Sunday, April 6, 2008

মুনিরা-৭

- হাঁ হাঁ, তারা আলাদা জায়গায় থাকে, আলাদা জিনিস খায় ৷ তাদের গরুর মাংস দেয়া হয় না ৷

নন্দিতা হেসে বলল, না না ওতে আমার অসুবিধা নেই ৷ গো মাংসে আমার অরুচি নেই, নফর দাদা!

গজনফর এবার তুড়ি মেরে বলে উঠল, তবে তো মিটেই গেল ৷ আবার কি যাবি তাহলে?

- তুমি নিয়ে যাবে?

- তুই যদি যাস তো নিয়ে যাব না মানে ? একশোবার নিয়ে যাব ৷

- যাব ৷ বলে নন্দিতা জেন্দা বাবার উদ্দেশ্যে আবার ভক্তিভরে দুটি হাত কপালে ঠেকাল ৷ এই পদ্ধতিটি গজনফরের আগে জানা ছিল না ৷ নন্দিতা কে ওটা বারবার করতে দেখে সেও যুক্তকর কপালে ঠেকিয়ে, চোখ বন্ধ করে বাবার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করল ৷



সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ন'টা অব্দি পথ-ঘাটগুলিতে নতুন প্রাণ-চাঞ্চল্যের পরশ লাগে ৷ বাস-ট্যাকসি-রিক্সার তুমুল শোরগোল ওঠে ৷ বুড়ো কাছিমের মতন পিঠঅলা মান্ধাতা যুগের চোখবোঁজা-বাসগুলো খুবলে খাওয়া-পিচঢালা রাজপথে হামাগুড়ি দেয় ৷ পেটের মধ্যে এবং কোলে-কাঁখে সাধ্যতীত যাত্রী নিয়ে ক্ষয়ে-যাওয়া অঙ্গ-প্রতঙ্গ ভর করে যখন বাসগুলি নড়তে-চড়তে শুরু করে, তখন তাদের সধ্যাতীত ত্রাহি আর্তনাদের শব্দ আকাশে-বাতাসে অঁও অঁও করে বাজতে থাকে ৷ নির্দয় বাস কাণ্ডাক্টররা মুরগী ভর্তি-খাঁচার মতন অফিস-যাত্রী বোঝাই করে নেয় ৷ দৃষ্টিতাদের পয়সার দিকে, গাড়ির বা যাত্রীর দিকে নয় ৷ বাদুড়-ঝোলা ঝুলে মানুষকে অফিস যেতে হয় ৷ জীবন রক্ষার তাগিদেই তো অফিস ছোটা ৷ ঐ ছোটা ছুটির মধ্যে জীবনের দামটির কথা কারুরই স্বরন থাকে না ৷ বরং জীবনটাই হয়ে ওঠে নিতান্ত তুচ্ছ ৷ ছোট্ট একটা হাতল ধরে জনা দশেক মানুষ ঝুলছে দরজার কাছে ৷ হাতলটা ছিড়ে কিংবা হাত ফসকে পড়ে গেলেই চিত্পাত ৷ তারপরেই কুপোকাৎ ৷ জীবন রক্ষার জন্যেই মানুষ জীবনকে কী আশ্চর্য রকম বাজি রাখছে ৷


এই দৃশ্য দেখতে দেখতে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল রওশন ৷ মাথায় গামছার ফ্যাটা বাধা হেলপারটা ঢক ঢক করে ছ্যাকড়া গাড়ির ওপর কিল দিচ্ছে আর চেল্লাচ্ছে বেদম ৷ চেল্লানির চোটে ওর গলায় খ্যারখেরে আওয়াজ উঠেছে ৷ হরেন, হরেন, মিয়াবাই, হরেন ৷ চাক্কার তলে পইরা গেলে, ফটা কইরা জব্বর একটা-আওয়াজ অইব ৷


একটা আওয়াজ মাত্র ৷ খুবই সংক্ষিপ্ত সেই সমাপ্তি আয়োজন ৷

কৌতুক ভরে ঐ মর্মান্তিক হুশিয়ারীটি শুনতে শুনতে রওশন রাস্তা পার হয়ে ওপারে উচু ফুটপাতে গিয়ে উঠল ৷ ডানহাতি কোণার দোকানটির নাম বাংলা অক্ষরে লেখা আছে হানিমুন ৷ দোকানের সুনাম হানিমুন রাখার পেছনে হাকীকতটা কী, রওশনের মাথায় ঢুকছে না ৷ শব্দ-প্রীতির নমুনা দেখ রওশন বেশ আশ্চর্য্য হল ৷ কিছুদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে এই বিষয়ে তার সম্যক ধারনা ছিল না ৷ রাস্তার দুপাশের দোকানের সাইনবোর্ড গুলিতে একুশে ফেব্রুয়ারী ষ্মৃতি দীপ্যমান ৷ বোডের ওপর থেকে ইংরেজী হরফ গুলো ভয়ে ভেগেছে ৷ সেখানে বাংলা হরফে ইংরেজী নামগুলি ঝকমক করছে ৷ রওশন একদিক থেকে পড়তে লাগল, রাইজিং সান স্টেশনারী, ইন্টিমেট হেয়ার ড্রেসার, সিজার্স ফাইট টেইলার্স, সিগমা ডেন্টাল ক্লিনিক, লিজা এন্টারপ্রাইজ, প্যানত্রাম স্টুডিও ৷ ধন্য তুমি বাংগালী! ধন্য তোমার সেই একুশে ফেব্রুয়ারী প্রীতি ৷


ধন্যবাদের এই অনুচ্চারিত শব্দটি মনে মনে আউড়াতে আউড়াতে রওশন কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে ডাইনের একাটি মাঝারি ধরনের বাই লেনে ঢুকে পড়ল ৷ বেশ কিছুদিন থেকে মাহতাবের সাথে তার দেখা হচ্ছে না ৷ মেজবুর শরীরটা চার পাঁচ দিন আগে খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল ৷ মাঝে মাঝে বুকের ব্যাথা সেই থেকে কমছে বাড়ছে ৷ হার্ট স্পেশালিষ্ট এর মনোভাব দেখে আন্দাজ হয়, তিনি অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছেন ৷ মেজবুর চোখে ও তা ধরা পড়েছে ৷ কিছুদিন থেকে মেজবু হোমীওপ্যাথি করার জন্যে চাপ দিচ্ছেন ৷ আহমদ আনসারীর ছেলেটির রোগমুক্তি দেখে, হোমিওপ্যাথির ওপর তাঁর বিশ্বাস টা মজবুত হয়ে উঠেছে ৷ আড়াই বছরের ছেলেটি বলা নেই কাওয়া নেই হঠাৎ দুম করে পড়ে খিঁচুনি শুরু করত ৷ মুখ ভর্তি ফেনা উঠত ৷ শহরের নাম করা সব ডাক্তারকেই দেখানো হয়েছিল ৷ কিছু হয়নি ৷ বাড়ির লোকেও ওর ভাল হওয়ার আশা ত্যাগ করেছিল ৷ ডাক্তাররা বলেছিল, এপিলেপ্সী ৷ বড় হলে সেরে যেতে পারে ৷ কবে বড় হবে আর কবে সারবে? ওর বাবা আহমদ সাহেব আত্মীয় স্বজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একজন হোমীও ডাক্তার দেখিয়েছিলেন ৷ ছেলেটি আজ এক বছর ধরে সম্পূর্ন সুস্থ আছে ৷ তাই দেখে মেজুবুর জিদ চেপেছে, তিনি হোমিওপ্যাথিই করাবেন ৷ রওশন সেই ডাক্তারের কাছেই গিয়েছিল ৷ ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট সেরে মাহতাবের বাসা হয়ে তার বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ৷


