদিন হঠাৎ বিষয়টা আবিষ্কার করে ফেললাম ৷

মাহতাব জিজ্ঞেস করেছিল, কী আবিষ্কার করলেন বলুন তো?

- ভুল-চুক হবে কিনা কে জানে৷

- তা হোক, অসুবিধা হবে না৷ আপনি বলুন৷

বাঘা বলেছিল, একদিন পল্লবী রেস্তোরা থেকে বাইরে আসছিলেন৷ আমি ভুল করে...

- এই ৷ ধাঁ করে মাহতাবের সমস্ত ঘটনাটি মনে পড়ে গিয়েছিল৷ মাহতাব বলে উঠছিল, এবার আমার মনে পড়ে গেছে৷ একজন ছোকড়া একটি মেয়েকে নিয়ে ভাগছিল ৷ আপনি ওর পাছায় লাথি মেরে শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে উদ্ধার করেছিলেন৷

বাঘা হেসে উঠে বলেছিল, উদ্ধার করে ঠিকই বটে । কসাই যেমন শেয়ালের মুখ থেকে বকরি উদ্ধার করে -তেমনি৷ কিন্তু যাক সে-কথা এখন সে সব মনে হলেও খুব বিশ্রী লাগে৷ মাহতাব জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু এখানে আসতে হল কেন? বাঘা তেমনি হাসি মুখে বলেছিল, সেও তো এক লম্বা চওড়া কাহিনী৷ সে কাহিনী আর আপনার শুনে কাজ নেই৷


মাহতাব উত্সুক হয়ে বলেছিল, আমার কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে শুনতে ৷ আপনি কি ঘুষ খেতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন?

বাঘা হো হো করে হেষে উঠে বলেছিল, চাকরী থাকলে তো ঘুষ খাব?

শালার চাকরী পেলাম না বলেই যত আপনার ইয়ে....৷ সেই যে বলে, আইডল ব্রেন ইজ দ্যা ডেভিলস ওয়ার্কসপ ৷ বেকারদেরও তো পয়সা লাগে! সংসারে তাদেরও চলতে হয় ৷

- কিন্তু তা হোক , আপনার জেলে আসার কাহিনীটি বলুন তো শুনি৷

বাঘা মুহুর্ত খানিক চুপ করে থেকে বলেছিল, ছাড়ছেন না যখন, তখন বলি শুনুন! যে কোন ঘটনার মধ্যেই মানুষের কিছু না কিছু শিক্ষনীয় থাকে ৷ বলেই বাঘা বলতে শুরু করেছিল, ঐ মেয়েটিকে তো আমরা সেদিন সেই ছোকরার কাছ থেকে কেড়ে নিলাম৷ নিয়েই ষ্কুটারে উঠলাম ৷ সে ষ্কুটার ছুটল কাকরাইল রোড হয়ে রমনা গ্রীণ বাঁ হাতে রেখে, সোজা পশ্চিম দিকে ৷ একটি হোটেলে আমাদের যাওয়ার কথা ৷ ষ্কুটার যখন প্রধান মন্ত্রীর সাচিবালয়ের কাছাকাছি, ধরুন, গজ পঞ্চাশেক দূরে পৌছেছে, আমার সঙ্গীটা ড্রাইভারকে ষ্কুটার থামাতে হুকুম করল৷

ষ্কুটার ড্রাইভারটি ধাঁ করে থামিয়ে দিল । আমার সেই সঙ্গীটির নাম ছিল হীরু ৷ তড়াক করে গাড়ি থেকে সে নেমে পড়ল৷ নেমেই আমাকে বলল, তুই এখানে নেমে যা বাঘা ৷ আমি তো বিলকুল হতবাক ৷ আমার মুণ্ডতে ব্যাপার স্যাপার কিছুই ঢুকছে না তখন৷ আমি অবাক হয়েই শুধালাম, মানে কি বলছিস তুই?

হীরু ডাটের সাথেই বলল যা বলছি পষ্টাপস্টি বলছি। বুঝতে তোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷

আমার খুবই অবাক লাগছে তখন৷ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ও যাবে কোথায়?

সে ফস করে বলে ফেলল, রানী আমার সাথে যাবে৷

আর বলব কি ভাইজান৷ আপনার কাছে বলতেও এখন লজ্জা হচ্ছে ৷ কথাটা শুনে, শালা, মাথার রক্ত আমার টগ বগ করে ফুটে উঠল৷ খেপে উঠে বললাম , শালা, মেয়ে মানুষটা কেড়ে আনলাম আমি , আর তুই বলছেস কিনা একলা তোর যাবে তোর সাথে? সো কি কথা রে?

হীরু তেমনি ডাটের সাথেই বলল, ওকে শুধিয়ে দ্যাখ না, কার সাথে যাবে? আমি তখন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সেই মেয়েটিকে ই জিজ্ঞেস করলাম , কার সাতে সে যেতে চায়৷

মেয়েটি এক মজার জবাব দিল৷ বলল, কার সাথে যেতে হবে তার আমি কী জানি? যার গায়ে বেশি জোর, সেই তো আমাকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে তোমাদের দুজনের কার বেশি জোর সে তোমরাই ভাল বোঝ ৷

হীরু আর আমি দুজনেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি৷ এক মুহুর্ত সে কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, তোমরা দুজনেই তো এনেছ ৷ দুজনেই নিয়ে চল ৷


হীরু কিন্তু তবু ত্যাড়া হয়েই রইল৷ বলল, না, তা হবে না৷ আজ ও আমার সাথেই যাবে৷ তুই আজকে রমনা গ্রীণ থেকে একটা জোগাড় করে নে গে যা অত ভাবছিস কেন? টাকা ফেললে জিনিসের অভাব নেই এদেশে৷ বলেই হীরু ওর পকেট থেকে খান কয়েক একশো টাকার নোট আমার মুখের সামনে তুলে ধরল৷


রাগের চোটে আমি তখন দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি৷ পায়ে ছিল আমার স্পোর্টস শু ৷ বাঁই করে ডান পা টা উঠিয়ে ওর হাতের তলায় মারলাম কষে এক লথি ৷ বললাম , শালার ব্যাটি শালা, টাকার খুব গরম দেখাচ্ছ? তোর টাকায় আমি মুতে দিই৷
লাথির ঘায়ে হীরুর হাতের নোটগুলি ছিটকে পড়ল৷ কিন্তু সে দমল না৷ ব্যাটা রেগে উঠে বলল, তা হলে তুই যাবি না?
আমি চেচিয়ে উঠে বললাম, না, যাব না৷


সে আবার বলল. ঠিক বলছিস?

আমিও ঝেড়ে বললাম, ঠিক , ঠিক ঠিক ৷ একশোবার ঠিক৷

ও বাব্বা, ব্যাটাচ্ছেলে এবার করল কি, পকেট থেকে সেই যুদ্বের সময়কার চুরি করে রাখা পিস্তলটা বের করে আমার বুকের দিকে তাক করে ধরল৷ ওর দুটো চোখ তখন ভাটা মতন জ্বলছে ৷ সত্যি বলতে কি আমি ঘাবড়ে গেলাম৷ শালার ব্যাটা তো গুলি ছুঁড়ে দেবে দেখছি৷ মহুর্তে আমার মনে হল, বাঁচতে হলে এখন কমফুর ট্রেনিংটা কাজে লাগাতে হবে৷ আমি তাই ভেবে চট করে রেডি হয়ে গেলাম৷

হিরু পিস্তলটা ধরেই বলল, তবে এই যা....

ওর কথা শেষ হবার আগেই আমার ডান পা টা বাঁই করে আবার উঠে গেল৷ লাগল গিয়ে ওর হাতে ।সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে দড়াম করে গুলির একট আওয়াজ হল৷ আর সেই মুহুর্তে আমি দিলাম দৌড়। উন্দো মুন্দো ছুটতে লাগললাম ৷ কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়ে গেলাম পুলিশের হাতে ৷ হীরুও ধরা পড়ল ৷ পরে শুনলাম, ঐ গুলিটা তলপেটে লেগে সেই মেয়েটি ওখানেই মারা পড়েছে ৷ তারপর সেই চাঞ্চল্যকর রাণী হত্যার মামলায় হীরুর ফাসি হয়ে গেল৷ ড্রাইভারের সাক্ষী সাবুদ নিয়ে হাকিম আমাকে দিল যাবজ্জীবন্ ৷ মরতে মরতে গেলাম বেঁচে ৷


বাঘা কেমন যেন একটু বিমনা হয়ে পড়েছিল ৷ সে একটু থেমে বলেছিল, সত্যি কথা কি ভাইজান হিরুটার মধ্যেও অনেক গুড কূয়ালিটি ছিল৷ গরীব দুঃখী দেখলে পকেটে হাত দিয়ে যা কিছু উঠত ৷ কিন্তু ঐ রকম একটা মানুষ ও সঙ্গ দোষে খারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ এখন যদি সে এই মজলিসের সংস্পর্শ আসতে সুযোগ পেত, তবে আমাদের মতন সেও আলোর পরশ পেত৷


শেষ দিকে বাঘার গলাটা একটু ধরে এসেছিল৷ বাঘা বলেছিল,

আল্লার রহমত, ভাইজান৷ এ জন্যে সর্বদা আমি মহান আল্লা তায়ালার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারি না৷ আমি সেই বাঘা আল্লার মেহেরবানীতে এখন তো একেবারে বদলে গেছি৷

বাঘার এই ঘটনা বৃত্তান্তই মাহতাবকে একদিন উত্সুক করে তুলেছিল এই মজলিসটি কী? তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী এসব জানবার জন্যে ৷ তারপর থেকেই মাহতাবের মনে দূর্বার আকর্ষন জেগেছিল্ মজলিসের সদস্যদের বক্তব্যে কী এমন আকর্ষণ আছে, যা বাঘার মতন একটি উচ্ছৃঙ্খল ছেলেকে আকৃষ্ট করতে পারে? কী এমন শক্তি আছে, যা তাকে ভিন্ন এক মানুষে পরিণত করে দিতে পারে?


এই বাঘা সেদিন মাহতাবকে আরো বলেছিল জেলখানায় ঢুকে দেখলাম, ভাইজান, গোটা জেলখানাটা চোর ছ্যাচ্চোরের একটা আখড়া৷ এই কারখানাতেই সারা দেশের জন্য ক্রিমিনাল তৈরী হচ্ছে ৷ ছিচকে চোর, সিধেল চেরবা পেটের দায়ে চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে এখানে আসে ৷ এসে দস্তুরমত ট্রেনিং নিয়ে ডাকাত হয়ে বেরিয়ে যায়, তরপর সেখানে গিয়ে পাকা পোক্ত ডাকাত হয়ে দুনিয়া কে মজা লোট করে বেড়ায়৷ প্রথম যখন আমি এখানে আসি, ওদের দেখে আমারও ঐ রকম একটা খেয়াল চেপেছিল ৷ নিজেকে বলতাম, বাঘা রে! যাবজ্জীবন হলেও তো একদিন জেলখানা থেকে তুই ছাড়া পাবি৷ তখন বাইরে গিয়ে কী করবি? এদেশে বাঁচতে হলে তোকে তো বাঘা হয়েই বাঁচতে হবে ৷ ভাল মানুষ হয়েছিস কি , অমনি অন্য একটা বাঘা এসে শালা, গাঁক করে তোর হলকুমে দাঁত বসিয়ে দেবে৷ তারপরেই কাম ফতেহ৷ তখন? কিন্তু শেষমেশ মাথা থেকে ঐ খেয়ালটা নামিয়ে দিল মজলিসের এই সদস্যরা ৷ আমার ধ্যান ধারণা ওরা একে বারেই পাল্টে দিল৷ ওদের আলোচনায় মরণের পরের জগতটা, ভাইজান চোখের ওপর জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠল৷ এই দুনিয়াতে তো তন্দুরের রুটির মতই ছেকা খেলাম, আবার সেই পরকালও যদি যায়....


মাহতাব বাঘাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ঐ মজলিসের লোকেরা এখানে কী করে ঢোকে?

বাঘা জবাব দিয়েছিল, কেন, আসামী হয়ে ঢোকে৷

- ভাল মানুষরা আসামী কেন হবে?

- ভাল মানুষও আসামী হয়, ভাইজান চোরের হাতে যদি ক্ষমতা থাকে, তখন ভাল মানুষের আর আসামী না হয়ে উপায় কি?

বাঘা বলেছিল, ঐ যে মজলিসের সেক্রেটারী সাহেবকে তো দেখছেন? বেটে খাটো মানুষ ৷ আধপোড়া কালচে তামাটে গায়ের রঙ্ যেদিন পুলিশে ৷ ঐ ভদ্রলোককে জেলখানায় নিয়ে এলো, সেদিন আমরা বুঝিনি ওর মধ্যি একটা জ্ঞানের সাগর লুকিয়ে আছে ৷ ওর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে আমরা দলে দলে অল্পদিনের ভেতরেই মজলিসের সদস্য হয়ে গেলাম ৷


শুনে বাস্তবিকই মাহতাবের মনে দারুণ ঔত্সুক্য জেগেছিল ৷ একে তো এই পার্থীব জীবনের প্রতি তার মনে প্রবল বিরাগ, তার ওপর বাঘার এই ঔত্সুখ্য জাগানো কথা, মাহতাব আকৃষ্ট হয়েই এদিন মজলিসের সেক্রেটারীর সাথে যোগাযোগ করেছিল৷ তারপরেই এই আলোর পরশে মাহতাবের হৃদয় মন সত্যি সত্যি আলোকিত হয়ে উঠেছে ৷ অল্প দিনের ভেতরেই সে মজলিসের প্রাথমিক সদস্য হয়ে গেল৷ আর বাঘাও তাকে মাহতাব ভাই হিসেবে পেয়ে মনে মনে আনন্দ লাভ করল প্রচুর ৷





বাঘা চলে যাওয়ার পর বহুক্ষন ধরে মাহতাব বিগত দিনের ষ্মৃতিটুকু রোমন্থন করতে লাগল৷ আনমনাভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাঘার ঐ ত্রস্ত পদচারনার কথা মনে করে এখন তার খুবই আনন্দ হচ্ছে ৷ একদিন ওর ঐ দুটি পা অন্যায়ের আয়োজনে ঐ রকমই চঞ্চল হয়ে উঠত ৷ সেটাও তো মাহতাব দেখেছে ৷ আবার সেই দুটি পা ই আজ ন্যায় প্রতিষ্ঠার আয়োজনে তেমনি ভাবেই তত্পর হয়ে উঠেছে ৷ মনটি তার সেই একই আছে, গতিটাই কেবল ঘুরে গেছে কু থেকে সু এর দিকে ৷ বাঘার জীবনের এই চিত্রটি ভাবতে গিয়ে এক সময় মাহতাবের নিজের জীবনের ছবিটিও জ্বল জ্বল করে মনের পর্দায় ভেসে উঠল৷


জীবনটা মাহতাবরে শুরু হয়েছিল দারিদ্র আর টানটানির মধ্য দিয়ে ৷ ছোট বেলায় মায়ের মৃত্যু হয়ে ৷ পরের পাঁচটি বছর ওর বাপের সান্যিধ্যেই কাটে৷ তারাপুর বাজারে ওদের একটা দর্জির দোকান ছিল৷ মাহতাবের বাপ সেখানেই কাজ করত৷ কিন্তু কাজ ঠিকমত জুটত না৷ পাড়া গাঁর ছোট বাজার ৷ শক্রবার আর সোমবার সেখানে হাট বসত৷ হাটের দিন লোকের আনাগোনা বাড়ত যথেষ্ট৷ তখন দুচারটি অর্ডার পাওয়া যেত দূর দূরান্তের লোকেদের কাছ থেকে৷ হাটের দিন লুঙ্গী সেলাই এর কাজটি ও মোটামুটি ভালই জানত৷ তাতে করে কিছু নগদ পয়সা আসত৷ মাহতাবের বাপের দৃস্টি শক্তিটা ছেলেবেলা থেকেই কমে গিয়েছিল৷ ফলে কাপড় সেলাই করতে গেলে সেলাইটা তার ব্যাকা ত্যাড়া হয়ে যেত ৷ খদ্দেরদের বেশির ভাগ লোকই তো সৌখিন৷ পয়সা দিয়ে তারা পোশাক বানাবে, সেলাই খারাপ হলে বরদাশত করবে কেন? এই সব কারণে উঠতি বয়সের তরুণরা মাহতাবদের দোকানের ধারে কাছেও ঘেষত না পাড়াগায়ের তরুণ যুবকরা মাসে দুমাসে একেকবার শহরে যেত সিনেমা দেখতে ৷ আর সিনেমার নায়ক নরায়িকার পোশাকা আশাক দেখে এসে, সেই রকম ডিজাইনের অর্ডার দিত৷ ওদের আশঙ্কা হত, বুড়ো দর্জিটা ঐ রকম সৌখিন পোশাক তৈরী করতে তো পারবেই না, কাপড়ই হয়ত নষ্ট করে ফেলবে৷ তারা অর্ডার দিত উঠতি বয়সের দর্জিদের দোকানে৷ সেই সব দর্জিরা নিজেদেরও থাকত রকমারী টেরিকাটা চুল, আর পোশাকে থাকত চোখ ভোলানো আকর্ষণ৷ তাদের সাথে মাহতাবের বাপের প্রতিযোগিতা করার সাধ্য ছিল না৷ ফলে ওদের ব্যবসা যতই জমজমাট হয়ে উঠতে লাগল, মাহতাবের বাপের ততই শ্রীহীন হয়ে পড়ল৷ আর তার জন্যেই তাদের সংসারে অন্ন বস্ত্রের অনটন সব সময়ই লেগে থাকত ৷
মাহতাবের চার বোন ছিল৷ তাদের দুচার জন ওর জন্মের আগেই মারা যায়৷ বাকী দুজনকে অবশ্যি সে দেখেছে ৷ মায়ের মৃত্যের পর তারাও একে একে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে৷ সংসারের অসচ্ছলতার জন্যেই মাহতাবকে বাপের কাজে সাহায়তা করতে হত। বাপের পায়ের কাছ মাদুর পাতা ছোট একটা চৌকি ছিল৷ তার ওপরে বসে বসে সেলাই করা জামাতে সে ঘাট বাধত৷ ওর বাপ আরও কিছুদিন বেছে থাকলে হয়ত বাপের ব্যাবসাতেই মাহতাবকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়তে হত। সংসারের নিদারুণ দারিদ্রের জন্যেই ছোট বেলায় সে বই হাতে করতে পারেনি৷ লেখাপড়ার ব্যাপারে তার বাপের কোন আগ্রহই ছিল না৷


মাহতাবের বাপও একদিন চোখ বুজল৷ তখন ওকে আশ্রয় নিতে হল মামার বাড়ি ৷ সেখানেও প্রথম দিকে ওর জন্যে এক রাশ দুঃখ কষ্ট ওত পেতে বসে ছিল৷ সকালবেলা পান্তা খেয়ে এক পাল গরু নিয়ে সে মাঠে যেত৷ কোন কোন দিন গরু চরানোর বদলে নিড়ানী হাতে যেতে হত ধানের ক্ষেতে ৷ আষাঢ়ে রোদের ভেতর ওকে আউশ ধানের ভুই নিড়াতে হত৷ অনভ্যাসের দারুণ ধানের পাতার আচড়ে আর ভ্যাপসা গরমে পিঠের ওপর ফোষ্কা পড়ে যেত ৷ সেই ফোষ্কা ফেটে গিয়ে দাগড়া দাগড়া ঘায়ে সারাটা পিঠ যেত ভরে৷ একদিন পিঠ ভরা ঘা নিয়ে মাহতাবকে কাঁদতে দেখে মামার মনটা ব্যথিত হয়ে উঠেছিল৷


বাপ মা মরা ছেলেটা এক মুঠি ভাতের জন্যে কী নিদারুণ কষ্ট করছে! মামা ওর মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন৷ ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে কূল কিনারা না পেয়ে, শেষমেশ ওকে তিনি ষ্কুলে পাঠানোই সব্যস্ত করলেন৷ দুদিন পর বই বগলে মাহতাব ষ্কুলে যাওয়া শুরু করল ৷ আর ঠিক প্রথম পরীক্ষাতেই বোঝা গেল, গরীবের ঘরে জন্মালে কী হবে, ছেলেটি অসাধারণ মেধাবী ৷ অনায়াসে এমন সব কৃতিত্ব সে দেখাল যা দেখে ষ্কুলের শিক্ষকগণও চমত্কৃত হয়ে গেলেন৷ মাহতাব একটার পর একটা বৃত্তি পেয়ে পাশ করে যেতে লাগল৷ আর এই ভাবেই ওর জীবনের আমূল পট পরিবর্তন হয়ে গেল৷ জীবনটা এক পথে চলতে চলতে হঠাৎ মোড় নিয়ে ভিন্ন পথ ধরল।


সেই ছেলে বেলার কথা বার বার মাহতাবের মনে পড়ছে ৷ দুঃখ কষ্ট বেদনায় মুষড়ে পড়ে সে কতদিন যে দয়াময় আল্লার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করেছে, তার কি হিসাব নিকাশ আছে? চোখের পানিতে বুক গিয়েছে ভিজে৷ আল্লাহ একদিন অনুগ্রহ করলেন৷ কিন্তু যেদিন আল্লাহ ওর ভাগ্য খুলে দিলেন, সেদিন থেকেই মাহতাব আল্লাকে ভুলতে শুর করল৷ অতীতের দিনগুলি তার দৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল্ বিষ্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল বেদনা লাঞ্ছনার ইতিহাস ৷ একমুঠি খাদ্যের জন্যে পরমুখাপেক্ষী মাহতাব যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানের শিরোপা ছিনিয়ে আনল, সেদিন তার সুনামের সৌরভে চারদিক মম করতে লাগল৷


তার ঘরে এল মুনীরার মতন সুন্দরী নারী, বধু হয়ে ৷ কিন্তু হায়, প্রবৃত্তির অদম্য তাড়নায় বিভ্রান্ত হয়ে সেই সতী সাধ্বী নারীকেও মাহতাব একদিন অনায়াসে পায়ে ঠেলতে পারল৷


কিন্তু তারপর? তারপর কী পেল মাহতাব? কোথায় গেল তার সম্মানের শিরোপা? কোথায় গেল তার শিক্ষার গৌরব, সম্পদে অহঙ্কার? কার অদৃষ্ট ইঙ্গিতে আজ সে লৌহ কপাটের অন্তরালে পাচ পাচটি বছর ধরে তিল তিল করে অপরাধের শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছে? কে দিল এই বিদ্রোহীর উপযুক্ত শাস্তি?


ভাবতে ভাবতে মাহতাবের দুটি চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হেয় উঠেছিল চোখের পাতা উপচিয়ে কয়েকটি ফোটা পানি ওর গণ্ড চিবুক এবং দাড়ি বেয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ল ৷ তাড়াতাড়ি সে কাপড়ের খুটে চোখ দুটি মুছে ফেলল৷


লৌহ করার অন্তরালে আজ পাঁচটি বছর মাহতাবের কেটে যাচ্ছে এখানকার দিনও এখন দ্রুত আসছে ফুরিয়ে ৷ আজ শিক্ষার ও সম্পদের গর্ব এবং অহঙ্কার একেবারেই ধুলিষ্মাত্ হয়ে গেছে৷ এই জেলখানার বাইরে এখন ওর জন্যে এক নতুন লাঞ্ছনার জীবন অপেক্ষা করে আছে৷ সেই দুঃসহ জীবন সে কেমন করে বরণ করে নেবে, ভাবতে গিয়ে মনটি ওর বার বার শঙ্কিত হয়ে উঠছে৷


আজাকল অহরহ মুনীরার কথা তার মনে পড়ে ৷ বড় কষ্টে, অসহ্য যাতনায় পড়ে সে একদিন মাহতাবকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। মুনীরার শুভ্র নির্মল হৃদয় সেদিন মাহতাবের সেই দুরুন অত্যাচার কেন যে সহ্য করতে পারে নি, আজ মাহতাব তার সবটুকুই মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে পারে ৷ এখানে এসে ভাল মানুষের সাহচর্য না পেলে হয়ত ঐ সত্যটুকু বোঝবার মতন যোগ্যতাও তার কোনদিন হত না৷ লালসার তীব্র হলাহল আকন্ঠ পান করে সেদিন যে সে মৃত্যুর আয়োজন করেছিল, মুনীরার দিব্য দৃষ্টি তাকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল বলেই তো সে তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছে৷ মাহতাব একদিন মহামূল্য হীরককে ছুড়ে ফেলে এক খণ্ড কাঁচের জন্যে মোহমুগ্ধ হয়ে উঠেছিল৷ আজ তার ভীষণ পরিণতি দেখে ওর অন্তরাত্মা প্রতি মুহুর্তে বেদনায় ডুকরে ডুকরে উঠছে৷


কিছুদিন আগে রওশন মাহতাবের সাথে দেখা করতে এসেছিল ৷ রওশন একটি ভদ্রঘরের একজন সুশীলা মুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হয়েছে।
মাহতাবের কাছে এলেই অনেক কথা সে বলে৷ তার কাছ থেকেই গজনফার ও নন্দিতার খবরটাও মাহতাব জানতে পেরেছে৷ বাবা জেন্দপীরের উরশে যাবার পথে গাড়ি উল্টে বহু লোকের সাথে ওরাও দুজন আহত হয়৷ মারাত্নক যখম হওয়ার পর ওরা কেউই আর সুস্থ হয়ে উঠে অফিসে যেতে পারে নি।এদিকে জিনিয়াও সেই কবি ছোকবার সাথেই নাকি আজকাল থাকে ৷ ওরা বিয়ে করেছে কিনা জানা যায় নি৷ তবে দুজনে যে একটা গানের ষ্কুল খুলেছে, সেটা রওশন একদিন নিজ চোখেই দেখে এসেছে৷


এসব কথা শুনতে মাহতাবের সেদিন খুব তিক্ত মনে হয়েছিল। কেউ গানের ষ্কুল খুলুক, আর না হয় নরকের ষ্কুল খুলুক, তা নিয়ে মাহতাবের আজ আর মাথা ব্যাথা নেই। একটি মাত্র সংবাদ জানবার জন্যে এখন ওর প্রাণটা আকুলি বিকুলি করছে ৷ কিন্তু সেই সংবাদটি না দিয়েই রওশন চুপ করে গিয়েছল৷


মাহতাব জিজ্ঞেস করেছিল, মুনীরার কোন খোঁজ জানিস, রওশন?