মাহতাবের বাসায় এলে রওশনের মনটা বিষাদময় হয়ে ওঠে ৷ মুনীরা চলে যাবার পর, এই বাসায় একটা সকরুন শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে ৷ সেই শূন্যতা রওশনের মনটাকে স্পর্শ করলে, ওর বুকের ভিতরে খাঁ খাঁ করতে থাকে ৷ মাহতাব শূন্যতাকে কেমন ভাবে গ্রহন করেছে সেই জানে ৷ রওশন নিজের মনের মধ্যে কেন যেন অনর্থক পীড়া অনুভব করেছে ৷ মুনীরা রওশনের বন্ধু-পত্নী ৷ তার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়া কিছুতেই সঙ্গত নয় ৷ কিন্তু মুনীরাকে দেখার পর অদ্ভুত একটা অনুভূতি রওশনের মনের ভিতর তোলপাড় করে উঠেছিল৷ অথচ মাহতাব এর বিয়ের প্রধান উদ্দোক্তা তো ছিল রওশন নিজেই ৷ যত দিন সে মুনীরাকে দেখে নি, ততদিন তার মনে কোনই ভাবনা জাগে নি ৷ লিবিয়া থেকে ফিরে যে দিন সে প্রথম মুনীরাকে দেখল, হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই রওশনের বুকটার মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠেল ৷ কী অসাধারন সুন্দরী! কী অনিন্দ্য সুন্দর নারী দেহ! রওশন এমনই অভিভুত হয়ে পড়েছিল , যে, মনে মনে সে চিন্তা করে দেখল, মুনীরার সাথে তার দেখা না হওয়াই ভাল ছিল ৷ অথচ সেই দেখাটা হয়েই গেল ৷ শুধু তাই নয়, বেশ কিছুদিন মুনীরার সান্নিধ্যে বসার, তার সাথে চোখা-চোখি হওয়ার উপলক্ষ্যও রওশনের জুটে গিয়েছিল ৷ কথাবার্তা বলার এবং মনের ভাব বিনিময়ের সুযোগ হয়েছিল৷ সেই কটি দিন রওশনের আনন্দ-বেদনা মেশানো এক অনুভূতি নিয়ে মনের মনি কোঠায় অম্লান হয়ে আছে ৷ রওশনের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছে ৷ রওশন প্রশ্ন করেছে, সে কি মুনীরাকে ভালবেসে ফেলেছে? মনের গভীর তলদেশে তার প্রশ্নের ইতিবাচক জবাবের অস্তিত্ব অনুভব করে সে লজ্জিত বোধ করল ৷ মুনীরাও কি রওশনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল? রওশন তার স্পষ্ট প্রমান কখনো পায় নি সে কথা ঠিক, কিন্তু একথাও তো সে অতল দীঘির মায়াবী মুগ্ধতা কেমন যেন সুম্পুর্ন মিথ্যে তো নয় ৷


রওশন এর বুক জুড়িয়ে সেই সময় ঝড়ো মেঘের ভয়ানক আনা গোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল ৷ প্রবল একটা ঝড় উঠব উঠব করছিল! সেই ঝড়ে রওশন হয়ত তচনচ হয়ে যেত ৷ কিন্তু সেই বিপদের হাত থেকে মুনীরা ওকে বাঁচিয়ে গেছে ৷ রওশকে সে সত্যি সত্যিই বাঁচিয়েছে ৷ মুনীরাকে খুঁজতে গিয়ে ওর বার বার তাই মনে হয়েছে, ওকে যেন আর কখনো না পাওয়া যায় ৷ সে-ই ভাল হবে ৷


টপটপ দুটো দুটো সিড়ি ভেঙ্গে রওশন তিন তলায় উঠে পড়ল ৷ মাহতাব বাসায় আছে বুঝতে পেরে ওর মাথার একরাশ ভাবনার কিলবিলে পোকা এক মুহুর্তের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে গেল ৷ মাহতাব বাসায় না থাকলে তার প্রমান স্বরূপ দরজায় একটা মস্ত বড়ো তালা ঝুলত ৷ মুনীরা যাবার পর ঐ তালাটা আমদানী হয়েছে ৷ এই মহুর্তে সেই চায়নিজ লকটিকে ঝুলতে না দেখে রওশন নিশ্চিত হয়ে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল একবার, দুবার, তিনবার ৷ না, কোন সাড়া শব্দ নেই ৷ আবার চাপ দিল বাতামে ৷ এবারও কোন সাড়া পাওয়া গেল না ৷ রওশন বিরক্ত মুখে ফিরে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় দরজার ফাঁকে রওশন দেখল, একজন তন্বী-তরুণী মুখ বাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ৷ মেয়েটির চোখ-মুখে ঘুম জড়ানো থম থমে ভাব জড়িত গলায় সে প্রশ্ন করল, কাকে চান? রওশন তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করল, মাহতাব বাসায় নেই?


-জ্বি না ৷

- কোথায় গেছে বলতে পারেন?

মেয়েটি ইতস্তত করে বলল, আমি তো ভাল জানি না ৷ আমাকে বলেও যাননি ওঁর স্টেনোর মায়ের নাকি খুব অসুখ ৷ মরনাপন্ন অবস্থা ৷ কাল রাতে একবার সে কথা বলতে শুনেছিলাম ৷ সেইখানেই গেলেন কিনা...

- তাহলে? প্রশ্ন করে রওশন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইল৷

জিনিয়াও সঠিক জবাব দিতে না পেরে চুপ করে রইল৷

দুমুহুর্ত নীরবতার মধ্যে কাটার পর জিনিয়াই মুখ খুলল, আপনাকে আমি কখনো দিখ নি ৷ তাই চিনতে পারছি না৷ আপনার পরিচয়টা দিয়ে যান, মাতু ভাই এলে বলব৷

রওশন সামান্য ইতস্তত করে বলল, মাহতাব এলে বলবেন, রওশন এসেছিল ৷ আমার নাম রওশন, মাহতাব আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, নাম বললেই সে চিনতে পারবে৷

- আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু? কই, মাতু ভাই তো সে কথা বলেন নি কোন দিন? আপনার নাম তার মুখে আগে তো কখনো শুনি নি?

- রওশন মৃদু হেসে বলল, আপনি বোধকরি অল্পদিন হল এসেছেন৷ তাছাড়া আমিও তো এখানে আজকাল বড় একটা আসি না৷ আমার সময়ই হয় না৷ তাই....

- জিনিয়ার মনে পড়ে গেল, বেশ কিছুদিন আগে এমনি একটা কন্ঠস্বর সে ড্রয়িং রুমে শুনেছিল৷ মাহতাব কেন যেন সেদিন ওকে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেননি৷

জিনিয়া বলল, দাড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসুন তাহলে৷

- মাহতাব কখন যে ফিরবে, তার তো কো ঠিক-ঠিকানা নেই৷ যদি জানতাম এতটা সময়ের মধ্যে আসবে, তাহলে না হয় অপেক্ষা করা যেত৷

- তা ঠিক, সময়টা মাতু ভাই নির্দিষ্ট করে বলে যান নি৷ জিনিয়া বিনীত মুখে হাসল৷

রওশন বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, আজ চলি ৷ অন্য এক সময় আসব ধন্যবাদ৷

জিনিয়া সালাম দিয়ে হাসি মুখে রওশনের বিদায় পথের দিকে তাকিয়ে রইল ৷ রওশন হন হন করে সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগল ৷ কিন্তু দশ বারোটা সিড়ি নীচে নেমেই আবার সে থমকে দাড়াল৷ তারপর আবার উপরে উঠে এলো৷ জিনিয়া এতক্ষণ দাড়িয়েই ছিল৷ ওকে ফিরতে দেখে মৃদু হাসিতে ওর দুটি চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷


রওশন বলল, আবার আমাকে ফিরে আসতে হল্ কিছু মনে নেবেন না৷ আমার তো পরিচয় দিলাম, কিন্তু আপনারটা তো আমার জানা হল না৷ বলেই রওশন মনে মনে দারুণ লজ্জা অনুভব করল৷ ভাবল, মেয়েটির পরিচয় নেওয়ার কী অধিকার তার আছে? চিন্তাটা আগে ওর মাথায় আসে নি৷ এলে নিশ্চয়ই সে এমন ভাবে ফিরে আসত না ৷


জিনিয়ার মুখ দেখে রওশনের মনে হল, ওর কথায় সে মনে কিছু করে নি মানুষের বিরক্তিটা চেহারায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে ৷

জিনিয়া হাসি মুখে বলল, আমার কী পরিচয় আছে যে দেব, বলুন্

- আপনি কি মাহতাবের বোন?