রওশন বলেছিল, অনেক দিন তো খোজ খবর রাখি না৷ ঢাকার বাইরে যাবার আর সময় পেলাম কই? ইচ্ছে ছিল একবার খোজটা দিয়ে আসব, তা আর হয়ে ওঠে নি৷

মাহতাব প্রশ্ন করেছিল, মুরীরা হয়ত এতদিন বিয়ে করে ফেলেছে, তাই না? তোর কি মনে হয়?

রওশন এক মুহুর্ত চিন্তা করে বলেছিল, আমার কিন্তু উল্টোটি মনে হয় রে, মাহতাব!

- কী মনে হয় তোর?

- তোকে তো সে এই জন্যে ছেড়ে যায় নি যে, অন্য কোথাও কারুর প্রেমে সে পড়েছে৷ তোর প্রতি কখনো সে অপ্রসন্ন ছিল না৷
আমি জানি, সে তোকে ভালওবেসেছিল আল্লার জন্যে আর ত্যাগও করেছিল আল্লারই জন্যে ৷ তাই আমার মনে হয়, সেই অসাধারণ মেয়েটি যা কিছু করেছে, ভেবে চিন্তেই করেছে৷

মাহতাবের চোখ দুটি ছল ছল করে উঠেছিল৷ সে ধরা গলায় প্রশ্ন করেছিল, শুনি দীর্ঘ দিন যদি স্বামীর জেল হয়, তা হলে নাকি স্বামী-ষ্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়?

- কিন্তু কেউই যদি কাউকে ছাড়তে না চায়, তখন? রওশন পাল্টা প্রশ্ন করেছিল৷

মাহতাব মলিন মুখে তাকিয়ে শুধুমাত্র একট দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল৷ কিছুই সে বলতে পারে নি৷

রওশন মাহতাবের ভাব সাব দেখে বলেছিল, এই জেলখানায় এসে ভাল মানুষের সংস্পর্ষ পেয়ে তুই আজ যা হয়েছিস, এটা যদি মুনীরা ভাবী দেখতে পেত, আমার ধারণা আবার তোকে সে মাথায় তুলে নিত৷ কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য, আমি জানি না, সে কেমন আছে, কোথায় আছে৷


মাহতাবের মুখে সেদিন কথা ফোটে নি। রওশনকে বিদায় দিতে গিয়ে সেদিন সে বোবা হয়ে গিয়েছিল৷



অতীতের সমস্ত অপরাধের কথাও মাহতাবের আজ বার বার মনে পড়ছে ৷ দুনিয়ার সাময়িক লোভে মত্ত হয়ে সে একদিন বলগাহীন অশ্বের মতন দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছিল৷ হঠাৎ পথের মাঝখানেই তার চৈতন্যোদয় হল৷ তার সেই যাত্রা আজ এমন এক মোহনায় তাকে পৌছে দিয়েছে, যেখানে আনন্দ ও বেদনার দুটি ধারা পাশাপাশি বয়ে চলেছে ৷ তার অন্তহীন দৃশ্য মাহতাব যেন অন্তরের চোখ মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে অবিশ্রন্ত অশ্রুপাতও মাহতাবের সেই দৃস্টিকে ঝাপসা করতে পারছে না৷




মাহতাব দির্ঘক্ষণ বিমূঢ়ের মতন বসেই ছিল৷ বাঘার ডাক শুনে সম্বিত্ ফিরে এলো৷ বাঘা বলল, মাহতাব ভাই, আপনি এখনও বসে আছেন? কত বাজে জানেন? তিনটে পঞ্চাশ৷ আপনি শীগগীর সভায় চলে যান৷ আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে এক্ষুণি আসছি৷


মাহতাব বাঘার অলক্ষ্যে চোখ দুটি মুছে বলল, যাচ্ছি৷

- আর এক মিনিটও দেরি করবেন না, বলেই বাঘা তার দাওয়াতী লোকদের খোজে দৌড় দিল৷

দুপুর বেলা বেতের ঠেস চেয়ারে হেলান দিয়ে একখানি বই এর পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল মুনীরা৷ শাহীন ষ্কুলে গেছে, এক্ষুণি ওর ফেরার কথা৷ ষ্কুল থেকে ফিরলে ওর পোশাক-আশাক বদলে দিতে হবে৷ তারপর হাত মুখ ধুয়ে, খাইয়ে দাইয়ে কিছুক্ষণ ঘুমুলে এই ঢুলুনিটা আর থাকে না৷


দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খোলা। বাতাবী গাছের ওপর দিয়ে দূরের স্বচ্ছ নীল আকাশটা শুধু চোখে পড়ে। গোটা দুই শঙ্খচিল ডানা মেলে চক্রাকারে উড়ছে৷ কয়েক খণ্ড সাদা মেঘ আকাশের ও প্রান্তে শুভ্র কাশফুলের মতন থোকায় থোকায় ভাসছে৷ মুনীরা বইটি বন্ধ করে সেই দিকে চোখ ফেরাল৷ দুপুরের ঝিম ধরা আকাশে উড়ন্ত দুটি শঙ্খচিল খুব কাছাকাছি হয়ে এখন অলস গতিতে ভাসছে৷ মুনীরার মনে হল, এই দুপুরের আকাশ, উষ্ণ মধুর বাতাস, ভাসমান খণ্ড খণ্ড মেঘ এবং সমস্ত চরাচর জুড়েই এখন যেন আলস্যর ঝিমুনী ধরেছে৷ কোথাও এতটুকু চাঞ্চল্যের লেশমাত্র নেই৷ প্রকৃতি নিবিড় ক্লান্তি আর অবসন্নতায় আচ্ছন্ন ৷ মুনীরা মোহমুগ্ধের মতন আকাশের দিকে কতক্ষন তাকিয়েছিল মনে নেই। সহসা শাহীনের পদশব্দে ওর ধ্যানভঙ্গ হল৷


ঘরে ঢুকেই শাহীন, আম্মি গো, আম্মি! বলে আনন্দে চীত্কার করে উঠল৷

মুনীরা জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে তেমনি অলস গলায় কোনমতে উ বলে জাবাব দিল৷

আম্মি, আমার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে৷ শাহীনের হাতে একখানি কাগজ৷ কাগজখানি সে মায়ের দিকে এগিয়ে দিল৷

মুনীরা হাতের বইখানি টেবিলের ওপর রেখে বলল, কী হয়েছে, দেখি?

আজ শাহীনের রেজাল্ট আউট হবে, সেটা সকালেও মুনীরার মনে ছিল! কিন্তু তারপরেই সেকথা সে ভুলে গিয়েছিল৷ আজাকাল হটাৎ হঠাৎ মুনীরা অনেক জিনিসই ভুলে যায়৷ চিন্তা শক্তিটা কেমন যেন শ্লথ হয়ে গেছে৷ কিছূদূর এগিয়ে যেতে যেতে চট করে মাঝপথেই সেটা পথ হারায়৷ তখন হয় কেউ ষ্মরণ করিয়ে দিলে মনে পড়ে , না হলে সে ভুলেই যায়৷ আর তা মনে করতে পারে না৷


প্রোগ্রেস রিপোর্টখানি হাতে নিয়ে আনন্দে ওর মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বিষ্মত মুখে বলল, ফাস্ট হয়েছিস?

- হ্যাঁ আম্মি ৷ আর রতন সেকেণ্ড হয়েছে ৷ ও আমার থেকে অনেক কম নম্বর পেয়েছে ৷ স্যার না, আদর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, রতন তোমার চেয়ে তিরিশ নম্বর কম পেয়েছে ৷ তুমি ভাল করে পড়বে, নইলে রতন তোমাকে সেকেণ্ড করে ফেলবে৷ ইস, রতনটা যা অঘা না, আম্মি ! গুডস মানে লিখে দিয়েছে ভালগুলি। হি হি কি বোকা। তুমি না শিখিয়ে দিয়েছ, গুডস মানে মাল? না আম্মি ? আমার খুব মনে থাকে৷ আমি তাই ই লিখে দিয়েছি৷ আদব আখলাকেও রতন আমার থেকে পাঁচ নম্বর কম পেয়েছে ৷ হায় আল্লাহ, রতনটা এমন দুষ্টু, জানো আম্মি, জোহরের নামাযের সময়, নামায পড়তে গিয়ে খিক খিক করে হাসে ৷ নামায পড়তে পড়তে হাসলে আল্লাহ গুণাহ দেয় না? কী ভীষণ বদ রতন!

ওর বকবকানির দিকে খেয়াল নেই মুনীরার ৷ সে তখন প্রোগ্রেস বিপোর্ট পড়তেই ব্যস্ত! শাহীন সব সাবজেক্টেই পচানব্বই এর ওপরে নম্বর পেয়েছে৷ অঙ্কে একেবারে পুরো একশোই৷ সে যে খুব ভাল পড়াশুনা করে তাও নয়৷ তাকে পড়াতে বসানোও ভারী শক্ত৷ কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ওর পড়া তৈরী হয়ে যায়৷ যা কিছু পড়ে, সব মনে থাকে ৷ প্রগ্রেস রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাতে গিয়েই মুনীরার হাঠাৎ করে শাহীনের বাপের কথা মনে পড়ে গেল৷ মাহতাবও এমনি ধরনের মেধাবী ছাত্র ছিল৷ ষ্কুল কলেজ সর্বত্র লেখাপড়ায় অন্য ছাত্রদের সে টেক্কা দিয়েছে৷ অথচ আসল পরীক্ষতেই সে অবশেষে ফেল মারল৷


মুনীরা প্রগ্রেস রিপোর্টটি দেখছে আর নানান কথা ভাবছে ৷ শাহীন মায়ের গা ঘেষে দাড়িয়ে বলল, দু তারিখে সবার আব্বাকে ষ্কুলে যেতে হবে ৷ স্যারারা তাদের নিয়ে মিটিং করবেন৷

মুনীরা অন্যমনষ্কের মত বলে দিল, বলিস তোর মামাকে৷

শাহীন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মামাকে যেতে বলে নি, আম্মি! আব্বাদেরকে যেতে বলেছে৷ হেড স্যার ক্লাসে এসে বললেন, তোমাদের সবাইকে কাল চিঠি দিব৷ তোমরা গিয়ে তোমাদের আপন আপন আব্বার হাতে সেই চিঠি দেবে৷ বলেই ফস করে একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে শাহীন প্রশ্ন করল, রতনের আব্বা রোজ ওকে ষ্কুলে রেখে যায়৷ আমার কেন আব্বা নেই, আম্মি? সবার আব্বা আছে, আমার আব্বা নেই কেন?


ওর প্রশ্নটা কানে যেতেই মুনীরা চমকে উঠল৷ এ প্রশ্নের সে কী জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে বোবা চোখে শাহীনের মুখের দিখে তাকাল৷

মাকে জবাব দিতে না দেখে শাহীনের মনের মধ্যে উৎসক্যটা আরো বেড়ে গেল। বার বার বলতে লাগল, বল না আম্মি, আম্মি গো......রতন সে দিন বলল, শাহীন তোর আব্বা কোথায় থাকে রে? আমি বলতে পারি নি। আম্মি!


ক্ষুদে রতনের কাছ থেকেই প্রশ্নটা শাহীনের মনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে৷ সেদিন টিফিনের সময় লাইব্রেরীর ওপাশে কামিনী তলায় বসে দুজনে নুন ঝাল দিয়ে বাদাম ভাজা খাচ্ছিল ৷ রতন বলেছিল, বিকেলে আমরা চিড়িয়াখানায় যাব রে, শাহীন৷ আমার আব্বা নিয়ে যাবেন৷ আমাদের সাথে তুই যাবি? যেতে চাস তো বল, আমি আব্বাকে বলব৷


- না রে ভাই, আমার মামা কারুর সাথে আমাকে কোথাও যেতে দেন না৷ একদিন মামার সাথেই গিয়ে চিড়িয়াখানা দেখে আসব৷

- মামার সাথে? হঠাৎ রতনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, শাহীন তার আব্বার সাথে যাবে না৷ যাবে মামার সাথে ৷ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা শাহীন, তোর আব্বা কোথায় রে? তোর আব্বাকে তো কোনদিন দেখি নি৷

- আব্বা? শাহীনও অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ এ প্রশ্ন তো তার মনে জাগে নি কখনো! সেই প্রথম শাহীনের মাথায় একটি উত্তরহীন প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খেতে শুরু করে ৷ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই সাধারণ প্রশ্নটি শাহীনের মনে এমন প্রকট হয়ে কোনদিন জাগে নি ৷ আর জেগে থাকলেও সেদিনের মতন অমন করে কখনো তার মনে আলোড়ন তোলেনি৷

শাহীন একটি মুহুর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিয়েছিল, তা তো জানিনে রে, রতন!

রতন বলেছিল, তোর আব্বা কি মরে গেছে তাহলে?

শাহীন বোকার মত বলেছিল, আমি যে কিছুই জানি নে৷

- শুধাস তো তোর আম্মি কে৷

তারপর থেকেই সত্যটা জানবার জন্যে ওর ঐ কচি প্রাণে ঔত্সুক্য জেগেছে৷ আব্বার কথা তাকে জানতেই হবে৷ প্রত্যেক দিন সে মনে করে জিজ্ঞেস করবে৷ কিন্তু বাসাতে এলেই আর মনে থাকে না৷ বাসায় এলে খেলাধুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় কিনা৷ খাচার টিয়া পাখিটিকে ছোলা, লাল মরিচ, খোরাতে বদনার নলে করে পানি দেয়ার ভার দিয়েছে খসরু, তার ভাল রকম তদারকি আছে৷ টবে গোলাপ চারা, পাতা বাহার, ক্ষুদে পাম গাছ আছে, তার যত্ন আত্তি করতে গিয়ে ব্যস্ততায় আসল কথাটা শাহীনের মন থেকে রোজ হারিয়ে যায়৷ আগামী দুতারিখে ষ্কুলে পি,টি,এ অর্থাৎ পেরেন্টস টিচার্স এসেসিয়েশন হবে৷ সেদিন সবারই আব্বারা যাবেন ষ্কুলে। স্যারদের সাথে আলাপ করবেন৷ শাহীনেরও তো আব্বার সেখানে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু শাহীনের আব্বা কোথায়?


মুনীরাকে নিরুত্তর দেখে শাহীন আবার জিজ্ঞেস করল, আম্মি, বলছ না কেন? আমার আব্বা কোথায়?

মুনীরা এবার বিরক্ত মুখে ঝাঝিয়ে উঠে বলল, জানিনে৷

শাহীন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল৷ তারপর হঠাৎ ৷ তার মুখখানি কালো হয়ে উঠল৷ অনেক আনন্দ বুকে নিয়ে সে নাচতে নাচতে মায়ের কাছে তার পাশের সুখবর বয়ে এনেছিল৷ মা যে এমন ঝটকা দিয়ে কথা বলবে, শাহীন তা ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারে নি৷ ধীরে ধীরে ওর মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে গেল৷ ঠোট উল্টে, চোখে কাচলে সে কেদে ফেলল৷ শাহীনকে কাঁদতে দেখে মুনীরারও বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল৷ তারও দুচোখ বারে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷


মুজাফফর হোসানই ঠিক এমনি সময় বাইরে থেকে ফিরছিলেন ৷ হঠাৎ মা ও ছেলের দিকে তার চোখ পড়ে গেল ওদের এমনি করে কাঁদতে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন৷ এমনটি তিনি আর কখানো দেখেন নি৷ মুজাফফর মুহুর্ত খানিক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুনীরাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে, মনি?


মুনীরা ভাই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করে আচলে চোখ মুছে চুপ করে রইল৷

মুজাফফর আবার প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে? তোদের কেউ কি কিছু বলেছে?

মুনীরার কাছে থেকে কোনই জবাব পাওয়া গেল না৷

মুজাফফর আবার প্রশ্ন করলেন, খসরু তোমাদের কি কিছু বলেছে আব্বু?

শাহীন এবার কাঁদতে কাদতে বলল, না মামা, খসরু ভাই কিছু বলে নি৷ আম্মি আমাকে বকেছে৷

মুজাফফর এগিয়ে গিয়ে শাহীনকে বুকে তুলে নিলেন৷ বললেন, কেন, বকল কেন? হারে, তুই আমার আব্বুকে কেন বকেসিছ?

আচ্ছা, তুমি চুপ করো, আব্বু৷ দাড়াও ওকে আমি মজা দেখাচ্ছি৷ কেন সে আমার আব্বুকে বকবে? বলে শাহীনের গালে একটা চুমু দিয়ে বললেন, তুমি কি কিছু করেছিলে আব্বু?

শাহীন আদরে অধীর হয়ে তেমনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি কিচ্ছু করি নি মামা৷ শুধু আম্মিকে শুধিয়েছিলাম, রতনের আব্বু আছে, আমার আব্বু নেই কেন? অমনি রেগে গিয়ে আম্মি আমাকে ধমক দিল৷ মুজাফফর হোসাইন হঠাৎ শিশুর মুখের এই প্রশ্নটি শুনে স্তম্বিত হয়ে গেলেন৷ মনে হচ্ছে তার কাছেও এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর নেই৷ আপন করণীয় ঠিক করতে গিয়েই তার বেশ কয়েকটি মুহুর্ত পার হয়ে গেল৷ বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শাহীনের মাথাটি নিজের ঘাড়ের মধ্যে রেখে পিঠে মৃদু হাত বুলাতে বুলতে বললেন, সে কথা তুমি আমাকে কেন শুধাও নি, আব্বু? তোমার আম্মি কী জানে?


- রতন যে আম্মিকে শুধাতে বলে দিয়েছে৷

- ও তাই? কিন্তু রতন তো ছোট মানুষ৷ সেই ই মস্ত বড় ভূল করেছে৷ তোমাকে সে ঠিক মত বোঝাতে পারে নি৷ আমার সাথে চল৷ আমি তোমাক সব কিছু বলব৷ হবে তো?

শাহীন ফোপাতে ফোপাতে ঘাড় নেড়ে সায় দিল৷

মুজাফফর আবার ওর গালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, এবার থেকে কোন কিছু শুধাতে হলে, আমাকেই শুধাবে৷ কেমন? আচ্ছা বাবা শাহীন, বল তো দেখি, তোমার আম্মি বড়, না আমি বড়?

শাহীন ঘাড় তুলে মামার মুখের দিকে তাকাল৷ বলল, আপনি বড় ৷

- বাহ বাহ ঠিক বলেছ, আমার আব্বু৷ আবার বল তো বাবা, যে বড় সে বেশি জানে , না যে ছোট সে বেশি জানে?
শাহীনের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠল৷ বলল, যে বড় সেই বেশি জানে৷

- চমত্কার! আমার আব্বু ঠিক বলেছে৷ এবার বল দেখি , তোমার আম্মি বেশি জানে, না আমি বেশি জানি?

- আপনি৷ বলে শাহীন মামার ঘাড়ের মধ্যে আবার মুখ লুকিয়ে হাসতে লাগল৷

- তা যদি জানো, তবে আমাকে না শুধিয়ে তোমার আম্মাকে শুধালে কেন? শুধানো তো ঠিক হয়নি৷ তাই না?

- জ্বে হ্যাঁ ৷ বলে শাহীন ঘাড়ের মধ্যে মুখ লুকিয়েই রইল৷

মুজাফফর ওকে বুকে নিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন ৷ কিন্তু টেবিলের ওপর একখানি ছাপা কাগজ পড়ে থাকতে দেখে বললেন, ওটা কী গো?

- আমার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, মামা৷

- কই, দেখি দেখি ৷ বলে প্রগ্রেস রিপোর্টটি মুজফফর হাতে তুলে নিলেন৷ তারপর বাম হাতে শাহীনকে বুকে ধরে, ডান হাতে কাগজটি নিয়ে পড়তে গেলেন৷ কিন্তু চশমা নেই বলে পড়তে পারলেন না৷ বললেন, চল চল৷ ও ঘরে গিয়ে তোমার রিপোর্ট পড়ে দেখি৷

ঘরে ঢুকে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মুজাফফর আনন্দের আতিশয্যে হইচই করে উঠলেন, আরে খসরুর মা , কোথায় গো! শীগগীর করে এদিকে এসো৷

আসমা বেগম একটু দিবানিদ্রার আয়োজন করছিলেন৷ ধড়মড়িয়ে উঠে, ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

- এই দেখো, আমাদের মুনীরুদ্দীন আহমদ বাবা জীবন, পরীক্ষায় কী করেছে৷

- ওমা, কী করেছে, বল না শুনি?

- কী করবে? ফাস্ট হয়েছে৷ অঙ্কে একেবারে একশোর মধ্যে একশোই৷

- তই নাকি? আলহামদুরিল্লাহ্ ওকে দাও দিকি আমার কোলে৷ বলেই আসমা বেগম শাহীনকে কোলে নিয়ে ঘন ঘন কয়েকটি চুমু দিয়ে বললেন, হবে না? বাপকা বেটা সিপাহী কা ঘোড়া৷

মুজাফফর হোসাইন এই আনন্দঘন পরিবেশে হঠাৎ অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন৷ আসমা বেগমের কথা শুনে হঠাৎ তার কী হল , পকেট থেকে রূমালখানি বের করে চশমাটি খুলে দ্রুত আপন চোখের উপর চেপে ধরলেন৷


সেদিনই সন্ধ্যার সময় খসরু এক গাদা বই বগলে বাসায় ফিরছিল৷ সন্ধ্যার আবছা অন্ধাকারে বাইরের রোয়াকের ওপর একজন আগন্তুককে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে সেইখানেই থমকে দাড়ল৷ আবছা অন্ধকারে মানুষটিকে চেনা যাচ্ছে না৷ আগন্তুকের মাথায় নেটের ঘোন টুপি, মুখে দাড়ি, বড় মসজিদের ইমাম সাহেবর মতন অনেকটা দেখতে ৷ খসরু এক কদম এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, এখানে এখানে কারুর মাথে কি আপনি দেখা করবেন?


আগন্তুক বলল, মুজাফফর সাহেব বাসায় আছেন?

- আমি তো বাইরে ছিলাম, সঠিক বলতে পারব না৷ আব্বার তো এখন থাকার কথা৷ একটু ভেতরে বসুন৷ যদি থাকেন, আমি ডেকে দিচ্ছি!

আগন্তুক বলল, আমার বসার দরকার হবে না, শুধু একটা কথা বলেই আমি চলে যাব ৷ একটু ডেকে দিলেই ভাল হয়৷

খসরু 'আচ্ছা ডেকে দিচ্ছি' বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল৷ কিন্তু এক মুহুর্ত পরেই আবার ফিরে এসে বলল, আব্বা যদি আপনার পরিচয় জানতে চান তো , কী বলব?

আগান্তুক বলল, দেবার মত পরিচয় তো কিছুই নেই, শুধু বললেই হবে সে একজন লোক আপনাকে একটা কথা বলে চলে যাবে৷
খসরু লোকটির আপাদমস্তক ভাল করে বার দুই দেখে নিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল৷

কিছুক্ষণ পর মুজাফফর হোসাইন বাইরে এলেন৷ আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে তাকে সালাম দিয়ে বলে উঠলেন, আমার সাথে কথা বলবেন?

প্রত্যুত্তরে আগন্তুক কোন কথা না বলে এক মুহুর্তে সটান মুজাফফরে পায়ের ওপর দুম করে পড়ে গেল৷ তারপর ভাইজান আমাকে ক্ষমা করুন বলে তার পা ধরে কাঁদতে লাগল৷

মুজাফফর আকষ্মিক এই ঘটানায় একেবার হতচকিত হয়ে পড়ে ছিলেন ৷ পর মুহুর্তেই বিষয়টি অনুমান করে শান্ত কন্ঠে বললেন, মাহতাব, ওঠো! মাহতাব পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে আপনি ক্ষমা করুন, ভাইজান! আপনি ক্ষমা না করলে আমার অপরাধের মাফ হবে না৷ বলে সে পায়ের ওপরেই পড়ে পড়ে ডুকরাতে লাগল৷


মুজাফফর আর একটি কথাও বলতে পারলেন না ৷ শুধু মাত্র হাত ধরে ভুলুণ্ঠিত মাহতাবকে টেনে তুললেন৷ এবং একমুহুর্ত পরেই তিনি সেখান থেকে দ্রুত বাসার ভেতরে চলে গেলেন।


মাহতাব সেই আবছা অন্ধকারের মধ্যে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগল৷ কিন্তু একটি মিনিট অতিক্রান্ত হবার পরই মুজাফফর হোসাইন আবার দ্রুত এসে ঘরে ঢুকলেন ৷ এবার তার বুকের ওপর শাহীন৷ খসরু বাইরের সুইচাটা অন করে দিতেই আলোয় ঘরটি ভরে গেল৷


মুজাফফর মুহুর্ত কাল এক দৃষ্টে মাহতাবের আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিলেন৷ আজকের এই মানুষটিকে আর আগের মানুষের সঙ্গে মেলানো যায় না৷ এ যেন সেই মাহতাবের কল্পনাতীত রুপান্তর ৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মাহতাব এখন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা ৷ পাপের সহস্র দরিয়া পাড়ি দিয়ে এখন সে পুণ্যের শুচি শুভ্র বেলাভুমিতে এসে দাড়িয়েছে৷


মুজাফফর রুদ্ব কন্ঠে, বললেন, সত্যিই কি তুমি ক্ষমা চাও, মাহতাব?

মাহতাব কোন জবাব না দিয়ে আবার মুজাফফরের পায়ের ওপর হাত রাখতে গেল৷

মুজাফফর বাধা দিলেন৷ বললেন, দাড়াও৷ আমার কাছে নয়, ক্ষমা চাইতে হলে, তোমার এই নিষ্পাপ সন্তানের কাছেই তা চাইতে হবে৷ আজকেও সে আমাকে বারবার শুধাচ্ছিল, আমার বাবা কে? আমার বাবা কোথায়? আমি তার সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারি নি৷ বলতে বলতে মুজাফফর হোসাইন হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলেন৷ সমস্ত পরিবেশটা এক মুহুর্তে বেদনার্ত হয়ে উঠল৷




মুজাফফর অশ্রুরূদ্ব কন্ঠে বলতে লাগলেন, মুনীরুদ্দীন আহমদ, শাহীন, বাপ আমার! তোমার সামনে এই যে মানুষটিকে তুমি দেখছ, আজ বার বার যাকে তুমি খোঁজ করছিলে , এ সেই৷


শাহীন অবাক চোখে মাহতাবের দিকে তাকাল৷

মুজাফফর বললেন, ঐ মানুষটিই তোমার আব্বা- তোমার পরিচয় ৷ যাও, তুমি ওর কোলে যাও৷

শাহীন একটু ইতস্তত করছিল৷ মুজাফফর বললেন, তুমি আজ আমাদের সকলের হয়ে ওকে মাফ করে দাও, বাপ৷ যাও, ওর বুকে যাও৷


মাহতাব হাত পাতল৷ শাহীন ওর বুকে গিয়ে ঘাড়ের ভেতর মুখ লুকাল৷

মাহতাব অশ্রু সিক্ত চোখে দুয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখল, মুনীরা একপাশে পাথরের মূর্তির মতন স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে৷ দুটি চোখে তার দুটি অশ্রু ধারা নিয়নের শুভ্র আলোতে চিক চিক করছে৷


দক্ষিণের জানালাটি খোলাই ছিল৷ সহসা কোথায় থেকে দমকা একটা বাতাস বাতাবী ফুলের একরাশ মিষ্টি গন্ধ বয়ে আনল৷ তারই স্নিগ্ধ সৌরভে সারা ঘর মুহুর্তে সুরভিত হয়ে উঠল৷




সমাপ্ত

মুনিরা-৬

এটা আমার মা-হারা বোন৷ এর ভাবী হলেও তুমি, মা হলেও তুমি৷


শুনতে শুনতে মুনীরার চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল ৷ চকিতে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে সে অশ্রু গোপন করে নিয়ে বলল, মাথায় তুললেই সেখানে দাঁড়িয়ে মানুষে নাচবার সুযোগ পায়৷ ভাইজানকে বলে দিও, এ কাজটি যেন তিনি কখনো না করেন৷


আসমা বেগম বললেন , তা সে করতে যাবে কেন? ওর ভয় ছিল তোমাদের মিল-মহব্বত বনি-বনার ব্যাপার নিয়ে৷ তা যখন হয়ে গেছে, তোরা সুখে শান্তিতে আছিস জানতে পারলেই তো মিটে গেল৷ তাতেই তার সুখ৷


আসমা বেগমের কথা শুনে মুনীরার বুকটা কেপে উঠল৷ নিজের কাছেই তার এই নীরবতাকে প্রতারণা মনে হচ্ছে৷ মনের ভেতর এক-একবার ছটফটিয়ে উঠছে ৷ মুনীরা খুব কস্টের সাথে সেই অস্বস্তিটা দমন করে নিল৷


আসমা বেগম কী ভেবে জিজ্ঞেস করলে, মাহতাব এখন ঠিক মত নামায ধরেছে তো?

মুনীরা থতমত খেয়ে গিয়েছিল৷ সামলে নিয়ে বলল, ও তো বাইরে-বাইরেই থাকে বেশিক্ষণ ৷ সব তো আমি জানিও নে ৷

- তার পর সে ঘুষ-ঘাষ? খায়-টায় নাকি? আসমা বেগম হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন ৷

- তা তো আমি জিজ্ঞেস করিনে ৷

- রশি একেবারে ঢিলা করে দিসনি দেখিস ৷ স্ত্রীর ডিউটি হচ্ছে মিসগাইডেড স্বামীকে সাধ্যমত ফিরিয়ে রাখা ৷ ঢিল পেলে তো চ্যাংড়া মানুষ বখে যাবেই৷

মুনীরা কোন জবাব দিলনা দেখে আসমা বেগম বললেন , তোর ভাইজান বলছিল, দিনাজপুর থেকেই তোর কাছে যাবে ৷ গেল কিনা কে জানে?

মুনীরা মনে মনে আতংকিত হয়ে উঠল৷ ভাবল, যদি ভাইজান এই সময় ওখানে যান, তাহলে এক তরফা মাহতাবের বক্তব্য শুনে হয়ত তার ওপর নিদারুন চটে যাবেন৷ মুখে বলল, গিয়ে দেখবেন, বাসায় আমি নেই৷ তখন কী করবেন?

- তখন আর কী করবে? হয়ত মাহতাবকে পাকড়িয়ে সাথে করে নিয়ে আসবে৷

মুনীরা কেমন হতাশ কন্ঠে বলে উঠল, আসুক৷

বিকেলে হাসিনা বিদায় নেওয়ার সময় মুনীরাকে কাছে ডেকে বলল, তোকে একটা কথা বলে যাই রে মনি৷

- কী কথা বল ৷

- একটা নির্বোধ লোকের সাথে তোর বিয়ে হয়েছিল ঠিক, কিন্তু ...

মুনীরা জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে বলল, কিন্তু কি?

- লোকটি যতই যা হোক, এখনও সে তোর স্বামী, তাই না?

মুনীরা কোন জবাব না দিয়ে হাসিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ৷

হাসিনা আবার প্রশ্ন করল, নাকি, তোদের সত্যিকারের ছাড়া-ছাড়ি হয়ে গেছে?

মুনীরা জবাব দিল, না, ঠিক তা হয়নি৷

- যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে আমি তোকে বলব, তুই এক কাজ কর৷ তুই ঐ মানুষটির মঙ্গলের জন্যে দোয়া কর৷ আল্লাহ অনেক দুরাচারীকে সুপথ দেখিয়েছেন, তাকেও হয়ত দেখাবেন৷

মুনীরার চোখের চাহনিটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠছে ৷ হাসিনার ধারণার সাথে একমত হতে না পেরে, সে যে কি করবে ভেবেই ঠিক করতে পারছে না৷


হাসিনা বিষয়টি মুনীরার কাছে স্পষ্ট করে তোলার উদ্দেশ্যে বলল, তোর যে বয়েস, এই বয়েসে কোন ভাই তার বোন কে ঘরে রাখতে পারে না৷ রাখা ঠিকও নয়৷

মুনীরা বোবা হয়ে শুনছে৷

- একজন মানুষকে ছেড়ে আরেকজনের ঘরে যদি যেতে হয়, সেটাও তো সহজ ব্যাপার নয়৷ তা তো জানিস?

মুনীর অন্তরাত্মা হাসিনার কথায় ছটফট করে উঠল৷

হাসিনা বলল, সেই মানুষটি ও যে খারাপ হবে না, তার কি তরা কি কোন ঠিট আছে?

মুনীরাকে নির্বাক থাকতে দেখে বলল, কি বলিস গ্যারান্টি আছে?

মুনীরার কাছে কোন যুক্তি নেই। বাধ্য হয়ে যে সে অসহায়ের মত বলে উঠল, কিন্তু জানিস ওর র্কমকাণ্ডের কথা মনে হলে আমার দারুণ ঘৃণা হয় ৷ আমি কিছুতেই সইতে পারিনা ৷

হাসিনা সান্তনা দিয়ে বলল, শোন মনি ৷ পাপ কে ঘৃণা কর, পাপিকে নয় ৷ পাপি হয়ত অপরাধের ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর হাছে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে৷

মুনীরা দুমুহুর্ত চুপ করে কথাটি ভেবে দেখল৷ তার পর বলল, ঠিক আছে, তোর কথা আমি ভেবে করে দেখব৷

হাসিনা খুশি হয়ে বলল, তোর জন্যে আমি দোয়া করছি ৷ আল্লাহ তোর পেরেশানী দূর করুন৷

হাসিনা চলে যাওয়ার পর মুনীরা খাটের ওপর গিয়ে চুপ করে পড়ে ছিল৷

কখন যে ঘুম এসে গেছে টেরও পায়নি৷ আসমা বেগমের মৃদু স্পর্শে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, ভাবী শিয়রে দাড়িয়ে ৷ মুনীরাকে জাগতে দেখে আসমা বেগম বললেন, ওঠ, একটা বেজে গেছে, চল্ খাবি চল্৷

মুনীরার শরীরে বড্ডা ক্লান্তি বোধ হচ্ছে ৷ ভাবীকে সে বলল, শরীরটা কেমন কেমন লাগছে৷ খাওয়ার মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না ৷
আসমা বেগম আরো ঝুঁকে পড়ে হাতের উল্টো দিকটা মুনীরার কপালে ঠেকিয়ে বললেন, জ্বর জ্বর করছে নাকি? কই কপাল তো গরম নয়৷ কেমন লাগছে বলতো শুনি?

- পেটের মধ্যে খারাপ লাগছে ৷ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ৷

- রাতে ভাল ঘুম হয়নি, বুঝি?

মুনীরা শুয়ে-শুয়েই বলল, ঘুম কিছু নষ্ট হয়েছে ৷ হাসির সাথে কথা বলতে বলতে রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল৷ বলতে বলতে সে ঝট করে উঠে বসল ৷ তারপর দৌড়ে বাইরে গিয়ে চেয়ারে বসতেই হড় হড় করে অনেকখানি বমি করে ফেলল

আসমা বেগম মুনীরাকে বমি করতে দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন৷ কাছে গিয়ে ওর কাঁধের উপর হাত রেখে কিছুক্ষন বসে রইলেন ৷ বমি করা শেষ হলে জিজ্ঞেস করলেন, পেটে কিছু পরেছে বোধহয়৷ নইলে বমি হচ্ছে কেন?

মুনীরার তখনও সামান্য সামান্য উটকি হচ্ছে দেখে আসমা বেগম বদনার নলের ধারা দিতে দিতে বললেন, কি জ্বালা দেখ্ দিকি৷ এত বেলায় এমনিতেই খাওয়া দাওয়া করিসনি৷ তার ওপর সকালে যা খেয়েছিস তার কিছুই দেখছি হজম হয়নি৷ ওঠ চল, আর বমি হবে না৷ শুয়ে থাকলে আরাম পাবি৷


মুনীরা আসমা বেগমের হাতে ভর দিয়ে উঠে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷ খুবই সে ক্লান্ত- হয়ে পড়েছে৷ এমনিতে ওর শরীর-স্বাস্থ্য ভাল৷ অসুখ-বিসুখ বড় একটা হয়ই না৷ কিন্তু কিছু হলে ভারি কাহিল হয়ে পড়ে৷

আসমা বেগম সিলিং ফ্যানের সুইচটা অন করে দিলেন৷ পাখাটা বন বন করে ঘুরতে লাগল৷ ক্লান্ত মুনীরা চোখ বন্ধ করে চুপ চাপ পড়ে রইল৷ মুখখানি তার ফ্যাকাসে লাগছে৷

আসমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন লাগছে রে?

চোখ বন্ধ করেই সে জবাব দিল, একটু ভাল৷

- এখন কী কষ্ট হচ্ছে?

- মাথার চাঁদিটা গরম হয়ে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠছে ৷

আসমা বেগম দেয়ালের কোয়ার্জ ঘড়িটার দিকে তাকালেন৷ একটা-বিশ বাজে৷ বললেন, আর মিনিট দশেকের ভেতর খসরু এসে যাচ্ছে ৷ আসুক, এলেই ওকে ডাক্তারের কাছে পঠিয়ে দিচ্ছি ৷ মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া ঘুম-টুম সব কিছুতেই তোর বড্ডো অনিয়ম হয়েছে ৷ নইলে এমন হবে কেন?

মুনীরা ক্লান্তিতে আগের মতই চোখ বুঁজে পড়ে রইল৷ মুখ-চোখে দারুণ ক্লান্তির ছাপ ৷ চোখ দুটো একটু যেন বসে গেছে ৷ মুখখানি ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে ৷ দুটি চোখের নীচ দিয়ে কেমন নীলাভ মতন বেষ্টনী দেখা যাচ্ছে ৷ একরাশ ঘন কালোচুল বালিশ উপচে খাটের প্রান্ত টপকে ঝুলে পড়েছে নীচে ৷ আসমা বেগম ওর চুলের ভেতর ধীরে ধীরে আঙ্গুল দিয়ে নাড়া চাড়া করতে লাগলেন ৷


ঠিক মিনিট দশেকের মধ্যে খসরু ব্যাগ কাঁধে ঘরে ঢুঁকে বলল, আম্মি খেতে দিন৷ মুনীরার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল, ফুপু আম্মার কী হয়েছে? অসুখ নাকি?

- তোর ফুপু আম্মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ৷ বমি-টমি করে একবারে যাচ্ছে-তাই ৷ একটু ডক্তারের কাছে যা না, বাবা ৷

- এই দুপুর বেলা ডক্তার চাচা তো ডিসপেন্সারীতে নেই৷

- তাতে হয়েছে কী পাগল৷ তোকে ডাক্তার খানায় যেতে কে বলছে? তুই সোজা তোর ডাক্তার চাচার বাসায় চলে যাবি৷ গিয়ে তোর ফুপু আম্মার অসুখের কথা বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে চলে আসবি ৷

মুনীরা আপত্তি করে বলল, না না, ডাক্তার ডাকতে হবে না৷ এখন আমার বেশ ভাল লাগছে৷ খসরুকে তুমি খেতে দাও৷ খেয়ে দেয়ে তারপর দরকার হলে অবস্থা বলে ওষুধ আনুক ৷

আসমা বেগম আস্বস্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, তবে তাই কর৷ চল আগে খেয়েই নে৷ বলেই মুনীরার দিকে ফিরে বললেন, তুই এক গ্রাস খেয়ে দ্যাখ না কী হয়? এখন যখন একটু ভাল লাগছে..

- একটু দেরি কর ৷ ঘরে লেবু আছে?

- লেবু? লেবু তো বোধহয় আছে! দাঁড়া লেবু কেটে তোর খাবার আমি এখানেই নিয়ে আসছি৷

মুনীরা বাধা দিয়ে বলল, না না, আনতে হবে না৷ আর একটু সুস্থ হলে আমি নিজেই গিয়ে খেতে পারব৷ খসরুকে খেতে দাও৷ খিদেতে ওর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে ৷

মুনীরা চিৎ হয়ে শুয়েছিল৷ সিলিং ফ্যান বন বন করে ঘুরছে ৷ ঘোরার সাথে সাথে থর থর করে কাপছে৷ ঘরময় স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে৷ মুনীরার মাথার ভেজা চুলগুলি শুকিয়ে উঠেছে৷ রেশমের মতন সেই মসৃণ চুলের একটা অংশ ফুর ফুর করে উড়ে ওর চোখ মুখ, গায়ের আসে পাশে খেলা করছে৷ মুনীরার শরীরটা এতক্ষনে সুস্থ মনে হচ্ছে৷ আসমা বেগম ঘরে ঢুকে ওর চোখ মুখের স্বাভাবিক অবস্থা দেখে বললেন, খসরুকে ঔষধ আনতে পাঠাচ্ছি ৷ ঔষুধ এনে দিলেই ইনশআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে ৷


- টিফিনের পর খসরুর ক্লাস নেই? বলতে বলতে মুনীরা উঠে বসল৷ মাথার চুলগুলি দু'হাতে গুছিয়ে কানের পাশ দিয়ে পিঠের ওপর নামিয়ে দিয়ে চুপ করে বসল৷

আসমা বেগম বললেন, তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না৷ আমি কালকে ষ্কুলে চিঠি দিয়ে দেব৷ মাস্টার সাহেব তাহলে ওকে আর বকবেন না৷

মুনীরা বলল, অযথা কামাই করে কী হবে? এখন তো বেশ ভাল লাগছে৷ অন্য কিছু হলে আরো খারাপ হয়ে যেত৷ খসরুর কামাই করার দরকার নেই ৷ ও ষ্কুলে যাক৷

খসরু পাশে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল, মুনীরা বলল, খসরু তুই ষ্কুলে যা, বাবা! আমার শরীর এখন অনেক ভাল ৷ চল, খেতে দেবে চল৷

এই একটা ব্যাপার ৷ ছোটবেলা থেকে মুনীরার বরাবরের অভ্যেস, ওকে খেতে দিয়ে কাছে বসে বসে গল্প না করলে ওর খাওয়াই জমত না৷ মুনীরার ছোটবেলার সেই সব স্মৃতি আসমা বেগম ভুলে যাননি৷ মুনীরা যখন ছোট শিশুটি, তখন বধুবেশে এ-বাড়িতে ঢুকেই ঐ একরত্তি মানুষটিকে লালন করবার ভার পাওয়ার পর প্রথম প্রথম যে বিড়ম্বনা মনে হয়নি, তা নয়৷ কিন্তু কোন অজান্তে , কেমন করে ঐ জড় পিণ্ডের মতন শিশুটি তাঁর মাতৃত্বে দাবিদার হয়ে পড়েছিল, আসমা বেগম টেরও পাননি ৷ এ বাড়িতে ঢুকে আরো একটা ব্যাপার তাঁর চোখে পড়েছিল৷ একজন সৌম্য-শান্ত প্রৌঢ় মানুষ বই-পুস্তকের বিরাট গাদার মধ্যে প্রায় সময় ডুবে থাকতেন৷ তখন এই খাটটি ছিল পুব-পশ্চিমে লম্বা করে পাতা ৷ পুব দিকের কোণাতে জানালার ধার ঘেঁষে উঁচু একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল পাতা ছিল৷ তার ওপরেই থাকত গাদা গাদি করে ঠাসা বই সমেত এই সেগুন কাঠের বুক শেল্ফটি৷ পাশে চেয়ার পেতে নিবিষ্ট মনে পড়াশোনা করতেন মুকাররম হোসাইন, আসমা বেগমের শ্বশুর৷


প্রথম দর্শনে প্রৌঢ় লোকটিকে ভয় ভয় লাগত আসমার ৷ মুখে কাচা-পাকা দাড়ি, মাথার চুল বেশির ভাগই পাকা৷ রাশভারী চেহারা ৷ কিন্তু যে মুহুর্তে আসমা বেগম কে তিনি আম্মাজান বলে সম্বোধনর করে ডেকেছিলেন, ঠিক সেই মুহুর্তেই মনে হয়েছিল স্নেহ-দরদের সহস্র উত্স-মুখ এক সঙ্গে খুলে গেছে ৷ আর তারই স্নিগ্ধ ধারায় আসমা বেগম সূচি-স্নাত হয়ে উঠেছেন ৷ আসমা বেগম শিশুকাল থেকে পিতৃহারা৷ পিতৃত্বের অনুপম পরশে তারও হৃদয় সেদিন ধন্য হয়ে উঠেছিল৷


মকাররম হোসাইন দক্ষিণমুখো হয়ে বসে পড়াশুনা করতেন ৷ সেখানে এবার আর একটি আসনের ব্যবস্থা হল৷ মুকাররম হোসাইন বৌমার পড়াশুনার ভার নিজ হাতেই তুলে নিলেন৷ আসমা বেগমের লেখাপড়ার ভালো সুযোগ হয়নি৷ মুকাররম হোসেইন নিজেই আপত্তি করেছিলেন৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষা থাকতে পারে, তবে সুশিক্ষা নেই, এটাই তার ধারণা ছিল৷ শিক্ষার সেই ঘাটতি পুরণের দায়িত্বও তিনি পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে৷


মুকাররম হোসাইন আসমাকে ডাকতেন আম্মাজান বলে, আর আসমাও তাঁকে ডাকতেন আব্বু বলে৷ এমনি করে উভয়েই উভয়ের সন্তানে পরিণত হয়েছিলেন৷ এই সুত্র ধরেই পিতৃহারা আসমা বেগম যেমন একজন পিতা লাভ করেছিলেন, তেমনি মাতৃহারা মুনীরাও পেয়েছিল মাতৃরুপিনী ভাবীকে ৷ সেই ভাবীরই অকৃত্রিম স্নেহরসে বেড়ে উঠেছে মুনীরা৷ তার জন্যেই মুনীরা সেই অতীত অভ্যেসটি আজো ভূলতে পারেনি৷


আসমা বেগম মুনীরাকে খেতে দিয়ে বললেন, হাসির সাথে আগেই তোর প্রোগ্রাম হয়েছিল নাকি?

ধরা পড়বার ভয়ে মুনীরা মুখের গ্রাস নামিয়ে বলল, না ঠিক আগে থেকে প্রোগ্রাম ছিল না, হঠাৎকরেই..

আসমা বেগমের সহসা অন্য কথা মনে পড়ে গেল৷ বললেন, ও হাঁ, সেদিন একটি মেয়ে এসেছিল রে মনি তোর বয়েসেরই হবে ৷

- কোত্থেকে এসেছিল?

- বলল তো ঢাকা থেকে ৷ ওদের বাড়ি নাকি মাহতাবদের দেশে ৷

- দেখতে কেমন? মুনীরা প্রশ্ন করল৷

আসমা বেগম হেসে ফেললেন৷ বললেন, কেমন কী বলব? খুব সাজ-গোজ করা মেয়ে৷ মুখে লাল টুকটুকে লিপস্টিক , গালে রুজ ঘষেছে ৷ চুলগুলি পনীটেল করে বাঁধা ৷ দারুণ কড়া আধুনিকা৷

-কী বলল এসে?

- দেখলাম কথাবার্তাতেও বেশ চালু ৷ তোকে ভাবী-ভাবী করে বলছে ৷ বলল, আপনি নাকি মুনীরা ভাবীর বড় ভাবী? বললাম বড়ই হই আর ছোটই হই, আমিই তো সব৷ আমি ওর একটাই ভাবী৷ পরিচয় জানতে চাইলাম তো বলল, মাহতাব নাকি ওর বাবার ছাত্র৷ সে নাকি মাহাতবের ঠিক ছোট বোনের মতন৷ চিনিস মেয়েটিকে?

মুনীরা শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, চিনি৷ তারপর কী বলল?