জিনয়া সামান্য ইতস্তত করে জবাব দিল, হ্যাঁ৷

- ও, তাই? আচ্ছা আচ্ছা, আসি তাহলে ৷ বলেই এবার বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে রওশন টপাটপ সিড়ি ভেঙ্গে নীচে নামতে লাগল৷ সিড়ির বাঁক নেওয়ার মুখে এসে পৌছতেই ওর সাথে মাহতাবের মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল৷

- মাহতাব ওকে দেখে খুশী হয়ে উঠল ৷ বলল, কিরে এতদিনে তোর মনে পড়ল?

- মেজবুর শরীরটা বড্ডো খারাপ হয়ে যাচ্ছেরে ৷ ওকে নিয়ে দারুণ মুছিবতে আছি ৷ বড় বড় হার্ট স্পেশালিস্ট দিয়ে কিছু হল না৷ এখন মেজবু ঐ সব ওষুধপত্তর আর ছুতেই চাচ্ছেন না ৷

- তাহলে কী করবেন?

- বলছেন, হোমিওপ্যাথি করাবেন৷

- এ ড্রাউনিং ম্যান ক্যাচেস এট এ স্ট্র ৷ দেখ, হোমিওপ্যাথি করে কী হয়৷

রওশন বলল, তা বলে নয় রে৷ আজকাল হোমিওপ্যাতিথে মারভেলাস ট্রিটমেন্ট হচ্ছে৷

- মেজবুকে নিয়ে গিয়েছিলি নাকি ডাক্তারের কাছে? মাহতাব প্রশ্ন করল৷

- না, নিয়ে যাব কি? গেলেই সাথে সাথে চান্স পাওয়া যায় নাকি? দারুণ ভীড়৷ প্রথমে এপয়েন্টমেন্ট করে ফিরছি ৷ ফেরার পথে ভাবলাম তোর সাথে দেখাটা করেই যাই ৷

- ভালই করেছিস চল বসে বসে কথা বলি ৷ বলেই মাহতাব কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে লাগল ! বলল, বাসায় গিয়ে কী হবে? বাসায় তো সেই মেয়ে লোকটা নেই ৷ তারচে চল রেস্টুরেন্টে বসে একটু চা খাই আর কথা বলি৷

রওশন মাহতাব কে চমকে দিয়ে বলল, কেন বাসায় তো মানুষ আছে দেখলাম৷

- কে ? মাহতাব শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করল৷

- একজন তরুনী ৷ বলল, তোর নাকি বোন হয়৷

-ও, জিনিয়ার কথা বলছিস ? ঘুম থেকে তুই ওকে ওঠাতে পারছিস ? আরে বাবা, তুই দেখছি অসাধ্য সাধন করেছিস৷ ঐ ছুঁড়িটা যা ঘুম-কাতুরে ওকে ডেকে জাগানোই এক মস্ত বড় ফ্যাসাদ ৷ তা যদি জেগে থাকে তাহলে চল বাসাতেই বসি৷

দুজন ওপরে উঠে এলো ৷ মাহতাব কলিং বেলের বোতাম চাপ দিতেই সাথে সাথে জিনিয়া দরজা খুলে দিয়ে বলল, এই মুহুর্তে তোমার এক বন্ধু এসে চলে গেলেন... হঠাৎ রওশনের দিকে চোখ পড়তেই বলল, ও দেখা হয়েছে তাহলে? আসুন ভেতরে আসুন ৷ বলে জিনিয়া ওদের পথ ছেড়ে দিয়ে দরজার একপাশে গিয়ে দাড়াল ।


ঘরে ঢুকে মাহতাব সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, আমার স্টেনোটার মার সাংঘাতিক অসুখ ৷ তাই একটু দেখা করতে গিয়ে ছিলাম ৷

-স্টেনোর নিজের নয় , তার মার অসুখ? তাঁকেই তুই দেখতে গিয়েছিল? রওশন প্রশ্ন করল৷

- কেন, দোষটা কি? মানবতা বলে একটা কথা আছে না?

-তা তো আছেই ৷ তোর স্টেনোটা পুরুষ না মহিলা?

মাহতাব তড়াক করে সোজা হয়ে উঠে বসল ৷ বসে বলল, শালা তোর বাঁকা চিন্তাটা মগজ থেকে আর গেল না দেখছি৷

রওশন কৃত্রিম গম্ভীর মুখে বলল, আরে বল না শুনি ! মহিলা নিশ্চয় ৷ কী বলিস?

মাহতাব প্রশ্নর জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চা খাবি, না কফি?

রওশন নির্লিপ্ত মুখে বলল, না আমার কিছুই লাগবে না৷

ওদের কথার মাঝখানে হঠাৎ জিনিয়া এসে দাড়াল৷ মাহতাবকে সে প্রশ্ন করল, মহিলাটি কি মারা গেছেন, মাতু ভাই ?

মাহতাব অনেকটা উপেক্ষার ভঙ্গিতে বলল, না ৷ তারপর জিনিয়াকে এড়িয়ে রওশনকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেসা করল, কিরে , কি খাবি বল৷

- বললাম তো কিছুই লাগবে না৷ তোর তো ঘরে মানুষ নেই, চাকর বাকরও সব পালিয়েছে ৷ হাঙ্গামা করে লাভ নেই৷

জিনিয়া দাড়িয়েই ছিল কথাটা লুফে নিয়ে হাসি মুখে বলল, চাকর বাকর না থাকুক আমি তো আছি৷ কী খাবেন, বলুন না ৷ চা-কফি যা চান আমি ঠিক পছন্দমতই বানাতে পারব ৷ কিচ্ছু অসুবিধা হবে না ৷

- ধন্যবাদ ৷ কিন্তু সত্যি সত্যি বলছি আমি চা নাশতা সেরেই পথে বেরিয়েছি ৷ আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনা৷

জিনিয়া আব্দার করে বলল, তা কি কখনো হয় ? মাতু ভাই বাসায় ছিলনা বলেই তো তখন আমি জোড় কারি নি ৷ আপনি বাসায় এসে খালি মুখে যাবেন, সেটা কি সম্ভব ? শীগগীর বলে ফেলুন। না বললে ,ওরে আমার যা খুশি হবে, আমি তাই নিয়ে আসব কিন্তু ৷

ওরশন এবার উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠল৷ বলল, ওরে বাপরে , দারুন নাছোড় বান্দা দেখছি আপনি ? আচ্ছা, আনুন আনুন ৷ আপনার যা খুশি তাই আনুন, তাই ভাল জিনিয়া খুশি মনে লীলায়ীত ভঙ্গিমায় ভেতরে চলে গেল ৷

তার যাওয়ার দিকে মুহুর্ত খানিক দৃষ্টি রেখে রওশন প্রশ্ন করল, তোর যে একটা বোন আছে, সে কথা তো কখনো বলিস নি মাহতাব?

- তেমন প্রসঙ্গ উঠেছে বলে মনে হয় না ৷ মাহতাব নির্লিপ্ত মুখে জবাব দিল৷

- বলিস কী? প্রসঙ্গ ওঠে নি মানে ? তুই তো সব সময় বলে আসছিস, তিন-কুলে তোর আপন বলতে কেউ নেই...

- আপন যে আছে এখনো কি বলেছি?

-তাহলে তাহলে এই মেয়েটি তোর কে ?