- তোর কথা শুধাল৷ বলল, মুনীরা ভাবী আসেনি? আমি বললাম , না তো৷ আমার বাপু সন্দেহ-সন্দেহ লাগছিল৷ ঢাকায় থাকে ৷ তোকেও জানে শোনে৷ আবার তুই এসেছিস কিনা শুধাচ্ছে এসব কেমন- কেমন যেন তখন আমার উল্টা-পাল্টা লাগছে৷ আমার ভয়ও হল৷ আজাকাল কত রকমের চিটফিট ঘুরছে৷ কার মনে কী আছে, বলার জো আছে কিছু? আমি ওকে জিজ্ঞেস ও করলাম৷ ঢাকায় থাকো, অথচ সেও ঢাকায় আছে, খবর জানো না, কী ব্যাপার? জাবাবে সে অনেক কথাই বলল, ডাকায় মিছিল- টিছিল হচ্ছে ৷ গোলমাল লেগে গেছে ৷ ওদের কে হেস্টেলে ছাড়তে হয়েছে৷ দিন সাতেক তোর সাথে নাকি তার দেখা নেই৷ তোর নাকি আসবার কথা, ইত্যাদি৷ যা সে বলল, সত্যি- মিথ্যে সেই জানে৷

মুনীরা জবাব দিল, সবই সত্যি ৷

- তাহলে আমি তো অন্যায় করেছি রে মনি! আসমা বেগমের মুখ খানি পাংশু হয়ে উঠল৷

- অন্যায় কেন?

- যাই বলিস মেয়েটিকে আমি সন্দেহ করেছি৷ অযথা মানুষকে সন্দেহ করা তো পাপ৷ আসমা বেগম অনুশোচনা করতে লাগলেন!

- কিন্তু আজকাল সাবধান না হলে তো উপায় নেই ৷ মানুষ কত রকমে কৌশল করে মানুষকে চিট করছে৷ একটু সাবধান না থাকলে কি চলে?

আসমা বেগম তবু আশ্বস্ত হতে পারলেন না বললেন, তা যাই বলিস মনি, মেয়েটির সাথে আবার তোর যখন দেখা হবে, আমাদের বাসাতে আসতে বলিস৷

আমি মাপ চেয়ে নিব ৷

- আরে ধুর ৷ ও একটা ছেলে মানুষ, ওর ব্যাপারে নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না৷ তারপর বল, শেষ পর্যন্ত সে কি করল?

- চলে গেল আর কি করবে? আমি ওতো জোরে করে ওকে থাকতে বলিনি ৷ যাই বলিস ওর ওই সাজ-গোজ পোশাক- আশাক দেখেই আমার কেমন যেন লাগল৷ কলেজে পড়া মেয়ে হবে সভ্য-ভব্য ৷ ঐ রকম সঙ সাজে কেন? শুনছি ওর বাপ নাকি মাস্টার মানুষ৷

মুনীরা হেসে বলল, শুধু মাস্টার নয় ভাবী ৷ কোন এক জবরস্তপীরের নাকি মুরিদও৷ মুখে বিরাট দাড়ি বুক পর্যন্ত ৷ মাথায় সব সময় টুপি পরেন ৷ হাটু পর্যন্ত আলখেল্লা ৷


আসমা বেগম বললেন, স্ববিরোধী, বুদ্ধি-শুদ্ধি মাথায় কিছু কম নাকি?

- বুদ্ধি কম হলে হেডমাস্টারী করে কীভাবে?

- তা জানিনে, কিন্তু পীরের মুরীদ হয়ে মেয়েকে নর্তকি সাজায় কীভাবে?

মুনীরা হেসে ফেলল, ও বাবা, তুমি দেখছি অন্তর্যামী৷ আসলেই কিন্তু ও মেয়ে নর্তকী ৷ খুব নাটক-ফাটক করে বেড়ায়৷ গান গাইতেও পারে৷ নজরুল গীতি৷

- সত্যি! আসমা বেগমের গলায় বিষ্ময় ঝরে পড়ল৷

মুনীরা হেসে বলল, কেন, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

- বিশ্বাস হবে না কেন? খুব হচ্ছে ৷ কিন্তু দেখিস, বেশি যেন প্র্রশ্রয় দিস নি, মনি৷ আমাদের মাহতাব আবার রগঢিলে মানুষ৷ গান শুনতে গিয়ে আবার যেন কাত হয়ে না পড়ে৷ বলেই আসমা বেগম হি হি করে হাসতে লাগলেন৷

মুনীরাও সে হাসিতে যোগ দিল বটে, কিন্তু সেই হাসিরই অন্তর্গত কী একটা জিনিস হঠাৎ ছুরির মতন কচ করে ওর বুকে গিয়ে বিঁধল৷ মুনীরার হাসিমুখ সহসা বিকৃত হয়ে উঠল৷



জিনিয়ার ফিরতে ফিরতে দিন পনের লেগে গেল৷ ফেরবার সময় একবার মনে হয়েছিল মুনীরার সাথে সে দেখা করে যাবে৷ মুনীরা নিশ্চয় এতদিন তার ভাই এর বাসায় এসে গেছে৷ এখানে না এলে সে যাবেই বা কোথায়? আসুক-না আসুক সংবাদ একটা সে নিয়ে যেতে পারবে৷ কিন্তু আসার সময় সেটা আর সম্ভবপর হয়ে উঠল না৷ কোচে উঠলে মাঝ পথে নেমে কারুর সাথে দেখা করার কোন জো থাকে না ।একবার তার মনে হয়েছিল কোচে না গিয়ে সাধারণ বাসেই যাবে৷ পথে যাত্রা বিরতি করে মুনীরার খোঁজ খবর নেবার চেষ্ঠা করবে । কিন্তু ওর ভাইয়ের বাড়ির কথা মনে পড়তেই সাহস করেনি৷ ওদের বাড়িটা জিনিয়ার কাছে শ্বাসরুদ্ধকর বলে মনে হয়েছে ৷ মুনীরার ভাবীর সাথে আলাপ হবার পর ওর উত্সাহটুকু তক্ষুণি মিইয়ে পড়েছিল৷ মুনীরার ভাবীর সৌম্য ভাবমুর্তির কাছে জিনিয়ার নিজেকে কেমন যেন খেলো-খেলো মনে হয়েছে ৷ এই রকম অবস্থা ওর প্রায় কোথাওই হয় না ৷ ও দেশে গেলে জিনিয়ার ঝকমকে পোষাক আশাক, মুখে পুরু পুরু রুজ লিপিস্টিক, সাজ সজ্জায় অত্যাধুনিকতা, সব কিছু দেখে মেয়ে-মরদের তাক লেগে যায় ৷ সবাই জিনিয়াকে বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে দেখে ৷ কিন্তু মুনীরার ভাবীর চোখে তো সেই বিষ্ময়ের ভাব ছিলই না, বরং কেমন নিস্পৃহতা লক্ষ্য করে জিনিয়া ঘাবড়ে গিয়েছিল৷


কয়েকটি মুহুর্ত মাত্র ৷ কিন্তু তাও ওর নিদারুণ আড়ষ্টতার মধ্যেই কেটেছে৷ আর শেষ মুহুর্তের সেই ভয়টাই ওকে মুনীরার ভাই এর বাসায় যাওয়া থেকে বিরত রেখেছে৷


ঢাকায় ফিরে জিনিয়া এবার সরাসরি মাহতাবের বাসায় গিয়ে উঠল৷ বাসটি এখন নিতান্ত জনশুন্য ৷ সেখানে নির্জনে পড়াশোনার বেশ সুযোগ হবে৷ আর ফাঁকে ফাঁকে মাহতাব বায়না ধরলে তাকে গানও শোনানো চলবে ৷ মাহতাবের মানসিক অবস্থার বিষয়ে জিনিয়ার মনে সামান্য শংকা ছিল৷ কিন্তু এখানে এসেই ওর সেই শংকাটি নিতান্ত অমূলক প্রমাণিত হল৷ কারণ মাহতাব ওর উপস্থিতিটা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে৷ কারুর শুন্য দেউলে একটি দীপবর্তিকা জ্বলে উঠলে সহসা যেমন আঁধার কেটে যায়, মাহতাবের ও তেমনি গাঢ় আঁধার জিনিয়ার আগমনের সাথে সাথেই উধাও হয়ে গেল৷


ছুটি শেষ হওয়ার নিদিষ্র্ট কোন তারিখ নেই ৷ রাজনৈতিক ক্রাইসিস যত বাড়ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরগুলির বন্ধ থাকার সম্ভাবনাও ততই তীব্র হয়ে উঠছে ৷ জিনিয়ার মা অবশ্যি হোস্টেল খোলার আগে ওকে ঢাকায় যেতে বারণ করেছিলেন ৷ কিন্তু ওর বাবার তাতে পড়াশোনা খুবই ব্যাঘাত ঘটে৷ সেটা একটা দিক ৷ অন্যদিকটাই বেশি দুশ্চিন্তার কারণে ৷ আজকাল দেশ-গ্রামেও কেমন যেন সব বখাটে ছেলেদের উপদ্রব শুরু হয়েছে ৷ ছোট লোকের বাচ্চা সব ৷ ঘরে ছুঁচোর কেত্তন কিন্তু বাইরে তাদেরই আবার কোঁচার লটকন৷ চাল-চুলোর হদিস নেই , মেয়ে ভাগানোর তালে ঘুর ঘুর করে ঘোরে৷ জিনিয়ার অবশ্যিরুচিবোধ আছে৷ এই সব বখাটে ছোকরাদের সে মনে প্রানে ঘৃণা করে৷ কিন্তু তা বলে তো আর চোখ কান বন্ধ করে বসে থাকা যায় না৷ রাতবিরেতে হতচ্ছাড়ারা কোথাও ঘর দরজা ভেঙ্গেও নাকি সর্বনাশ করছে৷ এসব কারণে জিনিয়ার জন্যে ঢাকা থাকাই নিরাপদ ৷ হোস্টেল বন্ধ আছে থাকুক৷ মাহতাবের বাসা তো আর বন্ধ নেই৷


হলোও তাই৷ জিনিয়ার মা বাপের ধারণা ছিল, মাহতাবের বৌ যখন ওকে ভালবাসে তখন দুশ্চিন্তার আর কারণ নেই৷


জিনিয়ার নিজেরও দুশ্চিন্তার অবশ্যি কারণ ছিল না ৷ তবে মুনীরার উপস্থিতির বদলে অনুপস্থিতিটাই বেশি লোভনীয় হয়ে উঠল৷



সেদিন অফিস থেকে এসে মাহতাব দেখল জিনিয়া কী একটা বই নিয়ে ডিভানের ওপর শুয়ে শুয়ে পড়ছে৷ গেন্দা দরজা খুলে দিতেই মাহতাব যে মচ মচ করে ঘরে ঢুকল, জিনিয়া সেদিকে তাকিয়েও দেখল না৷

গায়ের সার্টটি হ্যাংগারে টাঙাতে টাঙাতে মাহতাব বলে উঠল, কী বইয়ে অমন ডুবে আছেন, মাহারাণী৷

জিনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে বলল, দারুণ ইন্টারেস্টীং বই,মাতু ভাই! পড়েছ কখনো?

মাহতাব ওর পাশ ঘেঁষে ডিভানে বসে, জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বলল, বই এর নামই শুনলাম না, তার পড়েছি না পড়েছি কি করে বলব?

- মে-ঘ-দু-ত৷ বাব্বা, সেই কালিদাস বাবুর মেঘদুত?

কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল জিনিয়া ৷ কালিদাস বাবু? ই হি হি হি৷ তোমার কি আক্কেল, মাতু ভাই? কাশিপুরের কালিদাস কোবরেজ পেলে নাকি তুমি? ই হি হি হি৷ পেটে আমার যে ব্যথা হয়ে গেল গো...

মাহতাব কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সাথে বলল, কেন, হয়নি?

জিনিয়া বেদম হাসতে লাগল, হবে না কেন? একশোবার হতেই হবে৷ না হয়ে যাবে কোথায়?

মাহতাব এবার লজ্জিত মুখে বলল, মেঘদুতের লেখক কালিদাস বাবুই তো মনে পড়ছে৷ সেই যে কবে দাদার আমলে ইন্টারভু দিতে গিয়ে একবার পড়েছিলাম৷ ভালো করে মনেও আছে নাকি ছাই? মেঘ দুত-কালিদাস, সোনার তরী-রবীন্দ্রনাথ, অগ্নী-বীণা-নজরুল ইসলাম... কেন, ঠিক হচ্ছে না?

জিনিয়ার সারা শরীর তখন ও হাসির গমকে ঠির ঠির করে কাঁপছে৷ হাসতে হাসতে বলল, তাই বলে তুমি অতবড় একজন সাহিত্যিককে বাবু বলে ডাকবে? বলবে নাকি রবীন্দ্রনাথ বাবু, নজরুল ইসালাম সাহেব? যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মামলা চালাতে গিয়ে তোমার ব্রেণের ইষ্কু-রুপ ঢিলা হয়ে গেছে৷ আমি আর বাঁচিনে ই হিহিহি৷

মাহতাব বলল, আমি একবার ঐ বইটা দেখেছিলাম, শালার, এমন সব ছবি ছিল বইটায়, চোখ ফেরানো যায় না-
ছবি নেই?

- থাকবে না কেন? আছে ৷ এটা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য, তা তুমি জানো? তুমি কোন আক্কেলে যাচ্ছে-তাই বলছ? মুনীরা ভাবী তোমার ধাতুগত পরিবর্তন করে ছেড়েছে, দেখছি৷

- এই, আলতু-ফালতু বলবি না, বলে দিচ্ছি৷ বলেই মাহতাব জিনিয়ার গাছ-কোমর করে কাপড়-পরা শরীরে তর্জনির খোঁচা দিতেই জিনিয়া তড়বড়িয়ে গড়াগড়ি দিয়ে খাটের অন্য প্রান্তে গিয়ে শাসিয়ে উঠল, এই ফাজিল ছোকরা, অমন কাতুকুতু দিলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি৷

মাহবাব দাড়িয়ে উঠে বলল, ভাল না হয় যা হয় হবে৷ খাওয়া দাওয়া সেরেছিস?

তোমার গুণের সাগর গেন্দুমিয়া দিলে তো খাব? তোমাকে আমাকে এক সাথে না বসিয়ে সে পাতে ভাত বাড়বে বলে তো মনে হয় না৷

- গেন্দুমিয়াও তবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত?

পায়ের জুতো জোড়া আলনার শুকেসে ফেলে কোমরে হাত রেখে মাহতাব দাঁড়িয়ে বলল, খুব যে আজকাল কবিতা চচ্র্চা হচ্ছে, ব্যাপার খানা কি?

- দেখছি মহাকবি কালিদাস মেঘদূতকে দিয়ে কেমন করে যক্ষ-প্রিয়ার মান ভঞ্জন করতে চেয়েছেন ৷ আমাদের ও একজন বিরহীনী যক্ষপ্রিয়া আছেন, তার কাছেও তো মেঘদূত যাবে ৷ কী উপায়ে সেটা সম্ভব তার হদিশ তালাস করছি, জানো?

মাহতাব এই তত্ত্ব-কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারল না তবে জিনিয়াকে কবিতা নিয়ে পড়তে দেখলে ওর মনের মধ্যে হঠাৎ খচ করে ওঠে ৷ সেই আধুনিক কবিটির কথা ওর মনের পড়ে যায়৷ বেচারার মাথায় এক ঝাড় উসকো-খুসকো চুল৷ পরনে মলিন নীলচে জিনসের সরু প্যান্ট৷ পাছার উপর এখানে সেখানে গুটি কয়েক পট্টির পকেট ৷ হাঁটুর সামান্য ওপরে বেঢব ডাবটি ৷ সেটা জুড়ে ইংরেজী হরফে লেখা আছে, আই লাভ ইউ ৷ মাহতাবকে জিনিয়ার সহোদর ভেবে এই ছন্নছাড়া প্রেমিক কবি হামলাতে হামলাতে মাহতাবের বাসা পর্যন্ত এসেছিল৷ জিনিয়াকে দষ্তুরমত রেডিওর আর্টিস্ট বানানোর জন্যে তার নাকি বেজায় গরজ ৷ ছন্নছাড়া কবিটির সাথে রেডিও অফিসে কোন বিশেষ ব্যক্তির নাকি জানা-শোনাও রয়েছে ৷ আর সেই ব্যক্তি কবিকে নাকি রেজিস্টার্ড গীতিকার বানিয়ে দেবার আশ্বাসও দিয়ে দিয়েছেন ৷ সেই সুবাদে শোনা গেছে, কবির সাথে জিনিয়াও দু-চারদিন পার্ক -টার্ক ভ্রমণ সেরে এসেছে ৷ কিন্তু এত সব জেনেও মাহতাব গোটা ব্যাপারটা সর্তকতার সাথে চেপে গেছে ৷ কারণ এই সময় জিনিয়াকে বিগড়ে দিয়ে লাভ নেই ৷ মাহতাবের ঘরে আলো জ্বালাবার কিংবা ঘরটি অন্ধকার করবার বোতামটি এখন যে জিনিয়ারই হাতে ৷


একটু খোঁচা দেবার জন্যই মাহতাব বলল, এই কবিতার প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠার পেছনে কোন কবি-প্রীতি নেই তো রে?
জিনিয়া চমকে উঠেছিল৷ মুহুর্তেই সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, হঠাৎ এই সন্দেহ?

- হঠাৎ আর কি? নারীর মনেভাব দেবা নজানন্তি- কুতা মনুষ্যা ৷

জিনিয়া পরিবেশটাকে হালকা করে বলে উঠল, ওরে বাপরে! এযে সেই কালিদাস বাবুকেও এক হাত দেখিয়ে দেয়ার মতন ব্যাপার হল তোমার৷ ব্যালান্স সিটের তলা দিয়ে রসের ফল্গু-স্রোত যে তর তর করে বয়ে চলেছে৷

মাহতাব সাহস পেয়ে বলল, তবে যে! আগাগোড়া না জেনেই যত খাটো করে তুই আমাকে দেখিস , আমি সত্যি অতো খাটো নই, জানিস?

জিনিয়া অভিনয় করে বলে উঠল, খাটো করে দেখি? বলো কী মাতু ভাই? কত কী যে তোমার মাথায় আসে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই৷ এখনও তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না৷ তাই না?

মাহতাব স্তদ্ব হয়ে জিনিয়ার চোখের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল৷

তারপর ধীর গলায় বলল, তোর কাছ থেকে একটা কথা জানতে চাইরে, জিনি৷ বল, আমাকে ঠিক ঠিক জবাব দিবি?

জিনিয়া অদ্ভুত বাঁকা ঠোঁটের হাসি হেসে বলল, ও বাবা, কথাটি জানতেই পেলাম না, তার জবাব দেব কেমন করে?

- কথা তো বলবই৷

- আগে বল, শুনি৷

- তখন তুই ঠাট্টা করে উঠবি৷

- না, ঠাট্টা করব না বল৷

মাহতাব কেমন ফেস ফেসে গলায় বলল, আমাকে তুই বিয়ে করবি, জিনি? জিনিয়ার মুখ-চোখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল৷ এক মুহুর্ত মাহতাবের মুখের দিখে স্থির হয়ে চেয়ে থেকে বলল, আমাকে বলছ?

- না তো কাকে?

জিনিয়ার চোখ দুটি সাপের চোখের মতন একবার ঝিলিক দিয়ে উঠল৷ ঠোঁটের কোণটা একটু কুঁচকে গেলো, অদ্ভুত এক রকম হাসি হেসে বলল, তোমাকে বিয়ে করবার জন্যে তো একদিন আমিই একপায়ে খাড়া ছিলাম, মাতু ভাই৷ তখন তো পায়ে ঠেলেছিলে৷ ভুলে গেছ?

- তখন আমি তোকে বুঝতে পারিনি রে৷ সত্যি বলছি বুঝতে পারিনি ৷

বিষয়টা খুব গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে জিনিয়া হালকা করবার জন্যে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, এতদিনে বুঝতে পারলে তাহলে? বুঝলে বুঝলে বিধবা হয়ে তবেই বুঝলে? কিন্তু কোনো বিধবা পুরুষকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমার মনে যথেষ্ট দ্বিধা আছে, মাতু ভাই৷

মাহতাব কথার খেই হারিয়ে চুপ করে রইল৷

জিনিয়া বলল, বিয়ে করার এত সাধ কেন হল শুনি? লাইসেন্সটা না হলে কি তোমার মনে পাপ বোধ ঠোকর দিচ্ছে নাকি?

- না৷

- সে আমি জানি৷ আর সেটা আমারও নেই ৷ আমি সে শিক্ষাও পাইনি৷ যাক সে কথা৷ লাইসেন্স ছাড়াই তো তোমার ঘরেই আছি৷ তোমার ভাত খাচ্ছি...

- ফাজলামো করিস না, জিনি৷ মাহাতাব একটু ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল৷

জিনিয়া হাসতে হাসতে বলল, সত্যি কথাটার ভেতর ফাজলামো কোথায় দেখলে ।

- তুই বিয়ে করবি কিনা তাই বল৷ ওসব আজে বাজে কথা আমি শুনতে চাইনে৷

জিনিয়া তেমনি তরল ভাবে বলতে লাগল, বেশি সুবিধাটা কী হবে তাই শনি? লাইসেন্স করা একজন সুন্দরী অপ্সরা তোমার ছিল৷ তার লাইসেন্সটা তোমার ড্রয়ারেই রয়ে গেছে৷ সে আকাশের পরী, আকাশেই উড়ে গেছে৷ তুমি তার কী করতে পারলে?
মাহতাব বলল, সব কিছুই পারতাম৷ ইচ্ছে করেই আমি সেদিকে পা বাড়াই নি ৷ ওকে নিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম৷ সে যা চায়, তা দিতে গেলে আমার দুনিয়াটাই একেবারে নিরানন্দে ভরে যেত৷

- আর আমি? জিনিয়া প্রশ্ন করল৷

মাহতাব কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করে বলল, তোর গালে দেব একটা কিল৷ তুই তা জানিস না?

জিনিয়া হেসে বলল, কিল মারো আর যাই করো, কে জানে শেষমেশ তুমি আমাকে নিয়েও আবার হাঁপিয়ে ওঠো কিনা৷

মাহতাব গদগদ কন্ঠে বলল, না রে না, তোকে নিয়ে আমি কোন দিনই হাঁপাব না৷ তুই তো ষড়ঋতুর মতন বৈচিত্রময়ী৷ প্রতি মুহুর্তে রঙ বদলাবি, আর তোকে আমি নানা রূপে উপভোগ করব ৷

- উরিব্বাস৷ তুমি যে ভয়ানক কবি হয়ে উঠলে মাতু ভাই৷ প্রেমে পড়লে মানুষ যেমন কবি হয়, তেমন নয় তা?

- ফাজলামো ছাড়, জিনি৷ হয় তুই আমাকে কথা দিবি, নয়ত না বলে দিবি৷ এই দুই এর এক৷ আমি অন্য কিছু বুঝিনা৷

জিনিয়া তেমনি বাঁকা ঠোটে হেসে বলল, কথা যদি দিতেই হয়, তাও তো ভেবে চিন্তে দিতে হবে? হুট করে তো আর কথা দেয়া যায় না৷ আবার শেষ তক তোমার সেই সুন্দরী রমণীর জন্যে হৃদয় আমার কেমন কেমন করে রে, যদি হয়, তখন? আমি তো সতীন নিয়ে ঘর করতে পারব না৷ তাও যে সে সতীন নয়৷ যাকে বলে প্যারাগন অব বিউটি৷

মাহতাব ক্লান্ত হয়ে বলল, এখন তো তুই নানান কথাই বলবি৷ কিন্তু জানিস, আমি তোর জন্যই ওকে বিদেয় করলাম৷ এখন তো তুই দিল্লাগী করবিই , সে আমি বুঝি রে..

- কী তুমি বোঝ? আমি কেমন করেই বা তোমর সাথে দিল্লাগী করলাম? আগে শখ করে হেটেল মোটেলে ডাকতে , এখন তো তোমার নিজের ঘরেই আছি৷ তখন কত আদর করে সেই যে হেঁড়ে গলায় গাইতে এসো এসো আমার ঘরে এসো... এখন তো আমি সেই তাই- না চাহিতে যাহা পাওয়া যায়৷

মাহতবের মাথায় জিদ চেপেছে ৷ খপ করে জিনিয়ার একটা হাত ধরে বলল, তুই বিয়ে করবি কিনা বল৷

জিনিয়া কঁকিয়ে ওঠার ভান করে বলল, উরিব্বাবারে৷ হাতটা আমার ভাঙ্গল৷ এই হাত ছেড়ে দাও৷ বলছি বলছি, বিয়ে করব, করব৷ হল তো?

মাহতাবের সন্দেহ যায় নি ৷ প্রশ্ন করল, বিয়ে তো করবি, কিন্তু কাকে?

- তোমাকে..... তোমাকে....তোমাকে হল তো? এবার হাত ছাড়৷

মাহতাব জিনিয়ার হাতটা ছেড়ে দিল৷

জিনিয়া বলল, তোমার বোধহয় খিদের কথাও ভুল হয়ে গেছ ৷ কিন্তু আমার যে এখন পেটের ভেতর চোঁ চোঁ করছে ৷ গেন্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এই গেন্দা, খেতে টেতে দিবি, হতচ্ছাড়া?

গেন্দ শশব্যস্ত হয়ে উঠল, অনেক্ষণ আগেই তো দিয়েছি , আপা৷ আপনেরাই তো খাইত্যাছেন না৷ ভাত তরকারী ব্যাকটি ঠাণ্ডা বরফ অইয়া যাইত্যাছে৷

দুজনেই এবার লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল৷

ওরা খেতে বসেছে ঠিক সে সময় কলিং বেলের আওয়াজটি শোনা গেল৷ অসময়ে এই আওয়াজটি শুনে বিরক্তিতে মাহতবের দুটি ভ্রু কুচঁকে উঠল৷

গেন্দা জিজ্ঞাসু মুখে মাহতাবের দিকে তাকাল দড়জা খুলে দেবে কিনা সে জানতে চায়৷


- কে দেখ ৷ ড্রইং রুমে বসতে বল ৷ মাহতাব গেন্দা কে হুকুম করল৷

গেন্দা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন মুজাফফর হোসইন ৷ দিনাজপুর থেকে সোজা তিনি ঢাকায় এসেছেন ৷ মুনীরার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে মনটার ভেতর ছটফট করছিল৷ কাজের চাপে তিনি এতদিন কিছুতেই সময় করে উঠতে পারে নি৷ গতকালই হাতের কাজটি শেষ হয়ে গেছে ৷ আর দেরি না করে রাত্রির কোচেই তিনি উঠে পড়েছিলেন ৷


হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে মুজাফফর ঘরে ঢুকলেন৷ তাঁর পেছনে পেছনে রিকসা ওয়ালা রাজশাহীর ফজলি আমের একটা ঝুড়িও এনে নামিয়ে রেখে গেল৷ ঘরে ঢুকে মুজফফার সারাটা ঘর ভালকরে দেখে নিলেন৷ বোনের বাসায় এই প্রথম আসা ৷ মনে তাই কিছু কৌতুহল জাগছে ৷ ঘরের ডান দিকের মেঝের ওপর চৌকস একটা সুজনি বিছানো রয়েছে ৷ চাদরের ওপর ঠিক মাঝ বারাবর এক জোড়া ডুগি-তবলা ৷ তার পাশে ঝকমকে বার্ণিশ করা একটা হারমোনিয়াম ৷ পুব পুশ্চিম করে পাতা ডিভানটা সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা৷ দেয়ালের পাশে দরজার দিকে মুখ করে রাখা বড়োসড়ো একখানি শোকেস৷ শোকেসের ওপরে সাত-আট ইঞ্চি উঁচু কাঠের একটা নারী-মুর্তি ৷ একেবারে উলঙ্গ দেহে মাথার ওপর আড়া -আড়ি ভাবে হাত রেখে দাড়িয়ে ৷ সেই নারী- মুর্তিটির কাঁধের টের কনুই এর ওপর ভর রেখে আর একটি উঙ্গল মিশমিশে কালো পুরুষ-মুর্তি মুখে আঁড়বাশি নিয়ে দাড়িয়ে আছে শ্রীকৃঞ্চ স্টাইলে ৷ সেদিকে মুজাফফর হোসাইনের চোখ পড়তেই তার মনে হল তিনি কোন ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন৷ এ-ঘর তো মুনীরাদের হতে পারে না৷ বেশ কিছুক্ষন বসে বসে তিনি ভাবতে লাগলেন৷ মনটা তার উশখুশ করতে লাগল৷ মুজাফফর অধীর আগ্রহে এই বাড়ির কর্তা ব্যক্তিটির অপেক্ষা করতে লাগলেন৷


ওদিকে গেন্দা মারফত্ মাহতাবের কাছে মুজাফফর হোসাইনের খবর পৌঁছে গেছে৷ খবর পেয়ে ওরা দুজন ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করেছে ৷ ওরা যে মুহুর্তকাল আগে অসম্ভব ক্ষুধার্ত ছিল৷ এখন সে কথাটি বিলকুল ভুলে গেছে৷


কী করবে স্থির করতে না পেরে মাহতাব একবার গেন্দার দিকে তাকল৷ ওর চোখমুখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে৷ ছোড়াটার প্রতিই অকারন তার সীমাহীন রাগ এই মুহুর্তে চন চন করে উঠেছে৷


ছোঁড়াটা যদি দরজা খুলে না দিত, তাহলে হয়ত এই ঝনঝাটের সম্মূখীন তাকে হতে হত না৷ একটু আগে মাহতাব নিজেই যে ওকে দরজা খুলতে হুকুম দিয়েছিল, এখন সেটাও বেমালুম ভুলে গেছে ৷


অদ্ভুত বিহবলতার মধ্যে মাহতাবের মুহুর্তগুলি তর তর করে কেটে যাচ্ছে ৷
সিদ্ধান্ত স্থির করতে না পারাতেই প্রায় মিনিট পনের সময় অতিবাহিত হয়ে গেল৷


কাউকে সাড়া দিতে না দেখে মুজাফফরের ধারনাটা মজবুত হয়ে গিয়েছিল যে, নিশ্চিত তিনি ভুল বাসায় উঠে এসেছেন৷ বাসার নম্বরটা হয়ত তার কাছে রং নম্বর হয়ে পৌছেছে৷ তাই ভেবে দু মুহুর্ত ইতস্ত করে মুজাফফর একবার উঠতে গেলেন৷ গৃহ কর্তার সাথে দেখা হয়নি ভালই হয়েছে৷ সুতরাং শীঘ্র শীঘ্র ওঠাই ভাল৷


আসন থেকে উঠেই হঠাৎ তার দৃষ্টি পশ্চিমের দেয়ালে৷ এতক্ষন সেদিকে তার নজর পড়ে নি সেদিকে চোখ পড়তেই মুজাফফার আবার ধপাস করে বসে পড়লেন৷ না, বসার ব্যাপারে তার ভুল হয়নি৷ ওই তো দেয়ালে মুনীরা মাহতাবের ফটো ঝুলছে৷ ঠিক এই মুহুর্তে মনে পড়ল, মুজাফফর এই ঘরে ঢোকার আগে দরজার মাহতাবের নাম ও ডেজিগনেশন সহ একটি নেম প্লেটও দেখে ছিলেন৷ কী আশ্চর্য ঘরের ভেতরটায় চোখ পড়ে তাও বিলকুল ভুল হয়ে গিয়েছিল!


মুজাফফর এবার নিশ্চিত হয়ে ডাক দিলেন, মনি!

হল ঘরের মধ্যে একটা প্রতিধ্বনির মতন শব্দ উঠল নি... ৷ কিন্তু কেউ সাড়া দিল না৷

আবার ডাকলেন, মাহতাব?

ঠিক তেমনি আবার যেন একটা শব্দ শুলেন আ... ব...৷ কিন্তু কারুর কোন সাড়া শব্দ নেই৷

বিস্মিত মুজাফফরের কাছে গোটা পরিবেশটাই ভুতুরে হয়ে উঠল৷ অথচ একটু আগে একটি বেটে খাটো গোলগাল ছেলে ঘর খুলে দিয়ে গেছে ৷ তারও এখন পাত্তা নাই৷ আবার তিনি পশ্চিমের দেয়ালের দিকে তাকালেন, সেখানে মুনীরা মাহতাবের এনলার্জড ফটোটি অগের মতই ঝুলছে৷


মুজাফফর হোসাইন কী করবেন ভাবছেন। ঠিক এমনি সময়ে মাহতাব এসে সামনে দাঁড়ালো। মাহতাবের চোখে মুখে দারুণ বিরক্তির চিহ্ন বিরাজ করছে। সে যেন মুজাফফরকে চেনেই না এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল, কী চান, বলুন।


মাহতাবের মুখের কথাটি উচ্চারিত হতেই মুজাফফর একেবারে হতচকিতে হয়ে উঠলেন৷ জীবনে কখনো এমন ধরনের বিষ্ময় এর ঘোরে তিনি পড়েন নি৷ বিমূঢ়ের মত বলে উঠলেন এ কী বলছ তুমি মাহতাব?


মাহতাব আত্মরক্ষার জন্যে প্রষ্তুতি নিয়েই এসেছিল ৷ তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল ঠিকই বলছি৷ এ ছাড়া আমি আর কী বলব? আমার কিছুই বলার নেই৷


মুজফফর হোসাইন মাহতাবের দ্বিতীয় উক্তি শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন৷ তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন ? মাহতাবের কী এমন ব্যাপার হতে পারে?
নাকি মাহতাব পাগল হয়ে গেছে ? মুজাফফর নিজেকে সংযত করে শান্ত কন্ঠে বললেন৷ মনি কোথায় ? মনিকে ডাক৷


মাহতাবের ধারনা মুনীরার ব্যাপারে সব কিছু জেনে শুনেই মুজাফফর তাকে শাসন করতে এসেছেন৷ তাই সে রাগের চোটে ঘাড় বেকিয়ে দাড়িয়ে রইল৷ মুজাফফরের কথায় কোন উত্তর দিলনা ৷


মুজাফফর অবার জিজ্ঞেস করলেন, মনি কোথায়, বলছ না কেন?

- সে কোথায় সেটা আপনিই ভাল জানেন৷

- মানে? মুজাফফরের চোখের ভ্রু কুঁচকে উঠল, কী সব তুমি বলছ, মাহতাব?

মাহাতাব আবার লা-জাবাব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

মুজাফফর অধীর হয়ে প্রশ্ন করলেন কেন, মনি এখানে নেই?

- না৷ মাহতাব তাচ্ছিল্যের সাথেই জবাব দিল৷

- নেই? কী বলছ? সে এখানে নেই? মুজাফফরের কন্ঠস্বর উদ্বেগাকুল হয়ে উঠল৷

- বললাম তো, নেই৷ মাহতাব তিক্ত কন্ঠে আবার উত্তর দিল ৷

মুজাফফরের কন্ঠস্বর এবার উচ্চগ্রামে উঠল, তাহলে সে গেছে কোথায়?

- জানিনে৷ মাহতাবের ঝাড়া জবাব৷

মুজাফফরের সারাটা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠল৷ জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মূখীন আর তাঁকে কোনদিনই হতে হয়নি৷ তিনি আসন থেকে ঝাঁ করে উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর আকষ্মাৎ ভীষণ চিত্কারে ফেটে পড়লেন, জানো না মানে? হোয়াট ডু ইউ সে? এই, জানো না মানে কী?


এবার মাহতাবের চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ইউ ষ্কাউণ্ডেল৷ জানো না মানেটা কী? ভীষন রাগে মুজাফফরের সমস্ত শরীর এখন থর থর করে কাঁপছে ৷ তিনি বলতে লাগলেন, জানো না? সে কোথায় গেছে, জানো না? দাঁড়াও তোমাকে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি ৷ তুমি আমাকে চেনো? তোমার আমি কী করতে পারি সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারো? আনগ্রেটফুল! ইউ কেম টু মী লাইক এ লিকিং বীচ৷ সেদিন তোর মুখে আমি লাথি না মেরে তোকে সিংহাসনে বসিয়েছিলাম৷ ছোট লোক ৷ তুই আমার সে করুণাকে দূর্বলতা মনে করেছিলি, তাই না? ভেবেছিস আমি তোকে এমনিতেই রেহাই দেব ৷ নো নো নো ৷ মুজাফফর হোসাইন সহসা রাগে-দুঃখে একেবারে উম্মাদ হয়ে উঠলেন ৷ চীত্কার করে বলতে লাগলেন, আমার বোনকে তুই কী করেছিস? এই খুন করেছিস? তুই খুনী মার্ডারার? ওয়েট৷ আই শ্যাল সি ইউ, ওয়েট ৷


মুজাফফরের এই আকষ্মিক ব্যবহারে মাহতাব ভয় পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে ৷
জিনিয়াও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে মাহতাবের পাশে এসে দাড়িয়েছে ৷ ওর ভয় হয়েছে এই ক্রোধান্ধ মানুষটি হঠাৎ না জানি কী না কী করে বসে৷


জিনিয়াকে দেখে মুজাফফর হোসাইন বলে উঠলে, এই, তুমি কে? আমার মুনীরার খবর তুমি জানো?

জিনিয়া কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিল, মুনীরা ভাবী চলে গেছে৷

- চলে গেছে? কবে?

- দিন পনের হবে৷

- কোথায় গেছে?

- তা জানিনে৷

মুজাফফর এবার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কেন গেল? এমনি-এমনি তো চলে যাবার মানুষ সে নয়? আমি তো তেমন করে তাকে গড়ে তুলি নি ৷ সে কিছুতেই যেতে পারে না ৷ এই ষ্কাউণ্ডেল আমার বোনকে হত্যা করেছে ৷ এই, সত্যি করে বল, কী করেছিস? সত্যি করে বল ৷

মুজাফফর মাহতাবের চোখে চোখ রেখে তাকালেন ৷

মাহতাবের মুখে এখন আর একটি কথাও ফুটছে না৷ সে যেন অকষ্মাৎ পাথরের মূর্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে ৷ একটু আগেও মাহতাব ধারণা করেছিল, কিছু একটা চোট পাট দেখালেই হয়ত মুজাফফর ঘাবড়ে যাবেন ৷ কিন্তু এখন হিতে বিপরীত হয়ে গেছে ৷ হত্যার অভিযোগ এনে মুজাফফর মাহতাবকে ভীত করে তুলেছেন ৷


দুমুহুর্ত স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে মুজাফফর বললেন, বুঝতে পেরেছি, তোর জবাব দেবার শক্তি নেই৷ ঠিক আছে, আজ আমি যাচ্ছি৷ তোর বত্রিশ নাড়ীর টান মেরে যদি বার না করি, তাহলে জানবি আমি বাপের ছেলে নই ৷ বলেই তিনি সেই মুহুর্তে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ৷


হতবুদ্ধি জিনিয়া ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলল, এই গেন্দা, দেখ তো এগুলি কী রেখে গেল এক দৌড়ে দিয়ে আয়৷


গেন্দা আমের ঝুরি আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে করে পেছনে পেছনে ছুটে গেল ৷ নির্বাক মাহতাব পাথরের মতন নিশ্চল দাড়িয়ে রইল৷




সারাটা পথ মুজাফফরের যে ভাবে কেটেছে, তা ভাবতে গিয়ে তার নিজের শরীরই এখন অবশ হয়ে আসছে৷ এই রকম অবাঞ্ছিত ঘটনার মুখোমুখ তাকে কখনোই হতে হয়নি৷ মুজাফফর যে পরিবেশে বড়ো হয়েছেন, সেখানে তিনি চিরদিন পবিত্রমনা ও উন্নত চরিত্রের মানুষের আনাগোনা দেখেছেন৷ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এখন অবশ্য বিচিত্র ধরনের মানুষের সাথে তার দেখা শোনা হয়, কিন্তু কারুর কোন ব্যবহারের প্রতি মুজাফফর গভীরভাবে দৃষ্টি দেবার অবসর পান না৷ ঐ সব মানুষকে সাধারণত তিনি এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন ৷


কিন্তু মাহতাবের ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ৷ তার সাথে মুজাফফরের আত্নীয়তার সম্পর্ক হয়েছিল ৷ মাহতাবকে অন্তর দিয়ে তিনি ভালও বেসেছিলেন৷ মুজাফফরের সেই ভালবাসা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ৷ সেই ভালবাসার পাত্র আজ তার সাথে এ কী ব্যবহার করল? মানুষ এতদূর নীচে নামতে পারে? একদিন এই মাহতাবই বিনয়ে বিগলিত হয়ে মুজাফফরের কাছে আত্নসমর্পণ করেছিল৷ সেই মানুষই আজ এই রকম অকল্পনীয় ঔদ্বত্য দেখাতে পারল?


আজ মনে হচ্ছে মুজাফফর সেদিন বড় রকমের একটা ভুল করে ফেলেছিলেন৷ মাহতাবের মেধা ও শিক্ষা দেখে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ ধারণা করেছিলেন মেধাবী মাহতাবকে সামান্য তদ্বিরেই তিনি ইচ্ছে মতন গড়ে নিতে পারবেন৷ এদেশের উচ্চশিক্ষার মধ্যে সত্যিকারের শিক্ষা নেই বলেই মজাফফরের বদ্বমূল ধারণা ৷ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সম্মানজনক ডিগ্রী লাভের পর মুজাফফরের অনেক সতীর্থকে তিনি ঘুষ খেতে দেখেছেন ৷ ভাগ্য গড়ার হীন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে অনেকেই জাতীয় সম্পদের অপচয় করছে ৷ তাদের অপকর্মের ফলশ্রুতি স্বরুপ রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, আর বড় বড় কল কারখানা, ইমারত বিল্ডিং হর হামেশা ধ্বসে পড়ছে ৷ উচ্চ শিক্ষা লাভের পরেও এরকম ভাবেই তাদের চরিত্র গড়ে ওঠে। এখানে শিক্ষার সাথে চরিত্র গঠনের নেই কোন বন্দোবস্ত ৷ মুজাফফর মনে করেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে হিংস্র শার্দুল তৈরীর ট্রেনিং দেয়া হচেছ, মানুষ গড়ার নয় ৷ ফলে যা হবার তাই হচ্ছে৷ গোটা দেশ ঐ সব তথাকথিত শিক্ষিতদের হান্টিং গ্রাউন্ডে পরিনত হয়েছে ৷ মুজাফফর এসব শিক্ষিত মানুষদের করুণার পাত্র বলে মনে করেন৷


মাহতাব কে নির্বাচন করতে গিয়ে যে ভুলটি তিনি করেছিলেন৷ এই মুহুর্তে সেটিও যেন তার চোখে স্পষ্ট হয়েই ধরা পড়েছে ৷ সে ছিল পিতৃমাতৃহীন একজন গরীব যুবক ৷ মাতৃকুলের দু'একজন আত্মীয় ছাড়া পিতৃকূলের পরিচয় দেওয়ার মতন কেউ তার ছিলনা ৷ বাল্যকালে মামার বাড়িতে সে মানুষ হয়৷ মেধার কারনেই সে উচ্চ শিক্ষা লাভে সক্ষম হয় ৷ মুজাফফরের ধারনা ছিল এরকম গরীব ও মেধাবী ছেলের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তিটা হয়ত মজবুত হবে ৷ দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনে যাদের জীবন গড়ে ওঠে, তাদের মধ্যে নীতি-নিষ্ঠার অস্তিত্ব আশা করা যায় ৷ এরকম একটা ধারনা তার বরাবর ছিল ৷ কিন্তু মাহতাবের সাথে মুনীরার বিয়ে দেবার পর তিনি স্পষ্টবুঝতে পারলেন, তার ধারনাটা মোটেই নির্ভুল নয়৷ তবু আশা ছাড়েন নি৷ ভেবেছিলেন, মুনীরা তার চরিত্র-সুষমা দিয়ে মাহতাবের মধ্যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে৷ সে আশাও তার অবশেষে ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল৷ মাহতাব যে এই রকম ব্যবহার করবে, মুজফফর তা কষ্মিনকালেও কল্পনা করতে পারেন নি ৷ মাহতাবের আচরণ মনে করতে গিয়ে মুজাফফরের কলিজাটা জ্বলে যেতে লাগল৷ একটা নর-পশুর হিংস্র মূর্তি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই রাগে দাঁতে দাঁত চেপে তিনি অস্ফুটে বলে উঠলেন, ষ্কাউন্ডেল! কথাটা আবার উচ্চারণ করতে গিয়ে তিনি নিজেই আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন এই শব্দটি অতীত জীবনে আর কবে উচ্চারণ করেছেন, সে কথা এখন তিনি মোটেই ষ্মরণ করতে পারছেন না ৷ দুঃখে-শোকে তাঁর চোখ দুটি জ্বালা করে উঠল৷


বাসায় পৌঁছে সদর দরজার কড়া নাড়তে গিয়ে মুজাফফর হোসাইন একবার চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন৷ আসমাকে তিনি কী জবাব দেবেন? আসমা বেগম মুনীরাকে দেখতে যাওয়ার জন্যে বারবার করে বলে দিয়েছিলেন ৷ কী করে বলবেন যে, তিনি মুনীরাকে দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু দেখা তার পাননি৷


অবশেষে দরজার কড়া তাকে নাড়তেই হল৷ দরজা খুলে দিল খসরু৷
আব্বাকে দেখে খুশীতে ওর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ৷ আব্বার হাত থেকে সে ঝুড়ি ও মিষ্টির প্যাকেট নিতে গেল৷ মুজাফফর বলল, তুমি মিষ্টির প্যাকেটটা নাও, ঝুড়িটা ভারি হবে, ওটা আমি নিচ্ছি ৷ মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খসরু বলল, আব্বা, ফুপু আম্মা এসেছেন ৷


- আঁ, এসেছে? মনি এসেছে? হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত খবরটি শুনে মুজাফফর খুশীতে বিহবল হয়ে উঠলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, কবে এসেছে মনি?

- অনেক দিনই তো হল৷

- অনেক দিন! খুশী ও বিষ্ময় মেশানো গলায় আবার প্রশ্ন করলেন মজাফফর ৷

- তা দিন দশেক হল এসেছ ৷ বলতে বলতে আসমা বেগম সামনে এসে দাঁড়ালেন ৷ রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো?

- না৷ মনি কোথায়?

- ওই ঘরে শুয়ে আছে৷

- এখন অসময়ে শুয়ে কেন?

- এমনি শুয়ে আছে৷ খুব ভোরে উঠেছে৷ নামাযের পর পড়াশুনা নিয়ে বসেছিল৷ বোধকরি পড়তে পড়তেই ওর ঘুম এসে গেছে ৷ ডেকে দেব নাকি?

মুজাফফর বললেন, না থাক৷ ডাকার দরকার নেই ৷ বিশ্রাম করছে করুক ৷

বলতে বলতে তিনি তাঁর নিজের বেডরুমে এসে ঢুকলেন৷ বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ে প্রশ্ন করলেন, মনি এলো কার সাথে? একলা?

- একলা কেন হবে? ওর এক বান্ধবীর সাথে এসেছে ৷ তাকে তো তুমি চিনতে পারবে ৷ আহসান সাহেবর কথা তোমার মনে আছে?

- কোন আহসান সাহেব?

- এখানে কোর্টে হাকিম ছিলেন ৷ ভদ্রোলোকের যশোরে বাড়ি ৷

- হ্যাঁ হ্যাঁ ৷ মনে থাকবে না কেন?

- তাঁর এক মেয়ে ছিল হাসিনা, তার কথা মনে আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের মনির সমবয়সী৷ আমরা তাকে হাসি বলে ডাকতাম৷

- সেই হাসির সাথেই এসেছি৷

- তাই নাকি? তাকে কোথায় পেল মনি? হাসি ঢাকায় থাকে নাকি?

- না, থাকে ভেড়ামারায় ওর হাজবেণ্ডও ইনজিনিয়ার ৷ তোমাদের ওয়াপদাতেই কাজ করে ৷ হাসির শ্বশুর বাড়ি ঢাকায়৷
মুজাফফর প্রসঙ্গটিকে আর দীর্ঘায়িত করলেন না৷ পায়ের জুতো মোজা খুলে সেগুলি যথাস্থানে রাখলেন৷ তারপর গায়ের জামা কাপড় খুলে আলনায় রেখে বললেন, চল মনিকে দেখে আসি৷

মুনীরার ঘরে ঢুকে দেখলেন, বালিশে কাত হয়ে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে রয়েছে৷ মাথার চুলগুলি আলু থালূ হয়ে গালে, মুখে, কপালে লেপটে আছে ৷ মুখখানির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে নিদারুণ ক্লান্তির ছাপ ৷ ওকে বেশ রোগা রোগা লাগছে দেখতে ৷

মুজাফফর আস্তে করে মুনীরার পাশে গিয়ে বসলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে ডাকলেন , মনি, মনিরে!