মাহতাব তেমনি নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিল, সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন৷

মুনীরার অন্তর্ধানের পর মাহতাব তার আপন নয়, চাচাতো বোনকে এনে বাসায় রেখেছে এবং সে কথাটি রওশনের কাছে আজও পৌঁছানি, ব্যাপারটি রওশনের কাছে গভীর রহস্যময় ঠেকেছে ৷ অথচ এই মেয়েটি কোন সাধারন মেয়ে নয়৷ কথাবার্তায় আচার আচারনে বিদূষী বলে ধারনা করতে একটুকুও অসুবিধা হবে না৷ বিষয়টি একটু ভাবনা-চিন্তার পর, রওশন ঐ ডেলিকেট প্রসঙ্গটাই চাপা দিয়ে গেল ৷ আর সে ঘাঁটাল না৷ মুখে শুধূ বলল , তাই বল্ ৷ আমি আবার ধরে নিয়েছিলাম , তোর আপন বোন-টোন হবে বোধ হয় ৷


মাহতাবের মনের ওপরকার গুরুভারটা রওশনের কথার পর খানিকটা হালকা হয়ে গেল ৷ আরও স্বচ্ছন্দ হবার মানসে বলল, তুই তো আগেও জানতিস , আমার আপন ভাই বোন কেউ নেই৷ ও হচ্ছে হেড স্যারের মেয়ে ৷ আমার বোনের মতই৷ নাম ওর জিনিয়া ৷ ঢাকা থেকেই পড়াশুনা করছে৷ গোলমাল হয়ে কলেজ-টলেজ সব বন্ধ এখন কী করবে? বাকস -পেটরা নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছিল ৷ তা দেখে আমি বললাম, তোর সেই একশো নব্বুই মাইল পথ মাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তোকে আসতে হবে৷ তারচে তুই এক কাজ কর এখানেই থেকে যা ৷ তোর ভাবী নেই কাজের ছোঁড়াও পালিয়েছে৷ একটু হেলপ হলেও হবে৷ ও থাকতে হেজিটেট করছিল৷ আমিই প্রেসার দিয়ে বললাম, তোর হতভাগা ভাইটা এখানে খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করবে, আর তুই বাড়িতে গিয়ে মজা করে খাবি৷ শুনে ও নরম হয়ে গেল৷ যে ভাত রাধার ভয়ে পালাতে চেয়েছিল৷ এখন দিব্যি সেই ভাত রাধা, তরকারী রাধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ৷ সময় মত চা-টা কফিটাও বানাচ্ছে ৷ দেখলি তো কেমন প্রম? তবে ভারী ঘুম কাতরে ৷ দরজা লাগিয়ে একবার শুল কি মরল৷ ভুমিকম্পে সব ওলট-পালট হয়ে গেলে ও ওর সেই কুমভকর্ণ-নিদ্রার কোন ব্যত্যয় হবে না৷ ওর ভাব-চক্কর দেখে আমিও বলে দিয়েছি, রাত্রির বেলায় তুই তোর ঘরে খিল দিয়ে ঘুমাবি ৷ আমার ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা মারা থাকবে ৷ খবার-দাবার সব টেবিলে রেখে যাবি। সুবিধা মত আমি বাইরে থেকে এসে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ব একথা গুলো বলতে পেরে মাহতাব খুবই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে লাগল৷


রওশন গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনল৷ শুনে বলল, এখন তোর ঐ সব কাহিনী রেখে দে৷ যেটা জানতে এসেছি, সেইটা আগে বল৷ তোর বৌর খবর বল৷ তার খোঁজ-টোজ কি কিছু পেলি?

- উঁহুঁ, পাই নি৷ মাঝখানে একদিন ও ভাই এসেছিল ৷ আরে বাবা, বোনকে না পেয়ে রেগে মেগে একেবারে ফায়ার ৷ আমাকে ভয় দেখিয়ে শাসিয়ে গেছে, সে নাকি আমার জিভ উপড়ে ফেলবে৷ ফেলুক না একবার দেখি , কেমন কেমন বাপের বেটা ৷

- ওর ভাই তাহলে কোন কিছু জানে না মনে হচ্ছে?

মাহতাব খানিকটা হতাশা ব্যাঞ্জক সুরে বলল, তাই তো মনে হচ্ছে ৷

রওশন এক মুহুর্তে কী যেন ভবল৷ তারপর বলল, বৌকে তুই তাহলে ছেড়ে দিলি নাকি?

মাহতাব ঝটপট পাল্টা প্রশ্ন করল, ছেড়ে দিলে কি তুই নিকে করে নিবি নাকি? নিলে বল্ দিই ছেড়ে ৷ বলে সে দাঁত বার করে হাসতে লাগল৷

সে-হাসিতে যোগ না দিয়ে রওশন ক্ষোভে মেশানো গলায় বলল, তোর রসিকতা বড্ডো স্থুল রসিকতা, বুঝলি মাহতাব ?
মানুষটা তুই জাত-বেহায়া । তুই কি ভুলে গিয়েছিস যে তোর বিয়ের প্রধান উদ্দোক্তাই ছিলাম আমি ৷ বিয়ে করতে চাইলে তো আগেই চাইতে পারতাম ৷

- তোর তখন পছন্দ হয়নি না?

রওশন সোজা-সুজি জবাব দিল, না হয় নি৷

- কিন্তু তুমি শালা সে কথা গোপন করে গেছ ৷ চালাক আদমী তো ৷ কিন্তু পছন্দ হয় নি কেন রে? প্রথম দৃষ্টিতে তো দারুন পছন্দ হওয়ার কথা ! তোর চোখ, মালা, চোখ তো নয়, একেবারে একস-রে ৷ ও যে ধমান্ধ-ফ্যানাটিক, তুই আগে বাগেই টের পেয়েছিস, তাই না?

রওশন কোন প্রত্যুত্তর করল না ৷ সে-যে আগে কখনো মুনীরাকে দেখে নি, সে-কথাটি মনের মধ্যেই গোপন করল৷
জিনিয়া গাছ -কোমর করে শাড়ী পরে, দুহাতে একখানি ট্রে নিয়ে ওদের সামনের টি-টেবিলে রাখল৷ মাহতাব পিরিচ থেকে এক ষ্লাইস কেক তুলে নিয়ে রওশন কে বলল, নে নে, শুরু কর৷

জিনিয়া চলে যাচ্ছিল , রওশন তাকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি চলে যাচ্ছেন যে! আপনি ও আসুন ৷ জিনিয়া থমকে দাড়িয়ে ফিরে তাকাল৷ হাসি মুখে বলল, আমি তো এখন খাব না ৷ আপনারা খান৷

-কেন, খাবেন না কেন?

-আপনাদের সাথে খেতে গেলে লজ্জা লাগবে না?

- বা রে , লজ্জা লাগবে কেন? খাওয়া ছাড়া আর কী হচ্ছে যে, লজ্জা লাগবে?

জিনিয়া হেসে উঠে বলল, আপনাদের সামনে গিলতে থাকব, আর আপনারা গলা দিয়ে কেমন করে খাবার নামছে , তা যদি পরখ করে দেখতে থাকেন, তখন? সে একাটা ভারি বিশ্রী ব্যাপার হবে না?

মাহতাব এই রকম রঙ্গ-রসিকতায় ভেতরে ভেতরে একটু বিরক্ত হয়ে উঠছিল ৷ বলল, ঐ সব তোর ভ্যান-ভ্যানানি রাখ তো ৷ বসিস তো বসে যা, আর না বসিস তো ভাগ এখান থেকে ৷

রওশন বলল, কেন, ভাগবে কেন,

- খাবেও না ভাগবেও না, তো কী করবে? ভেরেন্ডা ভাজবে নাকি? তাকিয়ে থাকলে, শালা, পেটে অসুখ হয়ে যাবে না?

জিনিয়া সর্বাঙ্গ ভরে খিল খিল করে হেসে উঠল৷ বলল, ঠিক ধরেছে মাতু ভাই, আমাদের ভাবী নেই ঘরে ৷ পেট টেট ডিসঅর্ডার হয়ে গেলে শেষে ডাক্তার-কোবরেজ, পথ্যাপথ্য করতে গিয়ে আমারই জ্বালা বাড়বে৷ ডাইনীটার শীগগীর ভাগাই ভালো ৷ বলে তেমনি হাসতে হাসতে দ্রুত পায়ে সে অন্য ঘরে পালিয়ে গেল৷


মাহতাব কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, মুজাফফর যেরকম রেগে গিয়ে ছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, একটা বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড না বাধিয়ে হয়ত সে ছাড়বে না৷ এমনি দেখতে তো ঠিক ভ্যাদা মাছ, কিন্তু জানিস তো ভ্যাদা মাছই জাল ছেঁড়ার যম ৷ ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমার মনে হচ্ছে, সে ওর ভাই-এর বাড়িতেই গিয়ে উঠেছে৷ না হলে একটা কিছু করত না সে ব্যাটা ? তোর কী মনে হয়?