সে ডাকে মুনীরার ঘুম ভাঙ্গল না৷ মুজাফফর এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকালেন৷

সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে আসমা বেগম বললেন, ফজরের নামাযের পরও কোআন শরীফ নিয়ে পড়তে বসে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ রকম করে ঘুমিয়ে পড়ে ৷ ওর শরীরটা বোধহয় ভাল যাচ্ছে না৷ আমিও সেই জন্যে ডাকাডকি করিনি৷ ওর যখন ভাল লাগে ওঠে৷

মুজাফফরের চেহারা খানি মলিন হয়ে উঠল৷ মুনীরার শারীরিক অবস্থাটা জানতে না পারলে তার মনে স্বস্তি আসছে না৷ ওর মাথায় আস্তে করে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে আবার তিনি ডাকলেন, মনি রে৷

মুজাফফরের কথা কানে যেতেই মুনীরা প্রথমে চোখ মেলে তাকাল৷ তারপর ভাইকে দেখেই বিস্মিত হয়ে বলল, ভাইজান! বলেই সে ধড়মড়িয়ে উঠতে গেল৷

মুজাফফর বাধা দিয়ে বললেন, উঠতে হবে না, শুয়ে থাক ৷ শুয়ে শুয়ে আমার সাথে কথা বল ৷ বলে ধীরে ধীরে বোনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন ৷

ভাই এর স্নেহ স্পর্শে মুনীরা চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল ৷ মনটি তার ভীষণ ভাবে শংকিত হয়ে উঠেছে ৷ ভয়ে সে এতটুকু হয়ে গেছে ৷

আসমা বেগম বললেন , মনি শুয়ে আছে, শুয়ে থাক৷ তুমি হাত মুখ ধয়ে নাও ৷ আমি চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়েছি৷ নাশতা তৈরী আছে ৷ সব কিছু এক্ষুণি রেডি হয়ে যাবে ৷

মুজাফফর সে কথায় খেয়াল না দিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকলেন ৷ বাথরুমের দরজা বন্ধ করতেই তার বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠল৷ এতক্ষণ উম্মূক্ত জায়গাতেই তার দম আটকে আসছিল, অথচ এই রুদ্ব দ্বার কক্ষটির ভেতরে ঢুকে তিনি স্বস্তি লাভ করলেন৷ কলের পানির সাথে আপন চোখের পানি মিশিয়ে দিয়ে বুকখানি তিনি হালকা করে নিলেন ৷




খেতে বসে মুজাফফর কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলেন৷ আসমা বেগম সামনেই বসে আছেন৷ স্বামীর পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, মাহতাব ওর সাথে এলো না৷ ব্যাপারটা আমার যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে৷ ওর কি কাজের এতই চাপ ? আর কাজ যতই থাকুক, মনিকে রেখে যাওয়াটা কি একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল নাকি?


মুজাফফর হোসাইন ভালো মন্দ কোন কথা না বলে, যেন শুনতেই পান নি তেমনি ভাব দিখিয়ে খেতে লাগলেন ৷


আসমা বেগম বললেন, আর বুজবই বা কী? মাহতাবের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই মনি তো ওর খুবই তারিফ করল ৷ মনে হয় মাহতাব আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে ৷ মনিকে আদর যত্নও করে৷ ওর কথাও শোনে৷ শুনবে না? আমি তোমাকে বলি নি?


মুজাফফর শুধু একবার মুখ তুলে ষ্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন৷ তারপর দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন৷ আসমা বেগমের কথার কোনই উত্তর দিলেন না৷ আসমা বেগম বললেন, ঢাকা হয়ে এলেই পারতে?

- তাতে কী লাভ হত? এতক্ষণে মুজাফফর ষ্ত্রীর কথার জবাব দিলেন৷

- ওমা, সে কি কথা গো? লাভ লোকসানের কথা বলছ কেন? সে হচ্ছে তোমার ভগ্নিপতি ৷ তাকে দেখে আসবে , তার জন্যে লাভ লোকসানের হিসেব করতে হবে নাকি?

- মুজাফফর আসমার কথায় ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন৷ কিন্তু মনের উষ্মা তিনি মনের মধ্যেই চেপে রাখলেন৷

-

মাহতাবের প্রতি আগের থেকেই মুজাফফর কিছুটা অপ্রসন্ন, সেটা আসমা বেগমের জানা ছিল৷ বিশেষ করে মাহতাব ঠিকমত নামায পড়ে না৷ চাকুরীতেও খুব তাকে পরিচ্ছ্নি থাকতে দেখা যায় নি । ঘুষ খাওয়ার দিকে তার লোভ আছে ৷ মনিকে সেটা সে খোলাখুলি ভাবেই বলেছে ৷ মুজাফফর ধরেই নিয়েছেন, যে লোক আল্লাকে ফাঁকি দিতে ভয় করে না, সে লোক মানুষের সাথে প্রতারণা করবে তাতে আর আশ্চ্যর্যের কি? জানতে পেরেই তিনে অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিলেন ৷ সে সময় আসমা তাকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মাহতাবের রোগটি সাময়িক৷ সময় এলেই সেরে যাবে৷ সেই আশ্বাসে স্বামীকে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেননি, সেটাও তাঁর জানা ছিল৷ আসমা বেগম সেই কথাটিরই প্রতিধ্বনি করে বললেন, মনির কাছে মাহতাবের কথা শুনে আমার তো ভালই লাগল৷ যেটুকু দুর্বলতা আছে, সেটুকুও সেরে যাবে তুমি দেখে নিও৷ সব মানুষই তো আর এক রকম হয় না৷ কেউ তাড়াতাড়ি সারে, কারুর বা একটু দেরি লাগে৷


মুজাফফরের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এসে বেতের চোয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন৷ আসমা বেগম চীনে মাটির দুগ্ধ ধবল টী পট থেকে পেট মোটা একটা কাপে এক কাপ হালকা খয়েরী রঙের চা ঢেলে দিলেন৷ চায়ের গন্ধে ঘরটি সুরভিত হয়ে উঠল৷ মুজাফফর কাপের হাতলে আঙ্গুল ঢুকাতে গিয়ে বললেন, মনি মাহতাবের প্রশংসা করেছে না কী যেন বললে?


আসমা বেগম উত্ফুল্ল হয়ে উঠলেন৷ বললেন, তোমার বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না ৷

মুজাফফর হোসাইনের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল বললেন, বিশ্বাস আবার হবে না কেন? খুব হচ্ছে ৷

- তবে?

মাজাফফর চায়ের কাপটা পিরিচের উপর নামিয়ে রেখ আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকালেন৷ তারপর এক মুহুর্ত বিলম্ব করে বললেন, তবেটা মনির কাছেই শুনো ৷ সেই তোমাকে সব কিছু ভাল ভাবে বলতে পারবে৷

আসমা বেগম চাঞ্চল হয়ে উঠলেন ৷ প্রশ্ন করলেন, সত্যি সত্যি কী হয়েছে গো? মনি কি কিছু দোষ ঘাট করে চলে এসেছে নাকি?
মুজাফফর বললেন, সেটাও জানতে হবে ৷ তবে বুঝে শুনে ইচেছ করে সে তা করবে বলে মনে হয় না৷

- তাহলে? আসমা বেগম বিহবল দৃষ্টি মেলে স্বামীর দিকে তাকালেন৷

মুজাফফর হোসাইন চেয়ারে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে বললেন, মনি কি উঠেছে?

- হ্যাঁ, ওকে হাত-মুখ ধুয়ে নাশাতা করতে বলে এসেছি৷

- নাশতা সেরে আসাক, প্রথমে তার কাছেই শোনো, আমি যা জানি তাও তোমাকে বলব৷

আসমা বেগমের মনে দুশ্চিন্তার ঝড় উঠে গেল৷ কিন্তু তবু জিদ করে তিনি আর কিছু জানতে চাইলেন না অন্তরে প্রবল অস্থিরতা নিয়ে চুপ করে গেলেন।

মুনীরার নাশতা সারা হলে আসমা বেগম তার কছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মনি, মাহতাবের সাথে তোর সত্যি সত্যি কোন কিছু নিয়ে মন কষাকষি হয় নি তো?

ভাবীর মুখের প্রশ্নটি শুনে মুনীরা চমকে উঠল ৷ কিন্তু মুহুর্তেই সে হতচকিত ভাবটি সামলে নিয়ে বলল, হঠাৎ করে এ প্রশ্ন কেন, ভাবী?

- আমাকে তুই ঠিক ঠাক বল না রে! কী জানি, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোদের মধ্যি মনোমালিন্য ঘটেছে৷

মুনীরা বলল, সন্দেহের কারণটা কী?

আসমা বেগম এই প্রশ্নের কী জবাব দিবেন, মুহুর্তকাল তা চিন্তা করে দেখলেন৷ তারপর বললেন, তুই যখন হাসির সাথে এলি, তখনই মনে খটকা লেগেছিল মনি এলো, মাহতাব এলা না৷ এমনটি হওয়ার কথা নয়৷ শেষমেশ হাসির কথা শুনে বিশ্বাসও হল, হতেও পারে৷ কাজের ঝামেলায় হয়ত মাহাতব আসতে পারেনি৷ এ দিকে তোর যাওয়াও তো ঢের দিন হল৷ খসরুর আব্বা যাব যাব করে আর যেতে পারে নি৷ মনটা খারাপ করেছে ভেবে মাহতাব হয়ত হাসিকে পেয়ে তার সাথেই পাঠিয়ে দিয়েছে৷ এখন তোর ভাই এর কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে, কী যেন একটা ঘটেছে৷ কিন্তু সেও দেখছি স্পষ্ট করে কিছু বলছে না৷


মুনীরা বিহবল কন্ঠে প্রশ্ন করল, ভাইজান কি কিছু বলেছেন?

- না, বলছে না কিছুই৷ আর সেটাই তো হয়েছে সমস্যা ৷ সেও বলছে তোকে শুধোতে ৷ আমি খুব জিদ করি নি ৷ ভাবলাম তোকেই শুধাই ৷ মুনীরা ভাবীর কথা শুনে চুপ করে রইল! তারপর মুহুর্ত কাল তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান তোমাকে কী বলেছে, আগে তাই বল৷

- উঁহু, কিছুই বলে নি৷

- তাহলে যে আমাকে এসব তুমি শুধাচ্ছ?

- কী জানি রে, তোর ভাইকে দেখলাম , মাহতাবের ওপর কেমন যেন চটা চটা ভাব, মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না৷ মনের মধ্যে নিয়েই ছটফট করছে ৷ মাহতাব আবার কোন খারাপ কথা- টথা বলে চিঠি-ফিটি দিয়েছে নাকি কে জানে৷
আসমা বেগম ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, আমি ওর কাছে জানতে চাইলে, ও আবার তোর কাছেই শুনতে বলল্ আমার হয়েছে ল্যাঠা৷ বল তো এখন কী করি?

মুনীরা কোন কিছু জাবাব দিতে না পেরে চুপ করে রইল৷

মুনীরার ভয় ও আশংকা দুইই ছিল৷ মুজাফফর তার এই ভাবে চলে আসার ব্যাপারটা জানতে পারলে কী মনে করবেন, সেটা অনুমান করাও তার সাধ্যের অতীত ৷ ভয়ে মুনীরা একেবারে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল৷ কিন্তু ভাইজানের একটি ব্যবহারে মুনীরার দুশ্চিন্তার কালো মেঘটা বেশ খানিক অপসারিত হয়ে গিয়েছিল৷ ভাইজান এসেই প্রথমে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন ৷ ঘটনাটি হয়ত তাঁর জানা নেই৷ জানলে তিনি সেটাকে কী ভাবে গ্রহন করবেন, মুনীরা তার কিছুই অনুমান করতে পারছে না৷ আর মাহতাব যদি তাকে চিঠি দিয়ে কোন কিছু জানিয়েই থাকে, তাহলে ঘরে ঢুকে মুনীরাকে দেখেই ভাইজানের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা৷ তিনি তাও হন নি৷ সম্পূর্ণ ব্যাপারটি মুনীরার কাছেও একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে৷


মুনীরাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসমা বেগম বললেন, কী হয়েছে সত্যি সত্যি বল না, ভাই!

মুনীরা তেমনি বোবা দৃষ্টি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে ভাবীর দিকে তাকাতে লাগল৷ তার মুখে একটিও কথা ফুটল না৷ চোখ দুটি শুধু টলটলে হয়ে উঠল৷

আসমা বেগম ওর চোখ দেখেই আঁচ করে ফেললেন৷ বললেন, মাহতাব কি তোকে মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে?
মুনীরা ধরা গলায় বলল, না৷

- তাহলে? আসমা বেগমের কন্ঠটি উদ্বেগে কেঁপে গেল৷

মুনীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি নিজেই চলে এসেছি৷

- তুই নিজেই চলে এসেছিস! বলিস কী? আসমা বেগম অবাক হয়ে গেলেন৷ এবার তার কন্ঠে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল৷
বললেন, তুই এই ভাবে তোর ভাই এর উঁচু মাথা মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছিস? এরই জন্যে কি তোকে আমরা বুকের মধ্যে করে মানুষ করেছিলাম? আসমা বেগম রাগে দুখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন৷

মুনীরা ভয়ে বিবর্ণ মুখে নীরব হয়ে রইল৷

আসমা বেগম ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভীষন চিত্কার করতে লাগলেন৷

মুহুর্তে তার ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে গেছে৷ তিনি চিত্কার করে বলতে লাগলেন, একটি সম্ভ্রান্তঘরের মেয়ে তুই৷ কত আদর--যত্নে--সুশিক্ষায় তোকে আমরা বুকে করে মানুষ করে তুলেছিলাম৷ লোকের কাছে মুখ হাসানোর জন্যই এসব করেছিলাম বলে তুই মনে করেছিস, তাই না?

কাল নাগিনী! তোর মতন মানুষ কে আমি দুধ কলা খাইয়ে মানুষ করেছিলাম কি এই ছোবল দেবার জন্যে? ঐ মুখ নিয়ে তুই কেন এখানে এসেছিস ? কেন? মরতে পারিস নি? হতভাগিনী, জবাব দিচ্ছিস নি ক্যান?

আসমা বেগমের মুখে এই ধরনের রূঢ় কথা মুনীরা জীবনেও কোনদিন শোনে নি৷ মায়ের কথা তার মনে পড়ে না৷ জন্মের পর ভাবীর কোলে বুকেই সে মানুষ হয়েছে ৷ মাতৃ স্নেহের অনাবিল ধারায় আসমা বেগম চিরদিনই মুনীরাকে আপ্লুত করে রেখেছিলেন৷ একটি দিনের তরেও তিনি মুনীরাকে রাগ করে কোন মন্দ কথা বলেন নি৷ আজ তার মুখের এই গালি শুনে মুনীরা স্তম্বিত ও কিংর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ল৷


আসমা বেগম মুনীরাকে নিরুত্তর দেখে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন৷ বলতে লাগলেন, স্বামীকে যদি পছন্দ না হয়ে থাকে, তাহলে আরো পথ খোলা ছিল, সেই পথ খুজে নিলেই পারতিস? তুই এই লোকটার উচু মাথা নিচু করবার জন্যে কেন, এখানে উঠে এসেছিস? কেন, কেন? আসমা বেগম উন্মাদিনীর মতন চিত্কার করতে লাগলেন৷


মুজাফফর আসমা বেগম কে বললেন , ওকে অমন করে বোক না বেগম৷ আসমা বেগম হাউ মাউ করে ডুকরে উঠে বললেন, বকবনা? ওর মুখেই শোনো ৷ ওই শয়তান টা নাকি নিজেই স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ শোনো, আমার যে মাথা খুড়তে ইচ্ছে করছে গো৷

মুজাফফর গম্ভীর গলায় বললেন, ওকে গাল-মন্দ করো না৷ ও ঠিকই করেছে ৷

আসমা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ঠিক করেছে? বল কী তুমি ? ঠিক করেছে?

- হ্যাঁ, ঠিক করেছে ৷ আমার বোন যে ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না, সে বিশ্বাস আমার আছে ৷ তুমি ওকে আর বকা বকি করো না৷

ভাই-এর মুখের শেষ কথাটি উচ্চারিত হতে না হতেই সাহসা মুনীরার মুর্ছিত হয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল৷ আসমা বেগম তাড়াতাড়ি ওর মাথাটি বুকের কাছে তুলে ধরে চিত্কার করে কেঁদে উঠলেন, ওগো, ফিট লেগে গেছে গো৷

মুজাফফর হোসাইন তাড়াতাড়ি বালতি করে পানি এনে মাথায় ধারা দিতে লাগলেন৷ আসমা বেগমের চোখ থেকে অনবরত অশ্রু-ধারা গড়িয়ে পড়ে মুনীরার মুখ বুক ভিজে যেতে লাগল! তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন মুখখানা যে সাদা হয়ে গেছে, আমার কী হবে গো?

মুজাফফর দৃঢ় কন্ঠে বললেন, অস্থি হয়ো না, মুর্ছা গেছে ৷ এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে৷

=================================================


মুনীরা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে, দুপুরের দিকে মুজাফফর হোসাইন ও আসমা বেগম তার কাছ থেকে ঘটনাটি জানবার জন্যে আলাপ শুরু করলেন ৷

আসমা বেগম ও মুনীরা খাটের ওপর বসে৷ মুজাফফর একটি বেতের চেয়ার নিয়ে ওদের সম্মুখে বসে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?

মুনীরা থেমে থেমে ক্লান্ত কন্ঠে বলতে লাগল, আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি যে, আমাকে সে হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে ৷ কোন আশ্চর্য জিনিস দেখানোর নাম করে মাঝে- মধ্যে ও আমাকে সিনেমায় থিয়েটারে নিয়ে যেত৷ ভয়ে আমি আপত্তি করতাম না৷ মাঝে মাঝে ভাবতাম, ভাইজানকে চিঠি দিয়ে জানাব৷ পরক্ষণে মনে হত, ভাইজান হয়ত ওর ওপর ভয়ানক অসন্তুষ্ট হবেন৷ তার ফলে ও হয়ত আরো বিগঢ়েই যাবে৷ তাই ভেবে আমি আপনাদের জানাই নি৷ বলেই মুনীরা একটু থামল৷


আসমা বেগম শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলেন, হোটেলে কেন নিয়ে যাবে?

মুজাফফর তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, আগে ঘটনাটি শুনে নাও, তারপর কেন নিয়ে যাবে, শুনতে চেয়ো৷ বলেই মুনীরার মুখের দিকে তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন৷

মুনীরা বলতে লাগল, শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই হোটেলে নিয়ে সে হাজির করল৷ গিয়ে দেখি, অদ্ভুত সব পোষাক আশাক পরা উচ্ছৃঙ্খল নারী পুরুষের ভীড় জমেছে৷ আমি দেখেই বললাম, এখানে আর এক মুহুর্ত আমি থাকব না ৷ ও জিদ করে বসল৷ বলল, থাকতেই হবে৷

আমি বললাম, আমাকে তুমি মেরে ফেল, তাতেও আমি রাজী, কিন্তু এই সব মাতাল পুরুষদের মধ্যে আমি কিছুতেই যাবোনা ৷ ও বলল, তাহা যদি না যাও, তাহলে তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও ৷ আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারব না আমার তখন আর মাথার ঠিক নেই৷ আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছি! তুমি ওদের সাথে মাতলামী করতে চাইলে , যাও৷ সে রাগে আমার গালে, ঠাস করে একটা চড় কষে দিয়ে বলল, এতই যখন সতীপনা, তখন বিয়ে করতে সাধ জেগেছিল কেন?

আমি ওর কথার কোন জবাব দিই নি৷ একজন আধ বয়েসী লোক আমাকে মারতে দেখে বলল, অ নো নো, ডোন্ট স্ন্যাপ অন হার ফেস ৷ বলেই মাতাল লোকটি কী সব বলতে বলতে আমার দিকে হাত বাড়াল ৷ আমি ভয়ে চিত্কার করে উঠলাম৷ এই ব্যাপারটা দেখে ওর বোধহয় চৈতন্যোদয় হল! তারপর আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো৷

মুজাফফর ও আসমা মুনীরার কথা শুনতে গিয়ে কেমন যেন অবশ হয়ে পড়েছিল৷ দুজনই বিষ্ময়-বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন৷
মুনীরা চাবুকের ঘা দেওয়ার মতন বলে উঠল, এই জন্যে তুমি আমাকে বুকে করে মানুষ করেছিলে, ভাবী? একজন বেশ্যা বানানোর জন্যেই ... হু হু করে সে ডুকরে উঠল৷

আসমা বেগম মুনীরার কান্নার সাথে যোগ দিয়ে নিজেও কেঁদে উঠলেন৷

মুজাফফর একেবার পাথর হয়ে গেছেন৷ তাঁর চোখের পলকও আর পড়ছে না৷

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে গেল

মুজাফফর প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলে একসময় জিজ্ঞেস করলেন, তোকে আমি দুখানা চিঠি দিয়েছিলাম ৷ কিন্তু তুই কোন উত্তর দিসনি কেন?

মুনীরা চোখ মুছে বলল, আমি আপনার একটা চিঠিও পাই নি৷

- ও, তাহলে ঐ রাস্কেলটাই মেরে দিয়েছে৷ মুজাফফর ক্ষুব্দ কন্ঠে বলে উঠলেন, মানুষরূপী একটা পশু ৷ পশুরও অধম ৷ তারপর বলতে লাগলেন, তোর কাছ থেকে যখন কোনই জবাব পেলাম না, তখন মনটা খারাপ হতে লাগল ৷ ভাবলাম, আমার এখানকার কাজ তো শেষ হয়ে গেল, আমি নিজেই ঢাকা গিয়ে তোকে নিয়ে আসব ৷ সেই মোতাবেক কাল দুপুরের গাড়িতেই ঢাকা চলে গেলাম৷ গিয়ে যা কিছু দেখলাম, তা যদি আমি স্বচক্ষে না দেখতাম, তাহলে হয়ত ভুল করে তোর ভাবীর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমিও তোকে বকাঝকাই করতাম ৷ আল্লার শোকর , তিনি আগেই আমার দৃষ্টিটা খুলে দিয়েছিলেন ৷

আসমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেখানে কী দেখলে?

মুজাফফর বলতে লাগলেন, দেখলাম, তার ঘরের মেঝের ওপর ডুগি তবলা হারমোনিয়াম সাজানো ৷ সংগীতের আসর খুলেছে ৷ মুসলমানের ছেলে, রাধা কৃষ্ণের ন্যাংটা মূর্তি দিয়ে শোকেস সাজিয়েছে ৷ এটা যে মনিদের বাসা প্রথম প্রথম আমার বিশ্বাসই হয়নি! মনে মনে ভাবলাম, হায় আল্লাহ, এ আমি কোথায় এলাম? পরে জোর ডাকাডাকির পর সেই পশুটা বেরিয়ে এসে কী বলল জানো?


আসমা বেগম উত্সুক মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল,

- আমাকে যেন সে চেনেই না, তেমনি ভঙ্গীতে বলল, কী চান? এই হচ্ছে আমার সেই গুণধর ভগ্নিপতির প্রথম কথা ৷ মনে হল পায়ের জুতো খুলে ওর মুখের দাঁতগুলো খসিয়ে দিই৷ দিই নি সেটা ওর বাপের ভাগ্যি বলতে হবে৷ বলেই মুজাফফর হাপাতে লাগলেন৷

আসমা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর? তারপর মুনীর কথা জিজ্ঞাস করলাম৷ শয়তানটা কোন জবাব দিতে পারল না৷ জবাব দিল একটি মেয়ে ৷ দেখলাম ঐ মেয়েটিও ওর বাসাতেই আছে৷ এবার মুনীরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে রে ঐ মেয়েটি? মনি, চিনিস নাকি?

- সে কী করে সেখানে?

- সেখানে তো থাকে না, মহিলা কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে৷

- সেই-ই বলল, মুনীরা ভাবী চলে গেছে৷

আসমা বেগম মাঝাখানে প্রশ্ন করলেন, ও, যে মেয়েটি আমাদের এখনে এসেছিল?

মুনীরা বলল, হ্যাঁ সেই ৷

আসমা বেগম আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর তুমি কী করলে?

মুজাফফর বললেন, তখন আমার আর মাথার ঠিক নেই ৷ আমি যেন উম্মাদ হয়ে গেছি৷ চিত্কার করে ওকে গালাগালি করলাম, আমার বোনের খোঁজ যদি না পাই, তবে তোর বত্রিশ নাড়ী আমি টান মেরে বার করব ৷ বলে চলে এলাম ৷ মনিকে যদি আমি না পেতাম, ওর ভাগ্যে ভালই ছিল৷ কিন্তু যাক, মনি যখন চলে এসেছে, তখন ঐ খবিসের সাথে বোঝা পড়ার দরকারও আমার শেষ হয়েছে ৷ আমার বোনকে আমি ফেরৎ পেয়েছি, তার জন্যি আমি আল্লার হাজার হাজার শোকর গুজারী করছি৷ ঐ নর পশুর ঘরে আর আমি ওকে যেতে দেব না৷


আসমা বেগম স্তদ্ব হয়ে কিছুক্ষণ অধোমুখে বসে রইলেন ৷ নীরবতার মাঝ দিয়েই বেশ কয়েকটি মুহুর্ত কেটে গেল ৷ এক সময় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ও যে এত বড় শয়তান হবে, কশ্মিনকালেও আমি তা ভাবতে পারি নি ৷ বলেই আবার চুপ করে রইলেন৷ খানিকটা পর স্বগতোক্তির মতন বলে উঠলেন, এখন যে জটিল সমস্যা দেখা দিল ৷


মাজাফফর ঝাঝিয়ে উঠে বললেন, কিসের সমস্যা? আমি থোড়াই পরোয়া করি৷ আমার বোন আর কখনো ওর ঘরে যাবে না ও যদি জীবনে কখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারে, সেটা হবে আলাদা কথা ৷ কিন্তু ঐ রকম একটা নর পশুর কাছে আমি মনিকে কিছুতেই আর ফিরিয়ে দিতে পারি না ইমপসিবল৷


আসমা বেগম কী যেন বলত গিয়েই থেমে গেলেন৷ তারপর মুনীরাকে লক্ষ্য করে বললেন, তুই ও ঘরে যা মুনি ৷

মুনীরা অন্য ঘরে চলে গেলে আসমা বেগম স্বামীকে বললেন সমস্যা মানে-ভীষন জটিল সমস্যা ৷

মুজাফফর উত্সুক মুখে তাকিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, কী সেটা?