রওশন কোন মন্তব্য করল না৷ হাতের কাপটি পিরিচের ওপর আস্তে করে নামিয়ে রাখল৷

মাহতাব বলল, করুক না যা করবার৷ আমি ও কি ছেড়ে দেব নাকি ভেবেছিস? ছেড়ে দেবার ছেলে আমি নই। পৃথিবীটা কার? পৃথিবীটা টাকার। বুঝেছিস?

রওশন কী একটা কথা বলবার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহুর্ত টং করে কলিং বেলটি বেজে উঠল ৷ রওশন কথা না বলে মাহতাব এর মুখের দিকে তাকাল৷ মাহতাব উঠে গিয়ে দরজার সিটকানিটা খুলে দিল৷ একজন মাঝ-বয়সী লোক দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি জনাব মাহতাব উদ্দীন সাহেবের বাসা?

-জি হ্যাঁ৷ মাহতাব জবাব দিল,

- তাঁর সাথে একটু দরকার ছিল৷ দেখা হবে কি?

- জি, বলুন৷

- আপনিই কি মাহতাব উদ্দীন সাহেব?

- জি হ্যা ৷

- আপনার সাথে বসে একটু আলাপ করতে চাই ৷ বলেই ভদ্রলোক একটু নিরিবিলি জায়গার সন্ধান করতে লাগলেন৷

ভদ্রলোক ইতস্তত করতে করতে আসন গ্রহন করলেন, মাহতাব কাপে কফি ঢেলে তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নিন্, একটু কফি খান৷

ভদ্রলোক আপত্তি করে বললেন, ধন্যবাদ, আমি চা কফি খাই না৷

মাহতাব এবার জিজ্ঞাসু চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল৷

ভদ্রলোক রওশনের উপস্থিতির কারণে একটু উসখুস করতে লাগলেন ৷ তারপর বিচিত্রভাবে চারিদিকে দৃষ্টি ফেলে দেখে নিয়ে বললেন, আমি এন্টিকরাপশন থেকে আসছি৷ সি, আই, বুরো অব এন্টিকরাপশন থেকে আসছি৷


মাহতাব বলল ও, আচ্ছা আচ্ছা ৷ দরকারটা বলুন৷ ভদ্রলোক এক মুহুর্ত চুপ করে রইলেন৷ তারপর বললেন, আমরা জানতে পেরেছি আপনি মাহতাব উদ্দীন আহমদ, আজ সকালে এন, টি, আর এর নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে দশ হাজার টাকার অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছেন৷


ভদ্রলোকের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই দরজার সামনে জন তিনেক সশস্ত্র পুলিশ এসে দাড়াল৷

ভদ্রলোক বললেন,আপনার বাসা তল্লাশির আগে আপনার শরীর তল্লাশি করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত ৷

এই ধরনের কথা শুনে রওশনের মেজাজটা খিচড়ে উঠেছিল ৷ সে প্রবল আপত্তির জন্যে তৈরী হতে গিয়ে মাহতাবের মুখের দিকে চোখ পড়তেই সহসা মিইয়ে পড়ল ৷

মাহতাব কতকটা আড়ষ্ট গলায় বলল, আমি যে অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করেছি, তার প্রমানটা কি?

ভদ্রলোক কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, প্রমান অবশ্যই আছে ৷ অবৈধ টাকা গুলির প্রত্যেকটি নোটে আমাদের দস্তখত রয়েছে৷

মাহতাব উদ্ভ্রান্তের মতন ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷

ভদ্রলোক বললেন, টাকাটা যদি সঙ্গে থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের বের করে দিন৷ এক্ষুণি আমরা প্রমাণটা আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি ৷ আপনি শিক্ষিত মানুষ৷ আশা করি আমাদের সহায়তা করতে আপত্তি করবেন না৷ আমরা অযথা আপনাকে বিব্রত করতে চাই না ৷

রওশন আর চুপ করে থাকতে পারল না৷ সে মুখ খুলল, একজন সমভ্রান্ত মানুষকে নিয়ে আপনি এ কী যা তা কাণ্ড শুরু করেছেন?

ভদ্রলোক রওশনের কথায় কোনই কর্ণপাত করলেন না৷ মাহতাবকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন, দেরি করছেন মনে হচ্ছে ৷

মুহতাব এবার বাইরে দাড়িয়ে থাকা বন্দুকধারীদের দিকে কাতর চোখে তাকাল ৷ তারপর কম্পিত হাতে প্যান্টের হিপ পকেট থেকে নোটের কয়েকটি তোড়া বের করে ভদ্রলোকের সামনে ধরল৷

ভদ্রলোক বললেন, টেবিলের ওপর রাখুন৷

মাহতাব টাকার বাণ্ডিল কটি টেবিলের ওপর রেখে পাংশু মুখে বসে রইল৷ ভদ্রলোক একটার পর একটা নোট দেখিয়ে বললেন৷ এই যে দেখুন প্রত্যেকটি নোটে আমাদের দস্তখত৷ এগুলো নেবার সময় দস্তখতটি নিশ্চয়ই আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে৷ বলে ভদ্রলোক আবার কাষ্ঠ হাসি হাসলেন ৷ তারপর বললেন, দেখুন, এরপর আপনাকে আমরা আর কাস্টোডিতে না নিয়ে পারি না৷ আপনার ছোট খাটো কোন প্রস্তুতি থাকলে সেটা সেরে তৈরী হয়ে নিন ৷


মাহতাব কাতর চোখে চারদিক দেখে নিল ৷ অস্বস্তি ও অস্থিরতার মধ্যে নন্দিতার কথা তার মনে পড়ে গেল৷ নন্দিতার ষড়যন্ত্রের কথা ধাঁ করে মাহতাব বুঝে ফেলল৷ একটা বিশ্বাসঘাতিনী মেয়েলোক তাকে ডোবানোর জন্যে বহু দিন ধরে এই ভাবে গভীর গর্ত খুড়েছে ৷ আর এই ভাবে গজনফরের অভিলাষও এবার পূর্ন হয়েছে৷ চোখ দুটি তার ছলছল করে উঠল৷


মাহতাবের সমস্ত দুনিয়া এক মুহুর্তে বিষবাষ্পে ভরে গেছে৷ চারদিক থেকে অন্ধকার ঘিরে আসছে৷ টাকা কড়ি, ধন দৌলত, স্বাস্থ্য যৌবন, জ্ঞান গরিমা সবই যেন এই মুহুর্তে বাতাসের তোড়ে শুকনো তুলোর মতন শূণ্যে উড়ে যাচ্ছে ৷ কোন কিছুই আর আবশিষ্ট থাকবে না৷৷


ইন্সপেক্টর সাহেবের সাথে যাবার সময় মাহতাব আশ্চর্য্য রকম শান্ত ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ একটিবারও সে আর পেছন ফিরে চাইল না৷


রওশন ও জিনিয়া শুষ্ক মুখে দরজার সামনে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সেই দৃশ্যটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে রইল৷


সকালের রোদ্দুর দক্ষিণের জানালা দিয়ে খাটের উপর এসে পড়েছে৷ মাস তিনেক বয়েসের একটি কচি শিশু সেই মিষ্টি রোদের ওমে চুপ করে শুয়ে আছে। ছোট্ট একটি গোলাপী রঙের নাইলন নেটে ঢাকা আছে তার শরীর ৷ চোখের কাজল লেপ্টে লেগে আছে তার গালে, চিবুকে৷ বুকের ওপর পাতলা একখানি নকসি কাথা৷ মাথায় গাঢ় লাল রঙের পশমী টুপী৷ টুপীর ঘের উপচে কালো কোকড়ানো চুলে কপাল পর্যন্ত ঢেকে আছে। পৌঁষের এই দাঁতালো শীতে খুব সকালে ওর কচি মুখখানি কালচে ছিল৷ এখন মিষ্টি রোদের ছোয়ায় তা গোলাপী হয়ে উঠেছে৷