আসমা বেগম চাপা গলায় বললেন, সব কিছু তো তুমি জানো না৷ আর জানো না বলেই তুমি এমন করে বলতে পারছ ৷ মনি তো মা হতে যাচ্ছে ৷

আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে মুজাফফর লা জবাব হয়ে গেলেন ৷

মুখখানি তার সহসা পাংশু বিবর্ণ হয়ে উঠল ৷


অফিসে ঢুকেই নন্দিতার সাথে মাহতাবের দেখা হয়ে গেল ৷ প্রাত্যহিক নিয়মে আজো সে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ৷ ওকে এই ভাবে সম্ভাষন জানাতে দেখলে মাহতাবের খুব আনন্দ লাগে ৷ যতই দিন যাচ্ছে, নন্দিতাও ততই যেন মাহতাবের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে ৷ ওর আগের আচরণ আর এখনকার আচরণের মধ্যে মনে হয় আকাশ পাতাল ব্যবধান৷


আগে মাহতাবকে দেখে মেয়েটি কেমন গম্ভীর মুখ করে হেটে চলে যেত৷
কিন্তু বস্ হওয়ার সাথে সাথে তার সেই গাম্ভীর্য কোথায় যেন অন্তর্হিত হয়ে গেছে ৷ তার বদলে এখন তার মুখে সর্বদা পুষ্পের হাসি ঝলমল করে! এতদিন সেই হাসি ঐ ব্যাটা গজনফর আলী চাপা দিয়ে রেখেছিল৷


গজনফর আলী ঝানু মানুষ ৷ ধড়িবাজিতে তার জুড়ি নেই বলে অফিসের সবারই জানা৷ একবার সে ফরিদকে দিয়ে ডাইরেক্টর সাহেবকে দারুণ একটা ঘোল খাইয়েছিল ৷ সেকথা পাকিস্তান আমলের সব সাহেব- সুবোই ভাল করে জানে৷


ফরিদ বড় সাহেবের কাছে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট পেশ করল, বড় সাহেব তাকে অবিশ্বাস করে বলেছিলেন, এসব বিলকুল মিথ্যা ৷


আর যায় কোথায়! ফরিদ মুখের ওপর চট করে জবাব দিয়েছিল, আমি না হয় মিথ্যা বলতে পারি, স্যার! কিন্তু মেডিকেল সার্টিফিকেট কি আর মিথ্যা বলতে পারে? সার্টিফিকেটই তো বলছে আমি অসুস্থ ছিলাম ৷


ডাইরেক্টর সাহেব আর কী করবেন? ডাক্তারের সার্টিফিকেট প্রায় মিথ্যেই হয় এবং সেটা মিথ্যা বলার ক্ষমতা ও কারুর থাকেনা, সেও তো জানা কথা ৷ বাধ্য হয়েই সাহেব সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন ৷ চুপ করে গেলে হবে কী? দুদিন বাদেই খবর পাওয়া গেল ফরিদ বদলী হয়ে গেছে ৷ একেবারে সেই মর্দানে-পিউনিটিভ ট্যান্সফারে৷


খবর শুনে ফরিদ দৌড়ে গেল গজনফর আলীর কাছে ৷ গজনফর দুমুহুর্ত চিন্তা-ভাবনা করে, খুশীর চোটে ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠে বলল, কিল্লা ফতেহ হো গিয়া ৷


তারপর গজনফরের পরামর্শ মত ফরিদ বোচকা-বুচকি নিয়ে ঠিকই মর্দান যাত্রা করল ৷ এবং প্রথমেই গিয়ে উঠল সে অর্থমন্ত্রী শোয়েবের বাসায় ৷ ফরিদকে দেখে মন্ত্রী সাহেব খুবই আনন্দিত হলেন ৷ তার কারন এক সময় এই ফরিদই ছিল তার অত্যন্ত নিষ্ঠাভাজন পিওন ৷


মন্ত্রী সাহেব ফরিদকে কুশল জিজ্ঞেস করলেন, এবং কী ব্যাপারে সে গিয়েছে সেখানে তাও জানতে চাইলেন৷ ফরিদ বলল, মর্দানে যাচ্ছি, স্যার ৷ ট্রান্সফার হয়ে গেছে৷


- বেশ তো ভাল কথা, যাওয়ার আগে আমাদের এখানে দুদিন বেড়িয়ে যাও তাহলে ৷

- আগামী কালকের মধ্যেই সেখানে জয়েন করতে হবে, স্যার৷ পিউনিটিভ ট্রান্সফার কিনা৷

- ক্যায়া বাত? কী বললে ? কী জন্যে তোমাকে বদলী করল? গর্জে উঠলেন অর্থমন্ত্রী ৷

ফরিদ সুযোগ বুঝে এবার সব কথা আদ্য-পান্ত সুন্দর ভাবে, যেমন করে গজনফর আলি তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, অর্থমন্ত্রীর কাছে সবিস্তারে বর্ননা করল ৷ তারপর বলল, ঘরে থেকেই অসুস্থ ছেলে-মেয়েদের সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করতে পারি নি স্যার ৷ এখন তো তাদের মরা ছাড়া আর উপায় থাকল না৷


টলটলে চোখে অর্থমন্ত্রী শোয়েব উঠে দাড়ালেন, তুম ঠায়রো ফরিদ ৷ ম্যায় আবি আয়া হুঁ ৷ তারপর ঘরের ভেতর গিয়ে অল্পক্ষনের মধ্যে ফিরে এসে বললেন, তুমি এখনে থাকবে নাকি করাচি যাবে?


ফরিদের চোখ দুটো আনন্দে ঝিলিক মেরে উঠল৷ এখানে থাকলে বড় সাহেব কে যে টিট করা হল তার তো যথারীতি প্রর্দশন হচ্ছে না ৷ কথাটি চিন্তা করেই ফরিদ মাথা চুলকিয়ে বলল, বাল-বাচ্চার অসুক-বিসুখ, করাচি যেতে পারলে তাদের সেবা-শুশ্রষা করতে পারব ৷ সেখানে যেতে পারলেই ভাল হয় স্যার৷


- ঠিক আছে৷ তোমার বদলী কেনসেল হয়ে গেছে৷ তুমি যেখানে চাও, সেখানে গিয়ে জয়েন করতে পারো৷

ফরিদের মনে আছে বড় সাহেবের মুখ খানি হাড়ির তলার মতন কালো হয়ে গিয়োছিল ৷ সেও তো ঐ গজফর আলির মহিমাতেই ৷ পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত গজনফর কি রকম রূই-কাতলাকে এই রকম নাকানি-চুবানি খাইয়েছে?


এমনিতেই সে পাকা বুদ্ধির মানুষ৷ তার ওপর আরো একটা বাড়তি সুবিধা হয়েছে আজকাল৷ সে একজন পীর সাহেবের মুরীদী কবুল করেছে ৷ ফলে তার গুনপনা এখন বেড়ে গেছে চতুরগুণ৷ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ৷ তাই মাহতাবের বারোটা বাজানো এখন তার কছে মাত্র সময়ের ব্যাপার ৷ কি কি বিষয়ে এই তরুন অফিসারের আসক্তি, তার তত্বতালাশে মাস কয়েক যেতেই, অর্থ ও নারী বিষয়ে যে মাহতাবের ষোল আনা আসক্তি, সেটা বুঝতে গজনফরের আর বাকি নেই৷


সর্বদা মাহতাবের পেছনে লেগে থাকার বড় একটা মওকাও হচ্ছে এদিকে অফিসে ও গজনফরকে সাপোর্টার বাড়াতে হচ্ছে ৷ সাপোর্টার যত বাড়বে, বলও তার ততই বাড়বে ৷ কাদির মিয়া হাঁপানীর রোগী ৷ বছর দশেক ধরে ডাক্তার কবিরাজ আর ঝাড়ফুঁক, তাবিজ তুমার কিছুই সে বাদ রাখে নি ৷ কোন ফলোদয় হয় নি ৷ গজনফর তাকে বুঝিয়েছে, জেন্দা বাবার উরূসে গেলেই হাঁপানী বাপ বাপ করে পালবে৷ ব্যস, শুনেই আর দেরি করে নি কাদির৷ তড়িঘড়ি গিয়ে বাবার পাগড়ী ধরে মুরীদ হয়ে এসেছে ৷ তারপর থেকে এই বছর দুই ধরে হাপিত্যেসে রোগ মুক্তির জন্যে সে প্রতীক্ষা করছে ৷ ইউসুফ মিয়া কোন একটা কলেজে ডেপুটিশনে ছিল৷ অধ্যক্ষ সাহেবের পি, এ, থাকাকালে সেবার দেড় লক্ষ টাকার একটা দাঁও মেরেছিল৷ একটি বিদেশী সরকার মসজিদ নির্মাণের জন্যে চৌদ্দ লক্ষ টাকা মঞ্জুরী ঘোষনা দিলে, ইউসুফ মিয়া মসজিদের কর্মকর্তার সাথে রফা করতে সক্ষম হয় যে, বরাদ্দকৃত অর্থের প্রাথমিক কোটাগুলি থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা অধ্যক্ষ সাহেবকে দিয়ে দিতে হবে ৷ প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের পথে যে ঝুকি আছে, তার কথা ভেবে, মসজিদ কমিটি তাত্ক্ষণিক ভাবে রাজী হতে পারে নি ৷ কিন্তু এই মহৎ কাজের জন্যে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ঘুষ না দেওয়া অর্বাচীনতা ভেবে, ইউসুফ মিয়াকে সাড়ে তিন লক্ষ দিয়েই শেষমেশ বাকী টাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন ৷ ইউসুফ তার থেকে দুই লক্ষ টাকা অধ্যক্ষ সাহেবকে দিয়ে, বাকী দেড় লক্ষ টাকায় একটা রিকণ্ডিশণ্ড কোস্টার কিনে ছেড়ে দিয়েছে ঢাকা কাপাশিয়া রুটে ৷ এখন টাকা পয়সা আসছে দেদার ৷ কিন্তু তাহলে কি হবে বুকের মধ্যে সন্দেহের ধুকপুকানিটা কিছুতেই যেন দূর হচ্ছিল না ৷ সেখানেও গজনফর ছিল মুশকিল আসানের মতন ৷ বলে দিয়েছেও তাই৷ গত উরুস মুবারকে বারো হাজার টাকা দিয়ে এক পেল্লায় ষাঁড় নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে জেন্দা বাবার দরগায় ৷ তারপর বাবার পায়ের ধুলো মাথায় দিতেই বুকের ধুকপুকানিটা উঠে গেছে ৷


এমনি করে গজনফরের তদ্বিরে সারা অফিসে পীরে কামেল জেন্দা বাবার ভক্ত অনুচরদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে দিন দিন ৷ ছেলে মেয়ে হয় নি? যাও বাবার কাছে৷ ঘুষ খেতে গিয়ে চাকুরী নিয়ে টানা হেচাড়ায় পড়েছ? যাও বাবার কাছে ৷ কারুর মাথায় লাঠি মেরে খুন করে ফাসির আসামী হয়েছ? যাও বাবার কাছে ৷ বাবা সর্বজ্বরহর বটি ৷ তোমাকে বেহেশতেও নিয়ে যাবে, আবার ফাসির দড়িও গলা থেকে খুলিয়ে দেবে৷ সব কাজেই বাবা তোমার মুশকিল আসান ৷ সেই বাবাই যখন গজনফরের হাতে, তখন আর তাকে পায় কে? গজনফরের রাগটা আজকের নয় ৷ সেই সেবার কাকদিয়া হাই ষ্কুলের ডেভেলপমেন্ট ষ্কীমের টাকার বখ্রা নিয়েই হয়েছিল গোলমালের সুত্রপাত৷ মাহতাব পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে অফিসের কাউকে একটা লাল পাইও দেয় নি ৷ সেই রাগে মাহতাবকে এক হাত দেখানোর জন্যে অনেক আঁতিপাঁতি করে খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল নন্দিতাকে ৷ নন্দিতা গজনফরের অনুগত ৷ নন্দিতার চাকুরীর ব্যাপারে গজফরের অবদান ছিল একক ৷ তাই নন্দিতাও তার প্রতি কৃতজ্ঞ ৷ এই সুন্দরীকে দিয়েই গজনফর মাহতাবকে সোজা ছুড়ে ফেলবে রসাতলে ৷


সেই নন্দিতার মুখের হাসি এখন ছুরির ফলার মতন মাহতাবের বুকের মধ্যে গেথে যাচ্ছে ৷ মাহতাবের মুখে হাসি ফুটে উঠল, কেমন আছেন মিস নন্দিতা ?

- ভালো আছি, স্যার ৷ আপনি ভাল তো ? নন্দিতার রক্তলাল ওষ্ঠাধরে খুশীর ঝিলিক বয়ে গেল৷

মাহতাব বলল, আমাদের আর ভাল থাকা?

- কেন স্যার? নন্দিতা উদ্রিব কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ৷ প্রসাধন চর্চিতা লাবণ্যময়ী নন্দিতার কানের ঝুলন্ত দুল জোড়া ঝিলমিল করে উঠল ৷ মাহতাব চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল ৷ নান্দিতা জিনিয়ার চেয়ে সুন্দরী নয়, আর মুনীরার চেয়ে তো নয়ই। কিন্তু তার ঐ হাসির মধ্যে এমন একটা আশ্চর্য্য স্বকীয়তা লুকিয়ে আছে, যা তাকে অন্য সবার থেকে অনন্যতা দান করেছে ৷ এই এক আশ্চর্য ভিন্নতর জিনিস, যার উপলদ্বিও মাহতাবের কাছে অনন্য ৷

মাহতাব বলল, মিস, আপনার মায়ের শরীর কেমন?

- খুবই খারাপ, স্যার ৷ মা এখন আর মোটেই নড়াচড়া করতে পারেন না ৷ অষ্টপ্রহর কষ্টের জন্যে কেবল পড়ে পড়ে কঁকান৷
মাহতাবের চেহারায় বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, সত্যি আপানার কষ্টের কথা মনে হলে মনটার ভিতর খচ করে ওঠে ৷

মাহতাবের কথা শুনে নন্দিতার মনটাও নরম হয়ে আসছে ৷ আর এই জিনিসটিকেই তার ভয় ৷ এই নরম হওয়াটা গজনফর আলীর কাছে মোটেই পছন্দনীয় নয় ৷ নন্দিতাকে বার বার সে সাবধান করে দিয়েছে, অভিনয়ের নায়িকা অনেক সময় বেঘোরে আসল নায়িকা হয়ে বসে ৷ গজনফরের অবশ্যি সতর্ক দৃষ্টিও আছে৷ নন্দিতাকে আরো মজবুত আর সুদৃঢ় মনের অধিরিণী করে তুলতে তার চেস্টার ত্রুটি নেই ৷

নন্দিতা সতর্ক হয়ে গেল ৷ বলল, আপনার শরীর কেমন স্যার?

মাতাবের চোখ দুটি ঝিলিক দিয়ে উঠল ৷ অদ্ভুত তীক্ষ্ন হাসি ঠোটের ওপর নেচে গেল ৷ বলল, কেন, চা খাওয়াবেন নাকি? তা যদি খাওয়ান তো মিথ্যে করে হলেও বলতে পারি, উফ, মাথাটা বড্ডো ধরেছে ৷ বলেই মাহতাব নাটুকে ভঙ্গীতে হাসতে লাগল ৷


নন্দিতাও খিল খিল করে হেসে উঠল ৷ হাসলে মেয়েটির গালে টোল পড়ে ৷ বলল, আপনি যদি মিথ্যে করে বলতেই পারেন, তো আমি কি আর সত্য করে একটু চা আপনাকে খাওয়াতে পারব না, স্যার? খুব পারব৷ করে আনি?


- আনতে চাইলে সেটা পরে হবে খন ৷ শেষে কী জানি কখন আবার রেগে মেগে বলবেন, সাবোডিনেট হয়েছি বলে ব্যাটা যা -তা হুকুম করছে ৷

নন্দিতা জিভ কেটে বলল, ছি ছি আমাকে এত নীচ ভাবছেন, স্যার? আমি চাকুরী করে খাই, কিন্তু অত নীচে নামি নি৷ আমি আপনাকে ঐ রকম অপমান করব, তা যে আমর ধারণারও বাইরে ৷ আপনি ভাবতে পারলেন, স্যার?

মাহতাব একটু অপ্রতিভ হয়ে পরেছিল৷ বলল, এই দেখ , আপনি আবার উল্টো বুঝে রেগে গেলেন দেখছি৷ আমি ঠাট্রা করে বলেছি আর আপনি....

নন্দিতা খুশী হয়ে বলে উঠল ৷ তাহলে আমার কথাটাও আপনি ঠাট্টাই মনে করুন৷ আপনার কথাটাও ঠাট্টা, আমারটাও ঠাট্টা ৷ মন্দ কি ? বলতে গিয়ে নন্দিতার মুক্তোর মতন পরিপাটি দাঁতগুলো ঝিকমিক করে উঠল৷

মাহতাব বলল, চায়ের আয়োজনটা রেখেছি, ক্লান্তি বোধ করলে মাঝে মধ্যে এককাপ খেয়ে নিই৷ কিন্তু বললেন আমি চাটুক্তি করছি; সত্যি বলছি, আপনার হাতের তৈরী চা, চা তো নয়, যেন অমৃত৷ কোন তুলনাই হয় না৷

এ রকম প্রশংসায় মেয়েদের মুখ চোখ খুশীতে সাধারণত ঝল মলিয়ে ওঠে ৷ নন্দিতার হয়েওছিল তাই৷ কষ্ট করে সে সামলে নিয়ে বিনয় ও লজ্জা মেশানো গলায় বলল, আপনার অনুগ্রহ স্যার ৷ নইলে চা আমি যে কেমন বানাই, সেটা অন্য না জানুক আমার তো অজানা নেই৷

মাহতাব বাধা দিয়ে বলে উঠল, না না, মিস নন্দিতা ৷ যা সত্যি তাই আমি বলছি ৷ এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না৷ আপনার সেদিনের সেই চা, সত্যি অপূর্ব হয়েছিল৷ ম্যাচলেস!

নন্দিতা লজ্জিত মুখে বলল, ইঁস সো কাইণ্ড অব ইউ, স্যার!

আজ সকালের ঘটনাটি মাহতাবের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে ৷ মুনীরার পরিত্যক্ত আসনটি জিনিয়ার জন্যে বরাদ্দ কররা পর মুনীরার প্রয়োজনটুকু মাহতাবের কাছে হঠাৎই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল৷ অথচ তারপর থেকেই মুক্ত বিহঙ্গী জিনিয়াকে নিয়ে মাহতাব অন্তহীন দুর্ভাবনায় অনুক্ষণ বিব্রত হয়ে থাকত ৷ একদিন এমন ছিল , যেদিন জিনিয়াকে পাওয়া তার জন্যে ছিল খুবই সহজ ৷ মাহতাব সেদিন ইচ্ছে করেই জিনিয়াকে প্রত্যাখান করেছে ৷ জিনিয়াকে সেদিন মাহতাবের সস্তা জিনিস বলে মনে হয়েছিল৷ মাতহাব এর সঙ্গে যখন বিয়ে দেবার জন্যে জিনিয়ার বাবা উঠে পড়ে লেগেছেন, জিনিয়া তখন ক্লাস টেন-এর ছাত্রী ৷ সাদা-মাটা মেয়ে ৷ খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষন করার মতন আহা-মরি কিছু নয় ৷ ষ্কুলে ফাংশান হলে, মাঝে মাঝে স্টেজে উঠে হাটু দুমরিয়ে, পা দুটে পাশ দিয়ে পেছনে রেখে, হারমোনিয়ামটায় আঙ্গুল লাগিয়ে সে গান ধরত, কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা ৷ সে-সময় গলায় তার আজকের মতন এমন সুক্ষ কারুকাজ ছিলনা ৷ এমন মাদকতাময় দরদও তখন সৃষ্টি হয়নি৷ কাঁচাঁ গলায় গানের সুরটা কেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেত ৷ নিতান্তু বালিকা বলেই ৷ তবু আধা-শহর আধা-পল্লীর এই ষ্কুলে জিনিয়া যা কিছু বাহবা পেত, তার কোনকিছুই মাহতাবের মনকে স্পর্শ করে নি ৷ তখন জিনিয়া চোখে কাজল দিত, কিন্তু তাহলে কী হবে? এখনকার এই বিদ্যুৎ-প্রভ-দৃস্টি ওর চোখে তখন ছিলনা ৷ তারপর গায়ে পড়া একটি মেয়ে ৷ উচ্চকাঙ্খী মাহতাবের মনে সেদিন কোনই রেখাপাত করতে পারে নি ৷ কিন্তু এখন? এখন সেই জিনিয়াই এক আকর্ষনীয়া সুন্দরী নারী ৷ তনুময় দোদুল্যমান মাধবী লতার ছন্দ৷ আজানুলম্বিত এলোচুলে শ্রাবন মেঘের রঙ ৷ দুচোখে বৈশাখের বিদ্যেৎ প্রভা ৷ জিনিয়া এখন হাজার লুব্ধক চোখের লক্ষবস্তু ৷ সুতরাং তার প্রতি মাহতাবের আগ্রহ ও আকর্ষণ দিন দিন সুতীব্র হয়ে উঠবে বৈকি৷


ব্যাপারটা ঘটে গেল একেবারে সকালেই ৷ কী একটা কাজে খুব সকাল সকাল মাহতাবকে একটু বাইরে যেতে হয়েছিল ৷ বাসা থেকে বেরুনোর সময় জিনিয়া আর সে এক সঙ্গেই বেরিয়েছিল ৷ জিনিয়ার যাওয়ার কথা বকসী বাজারে এক বান্ধবীর কাছে নোট আনতে ৷ একলাই সে গিয়েছে সেখানে ৷ বাইরের দরকার সেরে মাহতাব যখন বাসার দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ ওর চোখ পড়ল জিনিয়ার দিকে ৷ জিনিয়া আর এক ঝাঁকড়া-চুলো ছোকরা প্রায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বিপরীত দিক থেকে হেটে আসছে ৷ ওদের ৷ ঐ অবস্থায় দেখে হঠাৎ মাহতাবের চোখ দুটো ভায়ানক জ্বালা করে উঠল ৷ হৃত্পিণ্ডে অস্থির স্পন্দন শুরু হয়ে গেল৷ তারপর মাথার মধ্যে কী রকম একটা অদ্ভুত আচ্ছন্নতা অক্টোপাশের মতন ওর চেতনাকে ছেয়ে ফেলল৷ মাহতাব আর চলতে পারছে না ৷ পা যেন ওর শরীরের ভার রাখতে গিয়ে হিম সিম খাচ্ছে৷ মাহতাবের মাথার মধ্যে একটা ঘর্ণি দিল ৷ তারপর রাস্তার পুর্ব দিকের রোয়াকের ওপর হঠাৎ সে পড়ে গেল৷


এই অবাক কাণ্ডটি জিনিয়ার লক্ষ্য এড়ায় নি ৷ সে দ্রুত এসে ঝাকড়া চুলো ছোকরার সহযোগিতায় মাহতাবকে ধরাধরি করে পাশের ডাক্তার খানায় নিয়ে বেঞ্চির ওপর শুইয়ে দিল ৷ মাহতাবের হাতে এতক্ষণও চশমার একটি খাপ ধরা ছিল৷ ওকে শুইয়ে দিতেই হাত থেকে খাপটি ছুটে বেঞ্চির তলে গিয়ে পড়ল৷ ওর অস্থিরতা ও কাতরাত দেখে ডাক্তার সাহেব উত্কন্ঠিত মুখ ষ্টেথোস্কোপ হাতে আসন ছেড়ে উঠে এলেন এবং মাহতাবের বুকে যন্ত্র লাগিয়ে তন্ন তন্ন করে অসুখের হেতু ও পরিনতি তালাশ করতে লাগলেন৷


ডাক্তার সাহেব কানের যন্ত্র খুলে চশমার ফাঁক দিয়ে দিয়ে জিনিয়ার মুখর দিকে তাকলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী বলুন তো ? ভদ্রলোকের হয়েছে কী?


ওরা দুজনই তখন কথা হারিয়ে ফেলেছে এবং বোকার মতন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে ৷ ডাক্তার সাহেবের কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যজনক ঠেকছে ৷ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ভদ্রলোকের সাথে আপনার সম্পর্কটা কী?