মুনীরা এতক্ষণ শিশুটির মুখের দিকে অনিমেষে তাকিয়েছিল৷ ফুটফুটে চেহারা ৷ মুখটি যেন একটা সদ্য ফোটা ইরানী গোলাপ৷ ঘুমের আগে কিছুক্ষণ ধরে মায়ের দুধ খেতে গিয়ে মুখ ঘষেচে বলে চোখের কাজল গেছে ধেপড়ে ৷ গালে মুখে সে কাজল ছাড়িয়ে পড়ে চেহারাখানি ভারি অদ্ভুত করে তুলেছে৷ সেটা চোখে পড়তেই মুনীরার ঠোটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল৷ ধীরে ধীরে সে খাটের ওপর উঠে গেল৷ তারপর হামাগুড়ি দিয়ে শিশুর কাছে গিয়ে মশারিটি গুটিয়ে দিল৷ অসাবধানতায় শরীরে একটু স্পর্শ লাগতেই শিশুটি চমকে উঠল৷ মুনীরা ওর কাছে শুয়ে, বুকের কাছে ওকে টেনে নিয়ে, খুব আস্তে আস্তে থাবা দিয়ে , বাবা বাবা বলে আদর করতে লাগল৷ মায়ের হাতের কোমল স্পর্শে শুভ্র শিশুটি আবার নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ আঁচলের প্রান্ত দিয়ে খুব সন্তর্পণে মুনীরা শিশুটির লেপ্টে যাওয়া চোখের কাজল মুছে মুছে পরিপাটি করে তুলতে লাগল৷


আপন দেহের মধ্যে যার প্রথম অস্তিত্বের খবার পেয়ে মুনীরা হতচকিত হয়ে উঠেছিল, যার প্রাত্যহিক অস্তিত্ব মরমে মরমে উপলদ্বি করে দেহ মন ব্যথা রোমাঞ্চের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল, এই মুহুর্তে তার মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে মুনীরার হৃদয় সীমাহীন আনন্দ ও বেদনায় পরিপূর্ন হয়ে উঠেছে ৷ মাহতাবকে মুনীরা বাধ্য হয়েই ছেড়ে এসেছে৷ তার দুর্ব্যবহারের কথা মনে করে , মুনীরার সর্বাঙ্গ এতদিন বিষে জর্জরিত বলে মনে হয়েছে। আজ সেই মাহতাবের সন্তানকে বুকে নিয়ে , মুখে চুমো দিতে গিয়ে, মাতৃত্বের সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দিতে গিয়ে মুনীরার প্রতিটি মুহুর্ত যেন আনন্দ শিহরনের ভরে উঠেছে৷


মুনীরার গায়ে একখানি ঘিয়ে রঙের কাশ্মিরী শাল জড়ানো৷ দুদিন হাড় কাপানো শীতে পড়েছে৷ কুয়াশা কাটা রোদেও সেই শীত কাটতে চাইছে না৷ মায়ের বুকের মিষ্টি ওম না পেলে শিশুর জুত্সই ঘুম হয় না৷ চট করে জেগে ওঠে৷ তা পা ছুড়ে গায়ের কাথা কাপড় লাথি মেরে মেরে ফেলে দেয় ৷ ভারি দুষ্ট ৷ মুনীরা মনে মনে ভাবে আর মৃদু হাসির আভায় চোখ মুখ তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷


ঘুমন্ত শিশুটির কাছে কাৎ হয়ে শুয়ে মৃদু মৃদু হাত বুলাতে থাকে মুনীরা৷
মায়ের বুকের ওমে শিশুটিরই যে পরম পরিতৃপ্তির ঘুম আসে, শুধু তাই নয়, মায়েরও বুকের ভেতরে অপুর্ব এক মধুর অনুভুতি শির শির করতে থাকে৷ মুনীরা ওকে আরো কাছে টেনে নেয়৷ আরো নিবিড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ৷


আসমা বেগম নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে মা ও ছেলেকে ঐ ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কয়েক মিনিট চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইলেন৷ একটু সুক্ষ গুন-গুনানি শব্দ শিউলী ফুলের গন্ধের মতন ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে৷ অত্যন্ত মিষ্টি আমেজ ঝরছে মায়ের ক্ষীণ কন্ঠের-ঘুম পড়ানি গানের ভেতর দিয়ে ৷ আসমা বেগম ফিরে যেতে চেয়েছিলেন ৷ কিন্তু পায়ে কী একটা ঠেকার আওয়াজে মুনীরা চমকে উঠল৷ ঘাড় তুলে তাকিয়ে বলল, কে, ভাবী?


- ঘুমুস নি মনি? ভাবছি বুঝি ঘুমিয়ে গেছিস৷

- না ঘুমাই নি৷ বাবু জেগে উঠবে ভেবে থাবা দিচ্ছি৷

- দে, আমি এখন যাই৷ বলে আসমা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন৷

মুনীরা জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে ওটা কী?

আসামা বেগম থমকে দাড়ালেন৷ বললেন, খবরের কাগজ ৷ একটা খবর তোকে দেখাব ভেবে এসেছিলাম ৷

- আমাকে ? মুনীরা সন্তর্পণে উঠে বসল৷ কী খবর দেখাবে?

আসমা বেগম ফিরে এলেন৷ এই দ্যাখ বলে একটি দাগ দেয়া বকস করা খবর দেখিয়ে, কাগজখানি তিনি মুনীরার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ সেখানি হাসি মুখে হাতে নিয়ে পড়তে গিয়েই মুনীরার সাহসা বিবর্ণ হয়ে উঠল৷

আসমা বেগম ওর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, দেখিছিস তো, পাপ বাপকেও ছাড়ে না৷ লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ৷

মুনীরা কম্পিত হাতে কগজখানি আসমা বেগম কে ফেরত দিল৷ তারপর নির্বাক মুখে চুপ চাপ বসে রইল৷

আসমা বেগম স্বগতোক্তির মতন বলতে লাগলেন, অন্তর দিয়ে যাকে স্নেহ করতাম, ভালবাসতাম, সেই মানুষ এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল৷ এই অন্যায়, এই পাপ কি সহ্য হয় ? বিচার না হয়ে যায়? যাগ গে সে কথা ৷ যাতে করেছি ছি, তাতে আর আছে কী ৷ বলে আসমা বেগম মুনীরার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলেন৷ মুনীরার চুখ দুটো ছল ছল করছে৷ আসমা বেগম এর ধারনা ছিল না, যে, মাহতাবের এরেষ্ট হওয়ার খবর শুনে মুনীরা ব্যাথা পাবে ৷


বরং তিনি মনে করেছিলেন, একজন দুরাচারী মানুষের শাস্তির খবর শুনিয়ে তিনি মুনীরার কলিজাটি শীতল করে দেবেন৷ অথচ বিপরীত অবস্থাটি দেখে নিজেই তিনি লজ্জিত হয়ে পড়লেন৷ এক মুহুর্ত কী ভাবলেন তারপর বললেন, খবরটায় চোখ পড়ে গেল বলেই তোকে দেখালাম ৷ নইলে ওর খবর পড়তেও আমার ঘেন্না করে ৷ এখন সে এরেস্ট হোক জেলে যাক, যে যেমন তার তেমন শাস্তি হোক তা নিয়ে আমাদের আর মাথা ব্যাথা নেই৷


মুনীরার বুকের ভেতরে ধক করে উঠল৷ ওর চোখের সামনে বড় বড় হরফে জ্বল জ্বল করছে, ঘুষ গ্রহনের দায়ে হিসাব নিরীক্ষা অফিসার গ্রেফতার ! কানের ভেতর ধ্বনিত হতে লাগল , এরেস্ট হোক, জেলে যাক, যে যেমন তার তেমন শাস্তি হোক, তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই৷ কিন্তু এই শিশুর? মরুক বাঁচুক, জেলে যাক সে যে ওর বাপ ওর আত্মাপরিচয়৷ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি পদক্ষেপে ওই মানুষটিই যে ওর পরিচয়ের উত্স৷ মুনীরার নাড়ী ছেড়া ধন এই শিশুর সেই-ই তো সব! ভাবতে গিয়ে মুনীরার বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠল৷ চোখ দুটি জ্বালা করে অশ্রু গোপন করে নিল৷


আসমা বেগম এত সব কিছুই বুঝলেন না৷ শিশুটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাবু যে বেদম ঘুমুচ্ছে রে৷ দুধ খাইয়েছিস তো?

শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে মুনীরা বলল, ঘুম থেকে জাগেই নি দুধ খাওয়াব কি?

আসমা বেগম বললেন, বাবু কিন্তু ভারী ঠান্ডা রে, মনি৷ ঐ বয়সে খসরুটা কী ভীষণ জ্বালাত! দিন-রাত্রির এক-নাগাড়ে ট্যাঁ ট্যাঁ করত ৷ তোর কি মনে নেই? বাবু কিন্তু একটুও কাঁদে না ৷ ব্যাপারটা কী জানিস? খসরূ আমার বুকের দুধ পেত না৷ ডিব্বার দুধ খাইয়ে রাখতে হত কিনা, সেই জন্যেই ঐ রকম করে কাঁদত৷ আর বাবু তো অঢেল দুধ পায়৷ কাঁদবে কিসের জন্যে? আমার মনে হচ্ছে, ওর ডিব্বার দুধ লাগবেই না৷ তোর কী মনে হয় ৷


মুনীরা মৃদু হেসে বলল, দুধ তো আছে এখনও ৷ পরে কী হয়ে, কী করে বলব?

-দুধ যার হয়, তার শুরুতেই হয়৷ তোকে তো ওষুধ-পত্তর খেতে হয় নি৷
ওষুধ-পত্তর খেলে দুধ শুকিয়ে যায়৷

ওদের কথার মাঝখানে ছোট্ট শিশুটি শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে উঠে পড়ল! কাদছে না, কেবল ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে ৷ ওকে ঐ রকম তাকাতে দেখে আসমা বেগম খাটের ওপর ওঠে গেলেন৷ মুনীরা একটু সরে বসল৷

আসমা বেগম শিশুটির বিছানার কাছে বসে, ওর তাকানো দেখে বললেন, দ্যাখ, কী রকম আশ্চর্য ব্যাপার-স্যাপার! ঐ টুকুনি ছেলে ঘুম থেকে যে কাদে না, সে আমি বাবার কালেও দেখি নি৷ কী আশ্চর্য রকমের শান্ত-শিষ্ট তাই দেখ! বাপের কিছু পায় নি৷
তা বলে মায়ের ও যে পেয়েছে, তাও মনে হয় না! তুমিও তো কম রাগী নও৷ বলেই বাবা এসো রে , মানিক এসো রে, বলতে বলতে শিশুটিকে আসমা বেগম কোলে তুলে নিয়ে চুমা দিয়ে আদর করতে লাগলেন৷ খানিকক্ষণ আদর করার পর বললেন, বাবাকে প্যান্টি পরিয়ে দিস নি? তোর ভাইজান এসে, কোন কিছু খেয়াল করে না ফস করে কোলে নেবে, আর ও ঝুরুক করে কল ছেড়ে দিবে৷ সেদিন কোলে নেওয়ার সাথে সাথেই দিয়েছে ছেড়ে ৷ এমনি জোড়ে দিয়েছে যে বুকের পাঞ্জাবী তো ভাসিয়েছেই৷ শেষ পর্যন্ত বেচারার দাড়ি পর্যন্ত....ই হি হি হি ৷ বেচারা হেসে উঠে বলল, বাপের পক্ষ নিয়ে শোধ নিচ্ছে বেটা৷


মুনীরা হাসি মুখে বলল, ভারী পাজি হয়েছে৷

আসমা বেগম শিশুটির গালে আরেকবার চুমো দিয়ে বললেন, এই, খবরদার! আমার আব্বুকে পাজি-পাজি বলবি না, বলে দিচ্ছি পাজি বলতে শুনলে তোর ভাইজান ভীষন রেগে যাবে, ঘরে এলেই ওকে বুকে নিয়ে লোকটা কেমন মেতে ওঠে দেখিস নি? কেমন বার বার মুখে চুমো দেয় ? পাজি বলতে শুনলে পিত্তি সে গেলে দেবে দেখো, হ্যাঁ ৷

মুনীরা যেন দিশেহারা হয়ে গেছে৷ একটি কথাও আর মুখে আসছে না৷

আসমা বেগম বলতে লাগলেন, খুব মাথা খাটিয়ে নাম দিয়েছে কী?

মুনীরুদ্দীন আহমমদ৷ মায়ের নাম তো থাকবেই কিন্তু বাপেরটাও বাদ যাবে না৷ শুধালাম, ঐ বদমাশটার নামটা আবার জুড়তে গেলে কেন? আমার কথা শুনে বলল. কী জানিস? বলল, বদমাশ হোক আর যাই হোক, সেই তো ওর বাপ৷ এই শিশুর ধমনীতে তারই যে রক্ত-ধারা বয়ে যাচ্ছে ৷ আমি তার পিতৃ-পরিচয় ভুলিয়ে দেব, এত বড় দুঃসাহস আমার কি আছে?


মুনীরা বিহবল দৃষ্টি মেলে ভাবীর দিকে এক পলক চেয়েই দৃষ্টিটা নামিয়ে নিল৷

আসমা বেগম বলতে লাগলেন, সকালবেলা ঐ শয়তানটার এরেস্ট হবার সংবাদটা দেখে আমাকে সে বলল, এই জিনিসটারই আমি বার বার আশঙ্কা করছিলাম, বেগম ৷ ঐ পথটার শেষপ্রান্তটি এই দুনিয়াতে আল্লাহ পাক ঐ পর্যন্তই টেনে নিয়ে গেছেন ৷ সে যদি মানুষ হয়, তাহলে অবশ্যি একদিন না একদিন বুঝতে পারবে, কেন তাকে পাকড়াও করা হয়েছিল ৷ আর যদি সত্যি সত্যি একটা গাধা হয়, তবে কেন তাকে পাকড়াও করা আর কেন যে ছেড়ে দেওয়া-তার কিছুই সে বুঝতে পারবে না৷ বলেই আসমা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ওরে, দে রে আমার আব্বুকে দুধ দে৷ খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে৷ কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাচ্ছে দ্যাখ্ ৷


মুনীরার এ এক নতুন রূপান্তর ৷ এই ক্ষুদ্র মাংস পিণ্ডটির ক্ষুদ্রতম হৃদপিণ্ডের অস্থির স্পন্দন এখন তার নিজের বুকের মধ্যেও প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ৷ মুনীরার নিরাশ জীবনে আশার শূভ্র আলো জ্বেলে দিয়েছে এই ক্ষুদ্র জীবন সত্তাটি৷ একটি ছোট্ট দেহ, দুখানি ছোট্ট ছোট্ট হাত, দুখানি পা, পিট পিট করে তাকনো একজোড়া নীলাভ চোখ, পাতলা পাতলা ঠোঁট অলা ছোট্ট একখানি মুখ, সবকিছু মিলে যে ক্ষুদ্র একটি জীবন-সত্তা তাকে জড়িয়ে মুনীরারও জীবন-লতাটি বেড়ে ওঠবার এক আশ্চর্য্য অবলম্বন লাভ করেছে৷ আশা-আনন্দে তাই তার হৃদয়খানি এখন পলে পলে আন্দোলিত হয়ে উঠছে৷


মাহতাব এর সংবাদটি শুনে মুনীরার বুকের ভেতরে একবার মোচড় দিয়ে উঠছিল৷ যে-মানুষটির সাথে তার একদিন সাহচর্য্য হয়েছিল, যাকে নিবিড় ভাবে আত্মার আত্মীয় বলে একদিন তাকে গ্রহন করতে হয়েছিল, যার সুখে-দুঃখে মুনীরার নিজের মনেও একদিন সুখ-দুঃখের অনুভূতি জাগত, তার এই দুসংবাদ কী মুহুর্তের জন্যেও হৃদয়কে আলোড়িত করবে না? তারই শিশু- মুনীরার নয়নের মণি, দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর বেড়ে উঠবে, হাটতে শিখবে, কথা বলতে শিখবে, তারপর একদিন হয়ত সব কিছু জানতে চাইবে৷ সেদিন কি সে পাবে সব কিছু গোপন করতে?