জিনিয়া থতমত করে জবাব দিল, উনি আমার বস্ ৷

- আপনার সাথে কি বচসা হয়েছে? ডাক্তার সাহেব আবার প্রশ্ন করলেন ৷

এবার ঝাঁকরা-চুলো যুবকটি কেমন আমতা আমতা করে জবাব দিল, আমি কিছুই বলতে পারব না৷ আমরা রাস্তা দিয়ে আসছিলাম ৷ হঠাৎ দেখলাম উনি পড়ে গেলেন....

কথাটি বোধহয় মাহতাবের কানে গিয়েছিল৷ ওর ঠোঁট দু'টি সাহসা নড়ে উঠল ৷ দুচোখের পাতা ও ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেল ৷ নীচের ঠোঁট ওপরের দাঁতির তলে চেপে একবার ওহ বলে সে কাৎতে উঠল৷

মাহতাবের আর্তস্বর শুনে জিনিয়া সামনে এসে দাড়াল ৷ ওর চোখ কেমন ভীতি আর লজ্জা জড়ানো৷ ওর দিকে চোখ পড়তেই মাহতাব চিত্কার করে, যা যা আমার সামনে থেকে তুই সরে যা ৷

ধমক শুনে লজ্জায় জিনিয়ার মুখ কালো হয়ে উঠেছে ৷ লজ্জা ঢাকবার জন্যে সে ডাক্তার খানায় বড় থামটার আড়ালে গিয়ে দাড়াল।

ঝাঁকরা-চুলো ছোকরা এবার মাহতাবের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল, চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি ৷
মাহতাব খেঁকিয়ে উঠল, ও, নো নো, বী অফ, আমি একলাই যেতে পারব৷ বলেই সে কাতরানির সাথে এপাশ ওপাশ মাথা চালাচালি করতে লাগল ৷

ওদের এই অদ্ভুত আচরণ দেখে ডাক্তার সাহেব এবং রোগীরাও কৌতুক বোধ করতে লাগল ৷ যুবকটি বিনয় প্রকাশ করে বলল, আপনি অসুস্থ...

মাহতাব ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল, না না, আমি অসুস্থ নই, আপনি আপানার নিজের কাজে যান ৷ অয়েল ইওর ওন মেশেন ৷

অবস্থা ক্রমেই জটিল হতে দেখে ডাক্তার সাহেব জিনিয়াকে ডেকে ওপর তলায় নিয়ে গেলেন৷ গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওর সাথে আপনাদের কী হয়েছে, সত্যি করে বলুন তো ৷

জিনিয়া পাংশু মুখে এক মুহুর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইল, তারপর বার দুই ঢোক গিলে ফেকাসে মুখে বলল, কিছুই হয়নি তো৷

ডাক্তার সাহেব দেখলেন, জিনিয়ার ভীতি বিহবল চোখের পাতা কাপছে ৷ তিনি বিশেষ আর ঘাটালেন না৷ কী একটা আন্দাজ করে নীচে এলেন। এসে দেখলেন, মাহাতাব বেঞ্চির ওপর উঠে বসেছে। মুখ চোখে তার উদ্ভ্রান্তির ছাপ ৷ দুমুহুর্ত পর সে বেঞ্চির ওপর উঠে সোজা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রোয়াকের ওপর দাড়াল ৷ তারপর ক্লান্ত কন্ঠে একটা রিকসা ডেকে তার ওপর উঠে বসল ৷


এই দৃশ্য দেখে জিনিয়াও মুহুর্ত খানিক দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল ৷ সে ও ম্লান মুখে রোয়াকে এসে দাড়াল ৷ মাহতাবের রিক্সাঅলা ছুটতে ছুটতে তার দিকেই আসছে ৷ কাছে পৌছে সে বলল, সাহেব আপনকে ডাকছে ৷ জিনিয়া আর অপেক্ষা না করে রিক্সাঅলার পিছু পিছু গিয়ে মাহতাবের পাশে বসে পড়ল ৷ ঝাকড়া চুলো যবকটি ওদের যাত্রাপথের দিকে বেশ কয়েক মুহুর্ত এক দৃষ্টে চেয়ে থেকে এক সময় উল্টো পথ ধরে হাটতে শুরু করল ৷


বাসায় ফিরে মাহতাব ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেল ৷ তারপর প্রবল অস্থিরতায় সে ছটফট করতে লাগল৷

রাগে দুঃখে ক্ষোভে জিনিয়াও সারাটা পথ মাহতাবের সাথে একটা কথাও বলে নি ৷ কাধের ভ্যানিটি ব্যাগটি টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে জিনিয়াও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল৷ দুজনেই কিছুক্ষণ বোবায় ধরা রোগীর মতন ভেতরে ভেতরে গোঙাতে লাগল ৷ কয়েক মিনিট এইভাবে কেটে যাওয়ার পর জিনিয়াই প্রথম মুখ খুলল ৷ বলল, তুমি ঐ রকম সিনক্রিয়েট কেন করলে, বলত? রাগে জিনিয়ার ঠোঁট দুটি ঠিরঠির করে কাঁপছে৷


মাহতাব রেগে উঠে বলল, ঐ বদমাশ কবি ছোখরাকে আমি দুচোখে দেখতি পারিনা ৷ তোকে সে কথা আমি বারবার করে জানিয়ে দিয়েছি৷ তবুও তুই তার সাথেই মিশিস কেন?

জিনিয়া ঝাঁ করে মাহতাবরে দিকে ফিরে তাকাল ৷ চোখ থেকে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে বলল, একজন চরিত্রবান লোকের হুকুম শুনে একটা বদমাশকে আমি কেন যে ত্যাগ করি নি , সে কথা পরে আমাকে জিজ্ঞেস করলে কি তোমার মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যেত? আমার সেই দুঃসহ অপরাধের জন্যে তুমি অন্য যে কোন সময় আমাকে জবাবদিহি করতে পারতে ৷ লোহা পুড়িয়ে আমার গায়ে ছ্যাকা দিতেও পারতে ৷ কিন্তু তা না করে, সেই একদঙ্গল লোকের মধ্যে তুমি অমন কেলেঙ্কারী করলে কেন শুনি? বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত কান্নায় জিনিয়ার কন্ঠরোধ হয়ে গেল৷


জিনিয়ার তীব্র অভিযোগের মুখে হতবুদ্ধি মাহতাব নির্বাক হয়ে বসে রইল। শক্ত জবাবের কথা দূরে থাক, কোন ভাষাই যেন এখন তার মুখে আসাছ না।

জিনিয়া কাঁদো কাঁদো মুখে বলতে লাগল, রেডিওতে অডিশান দিতে যাওয়ার দিন ঐ ছেলেটির সাথে আমার দেখা ৷ সে নাকি রেডিওর রেজিষ্টার্ড গীতিকার ৷ সেই সুবাদে আমার সাথে নিজেই সে পরিচয় করল৷ রেডিওতে দেখা হলে তার লেখা গান গাইবার জন্যে সে আমাকে পীড়াপীড়ি করে ৷ আমি নজরুল গীতি গাই৷ আধুনিক তো গাই না ৷ বেচারী চায় যে, তার গান শিল্পীরা বেশী বেশী গাক ৷ একজন গীতিকার তো তা চাইবেই৷ পথে আসার সময় হঠাৎ দেখা ৷ বলল, একটু দাঁড়ান, আপনার সাথে একটা কথা আছে ৷ আমি আর কী করি? বলতে তো পারি না যে, দাড়াব না ৷ দাড়ালাম ৷ বলল, চলুন হাটতে হাটতে কথা বলি ৷ শেষে বারবার আমাকে অনুরোধ করতে লাগল, আমার দুটো গান আপনি রেকর্ড করুন ৷ আমি তো আর বলতে পারি না যান, গান টান রেকর্ড করতে পারব না ৷ চক্ষু লজ্জা বলতেও একটা কথা আছে ? এটা আমার মস্ত-জবর অপরাধ ছিল, সে কথা আমি একশোবার স্বীকার করছি। কিন্তু তার জন্যে এক দঙ্গল লোকের মধ্যে তোমাকে অজ্ঞান হয়ে পড়তে হবে কেন? ক্রুদ্ধ জিনিয়া তীব্র দৃষ্টি মেলে মাহতাবের দিকে তাকাল৷


- আমার যাতে সন্দেহ হয় তুই সেই কাজ কেন করতে গেলি? মাহতাব তিক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল ৷

জিনিয়াও ঝাঁঝিয়ে উঠে পাল্টা প্রশ্ন করল, তোমার সাথে আমি কবে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, তুমি যাতে রাগ করবে, আমি কখনো সেটা করব না? কবে আমি বলেছি? যে, তোমার যাতে সন্দেহ হয় হবে, তা থেকে অবশ্যই আমি দুরে থাকব? কবে বলেছি?

জিনিয়ার এই ঔদ্ধত্যপুর্ন আচরন দেখে মাহতাব অবাক হয়ে গেল ৷ জিনিয়ার দিকে দৃস্টি পরতেই সে নতুন করে বুঝতে পারল, এ-এক বিষ্ময়কর মেয়ে৷ এ সেই মুনীরা নয় ৷ এর চাইতে ছোট অপরাধেও মাহতাব মুনীরার গালে চড় কষে দিয়েছে৷ অথচ এই মেয়েটির গালে হাত তোলা তো দুরেরর কথা ওর চোখের দিকে সরাসরি চোখ রাখতেও মাহতাবের এখন সাহস হচ্ছে না ৷ সব কিছু ভেবে-চিন্তে সংযত গলায় সে প্রশ্ন করল, তাই বলে তুই যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবি? স্যার কি এই জন্যেই তোকে এখানে রেখে গেছেন?


- কী জন্যে রেখে গেছেন, সেটা বুঝি শুধু তুমিই জানো? আমি তার কিছুই জানিনা ? এই জন্যে কি রেখে গেছেন, যে আমাকে নিয়ে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে, আর আমি কিছু করতে গেলে অমনি তোমার মনে নানা রকম সন্দেহ জাগবে? তাই যদি হয়, বাবা বলুক আর যেই বলুক , তার সাথে আমি একমত নই ৷ আর এটাও তোমার স্পষ্ট জেনে রাখা উচিত, তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্কও নয়, সুতারাং তা নিয়ে তোমার জোর ও সাজে না ৷

- তাই বলে তুই যার তার সাথে প্রেম করে বেড়াবি? মাহতাব আক্ষেপের ভঙ্গীতে বলল৷

জিনিয়া তিক্ত কন্ঠে বলে উঠল, আমাকে এমন বেহায়া ভাবতে একটুও লজ্জা হলোনা তোমার? আমি মেয়ে-মানুষ হয়েছি বলে কি আমার ঘাটে এতটুকু বুদ্ধি নেই যে, ঐ রকম পাগলাটে একটা ছোকরার সাথে আমি প্রেম করে ঢলে পড়ব?

তোমার কান্ডজ্ঞান অতি জঘন্য ৷ আমি ভাবতেও লজ্জা বোধ করি ৷

জিনিয়ার এই তীব্র কষাঘাতে মাহতাব হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেল! এমন তীব্র ঝাঁঝাঁল গাল-মন্দ মেশানা কথাটিও তার কাছে ফালির মত আঘাতের মতই মনে হল ৷ জিনিয়ার কথা শেষ হতেই মাহতাব বোবার মতন দৃস্টি মেলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷

জিনিয়া বলে যেতে লাগল, আমি তোমার সতী-সাধ্বী বৌ এর মতন কখনো সতী-সাধবী হবার দাবি করি নি, সেটা অন্তত তুমি ভাল করে জানো৷ কিন্তু তাই বলে তোমার মত আমি কান্ডজ্ঞানও হারাই নি সেটাও আজকে তুমি জেনে নাও৷ জিনিয়ার রুক্ষ কন্ঠস্বরের তীব্র অসহিষ্ণুতা ঝরে পড়ল৷


মাহতাব দুহাতের তালুর ওপর মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল ৷ শুয়ে শুয়েই ঠান্ডা গলায় বলল, কিন্তু ঐ রকম অবস্থায় মানুষের মনে একটা ধারনা তো জন্মাতে পারে? পারে কিনা তুই বল৷


- ধারনা হলেই ঐ রকম সিনক্রিয়েট করতে হবে? একজন মেয়ে মানুষকে এক দঙ্গল মানুষের মধ্যে ঐ ভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াতে হবে? সে অধিকার তুমি কেন, কোন মানুষের নেই৷ থাকা উচিতও নয়৷

মাহতাব মিনমিনে গলায় বলে উঠল রাইট ৷ ঐ সময় আমার সত্যি সত্যি কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল রে৷ তুই ঠিকই বলেছিস৷

জিনিয়া এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ৷ কান্না জড়িত গলায় বলল, আগামী কাল থেকে আমি আর এখানে থাকব না, মাতু ভাই ৷ তোমার করুনার জন্যে আমি জীবন ভর কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম ৷ কিন্তু সত্যি বলছি, ঐ করুনা দিন দিন মজবুত বড়শি হয়ে আমার গলায় আটকে যাচ্ছে ৷ তুমি বড় লোক, তোমার শিক্ষা ও সম্পদ দুটোই আছে আর তা নিয়ে তোমার গৌরব ও সাঝে ৷ আমার ঐ রকম কিছুই নেই ৷ একদিন হয়ত ঐ শিক্ষা ও সম্পদের পাশে আমার মতন একটি মেয়েকে তোমার করুনার পাত্রী বলেই মনে হবে ৷ সেদিনের ঐ দয়ার খোটাটি আমি সইতে পারব বলে আমার সহস হচ্ছে না ৷ তার চেয়ে আগে ভাগেই সব চুকে বুকে যাওয়া অনেক ভাল৷


জিনিয়ার ক্লান্তি মেশানো কথাগুলি শুনে মাহতাব দারুন ভাবে অভিভুত হয়ে পড়ল৷ তারও চোখে মুখে বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠল৷ মাহতাব কাতর কন্ঠে বলল, তোকে ভুল বুঝেছিলাম রে ৷ আমাকে তুই ক্ষমা কর, জিনি৷


জিনিয়ার চোখ থেকে দরদর করে অশ্রু ঝরতে লাগল৷


উত্তেজনার শুরু থেকে জিনিয়ার চোখে পানি দেখা পর্যন্ত গোটা সময়টুকু মাহতাবের চোখের ওপর এখন ছবির মতন ভাসছে ৷ জিনিয়াকে রহস্য-লোকের দুর্লভ নক্ষত্রের মতন তার মনে হচ্ছে ৷ যার মধ্যে জটিল রহস্যসময়তা লুকিয়ে থাকে, তার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ভাবেই আকর্ষন থাকে বেশী ৷ জিনিয়ার প্রতিও মাহতাবের তেমনি এক আকর্ষন নিত্য দিন যে দুর্বার হয়ে উঠছে ৷ তা মাহতাব সবর্দা আপন অন্তরে অনুভাব করে ৷


বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোদুল-দোলায় বেশ কিছুক্ষণ দুলছিল মাহতাব ৷ নন্দিতা ধুমায়িত চায়ের কাপটি সামনে রেখে বলল, নিন স্যার চা খান৷

- আপনি ? আপনার কাপ কই?

- বস্ এর সামনে বসে-বসে চা খাওয়া শোভন নয়, স্যার আমি অন্য সময় খেয়ে নেব৷

মাহতাব কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ওসব বাজে কাথা ছাড়ুন তো আপনি একটা কাপ আনুন.... যান৷

চাপে পড়ে নন্দিতা এক কাপ চা নিয়ে মাহতাবের মুখামুখি বসল৷ তারপর কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, যদি কিছু মনে না করেন স্যার তাহলে আমার একটা নিবেদন পেশ করতে পারি৷ বলব বলব করে বেশ কিছু দিন ধরে চিন্তা করছি, কিন্তু বলতে গিয়েও লজ্জা-শরমে আর বলা হচ্ছে না৷


- নিবেদন ? সেটা আবার কী?

- একটা পার্সোনাল ব্যাপার স্যার৷

- পার্সোনাল ব্যাপার? তার জন্যে আপনাকে এতদিন ধরে লজ্জা-শরমে কাটাতে হচ্ছে ? মাই গড ৷ আমাকে অবাক করলেন মিস্ নন্দিতা আপনি আমাকে নিশ্চয়ই ফ্রেণ্ডলি ভাবতে পারছেন না, তাই না?

- ওরে সব্বোনাশ! আপনি কী যে বলেন স্যার ৷ ভাবতে তো অনেক কিছুই মন চায়, কিন্তু আপনি আমার বস্ । বন্ধু ভাবাটা কি সহজ ব্যাপার? সিরাজ সাহেব গনি সাহেবের এসিস্টেন্ট ছিলেন ৷ গনি সাহেবকে বন্ধু ভেবে কী যেন বলতে গিয়েছিলেন ৷ আর গনি সাহেব চটে উঠে বলেছিলেন, সিরাজ মিয়া! আপনি আমাকে কি দোস্ত পেয়েছেন নাকি? সিরাজ সাহেবের তারপরে কত যে হেনস্তা। আমার ভয় হয় স্যার,বন্ধু ভাবতে গিয়ে আমার আবার ঐ সিরাজ সাহেবের দশা না হয়৷

মাহতাব হো হো করে হেসে উঠল বলল, আপনার সেই সিরাজ সাহেব তো পুরুষ মানুষ৷ পুরুষ বস্ আর পুরুষ সাবর্ডিনেটে বন্ধুত্ব হয় কখনো ? আপনি একটা পাগল দেখছি, যাকগে এখন আপনার নিবেদনটা শোনার জন্যে আমিও নিবেদন জানাচ্ছি ৷


নন্দিতা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গীতে পাংশু মুখে বলল, আমার কথায় ব্যাথা পেয়েছেন, স্যার আমি ক্ষমা চাইছি৷

মাহতাব আতঙ্কিত হয়ে বলল, আরে, আপনি কী বলছেন এসব ? আপনার সেই কথাটি বলে ফেলুন তো শীগগীর ৷ আই এম রেডি টু হেল্প য়ু ইন্ অল সারকামস্ট্যাস্নেস্ ৷ নন্দিতা রুমালে মুখটা মুছে নিল ৷ বলল, আমার একজন রিলেটিভ। একটা বিল নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন....

- কী রকম জটিলতা?

- লাখ দুয়েক টাকার একটা ডিসক্রিপেন্সি ধরা পড়েছে ৷ অফিসিয়ালি এখনও অবশ্যি কিছু হয় নি৷ কিন্তু হওয়ার ভয় আছে ৷ ভদ্রলোক কিছু টাকা নষ্টই করে ফেলেছে ৷ বলেই নন্দিতা চুপ করে গেল৷

মাহতাব জিজ্ঞেস করল তারপর?

নন্দিতা বলল, ভদ্রলোক এর টাকাটা তছরুপ করার অবশ্যি ইচ্ছে ছিল না ৷ কিন্তু একটা লোভে পড়ে তার মুসিবত হয়ে গেল ৷ আর জানেন তো, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ৷

মাহতাব ঐসব দার্শনিক কথাবার্তায় কান না দিয়ে প্রশ্ন করল, তারপর কী হল?

-ভদ্রলোক এক ফার্মের এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ৷ ফান্ডের টাকা থেকে লাখ দুয়েক তিনি সরিয়েছিলেন ৷ উদ্দেশ্য কিছুদিনের জন্যে সেই টাকা দিয়ে একজন ভাইপোকে আর একজন শ্যালককে মিড্ল ইস্টে পাঠাবেন ৷ তারা চাকরী করে টাকা পাঠালেই ভদ্রলোক ফান্ডের টাকাটা আবার রিটার্ন করে দেবেন। তার ধারনা, টাকা তো আর একবারে সবটা লাগছে না৷ ধীরে ধীরে লাগছে৷ কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত অন্যদিকে মোড় নিল ৷ বলে নন্দিতা আবার একটু থামল৷

মাহতাব ওকে থামতে দেখে বলল, তার পর কী হল?

নন্দিতা বলতে শুরু করল, ভদ্রলোকের অদৃষ্ট মন্দ, ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্যে যে এজেন্ট কে তিনি টাকা দিয়েছিলেন ৷ সেই এজেন্টটাই ছিল ভুয়া৷ পঞ্চশ হাজার টাকা তার সেখানেই গচ্চা গেল ৷

- আর শ্যালক? তার কী হল? মাহতাব প্রশ্ন করল৷

- শ্যালকের অবশ্যি চাকরি হয়েছে ৷ এখন সে আছে কুয়েতে ৷ সেইতো কিছু কিছু পাঠাচ্ছে এখন ৷ কিন্তু তা দিয়ে ঐ মোটা অঙ্কের ঘাটতি তো আর পুরন করা যাচ্ছে না ৷ এখন ভদ্রলোক এর ঠ্যাঙের দড়ি উঠেছে গলায় ৷ বাল-বাচ্চা নিয়ে তার পথে বসা ছাড়া আর কোন পথ নেই ৷ ঐ নন্দিতা বিনয়ের সাথে বলল ৷

মাহতাব এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল ৷ তারপর নন্দিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রসাধন চর্চিত মুখখানি তার থম থম করছে ৷ তা দেখে মাতহতাব বলে উঠল, লেট মি সি টু ইট ৷ ইউ নিড নট বি ওরিড ৷



নন্দিতা সেদিনই বিকেল বেলা আনন্দিত মনে গজনফর আলীকে সংবাদটা পৌঁছে দিয়ে বলল, রাঘব বোয়াল এবার চারে মুখ দিয়েছে এবং বেশ ঠিক মতই বড়শির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ৷

গজনফর নন্দিতার সুখবরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল, দে দে বড়শিতে একবার মুখটা ওকে লাগাতে দে, তারপরই উরিব্বাস, কষে একটা হ্যাচকা টান ৷ তখন আর খলবলিয়ে পার পাবে না বাছাধন ৷ হেঁ হেঁ হেঁ....

নন্দিতা বলল, ঐ দশ হাজারের মধ্যে আমিও হাজার পাঁচেক বাগাতে পারি, কিন্তু তা আমি নিচ্ছি না ৷ তুমি আমার দুর্দিনের বন্ধু সে-কথা আমি কোন দিন ভুলতে পারব?

বলতে গিয়ে নন্দিতার নিজের বুকটার মধ্যেই ধ্বক করে উঠল ৷ তার চোখের সামনেই তার নিজের দেওয়া দৃষ্টান্ত টি যেন মুর্তিমান হয়ে উঠেছে ৷ একটি রাক্ষুসে বোয়াল মাছ, খুব বড় মুখের হাঁ মেলে ধীরে ধীরে গজনফরের দেওয়া টোপের দিকে এগিয়ে আসছে সুমিষ্ট খাদ্যের লোভে ৷ কিন্তু সে জানে না ঐ খাদ্যের সুদৃশ্য আড়ালে একটি ধারাল বড়শি লুকিয়ে আছে। ভাবতে ভাবতে নন্দিতার মুখখানি মলিন হয়ে উঠল ৷



নন্দিতার কাছে সুখবর পেয়ে গজনফরের মনের কালো মেঘটা সরে গেল ৷ প্রথম দিকে এই সাংঘাতিক খেলা খেলতে গিয়ে তার মনে যে আশঙ্কা ছিল না, তা নয় ৷ একটা বকরিকে হিংস্র ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচার ভেতর ঠেলে দেওয়া এবং আস্তই সেটা ফিরিয়ে পাওয়া চাট্টিখানি কাথা নয় ৷ তার নিজের মন্ত্রের যে জোর আছে তারই প্রমান পেয়ে গজনফর মনে মনে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল ৷ আর সেই হাসির আবেগেই গজনফর আলির ঘন ঘন পান-খাওয়া তেঁতুল বীচির মতন দাঁতগুলো পরিপূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠল ৷ হাসি মুখেই সে বলল, জেন্দা বাবার নেক দোয়ার বরকতে তুই যে সাক্সেসফুল হবি, সে বিষয়ে হান্ড্রড পারসেন্ট ভরসা ছিল৷


নন্দিতা অদেখা বাবার উদ্দেশ্যে দুটি চোখ বন্ধ করে, ষুক্ত কর কপালে ঠেকাল৷

নন্দিতার এই অভাবনীয় ভক্তিভাবটি লক্ষ্য করে গজনফরের বুকের মধ্যেও একটি ভক্তিভাব সহসাই সংক্রমিত হল ৷

জিজ্ঞেস করল, নন্দিতা, তুই বাবার আস্তানায়?

নন্দিতা অবাক মুখে প্রশ্ন করল, আমি ? আমাকে বলছ, দাদা?

- তোকে না তো কাকে? তুই ছাড়া এখানে আর কে আছে শুনি?

- কিন্তু আমি যে বিজাত, নফর দাদা!

গজনফার আবার মুখের তেঁতুল বীচগলো বের করে বলল, এইটেই তোর ভয়, তাই না? কিন্তু তুই জানিস নি কিনা, তাই তোর সন্দেহ জাগছে ৷ বাবার কাছে জাত-বিজাত নেই , বাবার কত হিন্দু মুরীদ আছে, জানিস?

- তাই নাকি?