মুনীরা শিশুটিকে আর একবার নিবিড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরল! ওর ক্যাতকেতে নরম শরীরের মিষ্টি আস্বাদন মায়ের প্রতিটি রক্ত-কণিকায় যেন বিদ্যুৎ প্রবাহের মতন পরিব্যাপ্ত হয়ে গেল ৷ শিশু চুক চুক করে দুধ চুষে খাচ্ছে ৷ মুখের উঞ্চতায় মায়ের মনে অপূর্ব শিহরণ জাগছে৷ তারই মধুর আস্বাদন দ্রুত মুনীরার হৃদপিণ্ডে পৌঁছে যাচ্ছে ৷ কত মিষ্টি মধুর অনুভুতি !

সেই অনুভুতিতে আপ্লুত মুনীরা স্বপ্নাবিষ্টের মতন শিশুটির মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল৷





সেদিন জুমার নামায শেষ হলে মাহতাব বইরে এসে দেখল, দু’তিন জন লোক ওপাশের চত্বরে খানিকটা জয়গা ঝাড়ু- দিয়ে পরিষ্কার করছে৷ মাহতাব আগে থেকে জানত, ঐখানে মজলিস-এর সেক্রেটারী সাহেবের দারসের মাহফিল হবে৷ মাহতাব এক পা দু পা করে এগিয়ে গিয়ে ওদের কাজ দেখতে লাগল এমন সময় কোথা থেকে বাঘা এসে বলল, আজকে সেক্রেটারী নয়, খোদ আমীর সাহেবই দরসে কোরআন পেশ করবেন৷


- কে বলল, তোকে ? মাহতাব প্রশ্ন করল৷

সেক্রেটারী সাহেবই জানিয়ে দিয়েছেন৷ আপনাকে আজকে ঐ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে৷

- আমি তুই? তুই কী করবি? মাহতাব বাঘাকে প্রশ্ন করল৷

বাঘা হেসে উঠে বলল, আমার অনেক কাজ, মাহাতাব ভাই৷ যাদের দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, তারা তো আপনার মতন অত পড়শুনা করা মানুষ নয়৷ তাই তারা মজলিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে পারছে না৷ এটা যে মানব-জীবনে অবশ্য করণীয় কাজ, সেটা ভালভাবে না বুঝলে ওদের আগ্রহ জাগবে কেন? দাওয়াতী লোকেরাও অনেকে সেই জন্যে ঠিক সময়ে হাজির হয় না৷ ওদের কাছে দ্বীন হকের সঠিক দাওয়াত পৌঁছাতে হলে, ডেকে নিয়ে হাজির করতে হবে৷ আমি ঠিক করেছি, আপনি অনুষ্ঠান শুরু করবেন, আর আমি ওদের ডেকে ডেকে হাজির করব৷


বাঘার এই উত্সাহ দেখে মাহতাবও উত্সাহিত হয়ে বলল, ঠিক আছে তাই হবে ৷


মাহতাবের সাথে কথাবার্তা সেরে বাঘা নিশ্চিত হয়ে চলে গেল৷

বাঘার যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকেত এই মুহুর্তে মাহতাবের অনেক কথা মনে পরে গেল৷ এই সেই বাঘা, একদিন যে অসৎ সংসর্গে পড়ে একটা হিংস্র পশুতে পরিনত হয়েছিল৷

প্রথম প্রথম জেলে এসে ওর চেহারা দেখে মাহতাবের মনে হত, কোথায় যেন সে ওকে দেখেছে৷ কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও সে-কথা সে কিছুতেই মনে করতে পারত না৷ এমনি করে ভাবতে ভাবতেই মাহতাবের বেশ কিছুদিন কেটে যায়৷

একদিন বাঘাকে নিভৃতে পেয়ে মাহতাব জিজ্ঞেস করেছল, কোথায় যেন আপনাকে দেখেছি মনে হয়৷ আচ্ছা, আপনি কি কখনো আমাকে দেখেছেন বলে মনে করেন?

বাঘা হেসে উঠৈ বলছিল, আমারও তো ভাই মনে হয়৷ আপনাকে দেখার পর বহুদিন থেকে আমি ভাবছি, কোথায় যেন দেখেছি৷ কিন্তু কোন কুল কিনারা করতে পারি নি৷ সেদিন হঠাৎ বিষয়টা আবিষ্কার করে ফেললাম ৷

মাহতাব জিজ্ঞেস করেছিল, কী আবিষ্কার করলেন বলুন তো?

- ভুল-চুক হবে কিনা কে জানে৷

- তা হোক, অসুবিধা হবে না৷ আপনি বলুন৷

বাঘা বলেছিল, একদিন পল্লবী রেস্তোরা থেকে বাইরে আসছিলেন৷ আমি ভুল করে...

- এই ৷ ধাঁ করে মাহতাবের সমস্ত ঘটনাটি মনে পড়ে গিয়েছিল৷ মাহতাব বলে উঠছিল, এবার আমার মনে পড়ে গেছে৷ একজন ছোকড়া একটি মেয়েকে নিয়ে ভাগছিল ৷ আপনি ওর পাছায় লাথি মেরে শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকে উদ্ধার করেছিলেন৷

বাঘা হেসে উঠে বলেছিল, উদ্ধার করে ঠিকই বটে । কসাই যেমন শেয়ালের মুখ থেকে বকরি উদ্ধার করে -তেমনি৷ কিন্তু যাক সে-কথা এখন সে সব মনে হলেও খুব বিশ্রী লাগে৷ মাহতাব জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু এখানে আসতে হল কেন? বাঘা তেমনি হাসি মুখে বলেছিল, সেও তো এক লম্বা চওড়া কাহিনী৷ সে কাহিনী আর আপনার শুনে কাজ নেই৷


মাহতাব উত্সুক হয়ে বলেছিল, আমার কিন্তু ইচ্ছে হচ্ছে শুনতে ৷ আপনি কি ঘুষ খেতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন?

বাঘা হো হো করে হেষে উঠে বলেছিল, চাকরী থাকলে তো ঘুষ খাব?

শালার চাকরী পেলাম না বলেই যত আপনার ইয়ে....৷ সেই যে বলে, আইডল ব্রেন ইজ দ্যা ডেভিলস ওয়ার্কসপ ৷ বেকারদেরও তো পয়সা লাগে! সংসারে তাদেরও চলতে হয় ৷

- কিন্তু তা হোক , আপনার জেলে আসার কাহিনীটি বলুন তো শুনি৷

বাঘা মুহুর্ত খানিক চুপ করে থেকে বলেছিল, ছাড়ছেন না যখন, তখন বলি শুনুন! যে কোন ঘটনার মধ্যেই মানুষের কিছু না কিছু শিক্ষনীয় থাকে ৷ বলেই বাঘা বলতে শুরু করেছিল, ঐ মেয়েটিকে তো আমরা সেদিন সেই ছোকরার কাছ থেকে কেড়ে নিলাম৷ নিয়েই ষ্কুটারে উঠলাম ৷ সে ষ্কুটার ছুটল কাকরাইল রোড হয়ে রমনা গ্রীণ বাঁ হাতে রেখে, সোজা পশ্চিম দিকে ৷ একটি হোটেলে আমাদের যাওয়ার কথা ৷ ষ্কুটার যখন প্রধান মন্ত্রীর সাচিবালয়ের কাছাকাছি, ধরুন, গজ পঞ্চাশেক দূরে পৌছেছে, আমার সঙ্গীটা ড্রাইভারকে ষ্কুটার থামাতে হুকুম করল৷

ষ্কুটার ড্রাইভারটি ধাঁ করে থামিয়ে দিল । আমার সেই সঙ্গীটির নাম ছিল হীরু ৷ তড়াক করে গাড়ি থেকে সে নেমে পড়ল৷ নেমেই আমাকে বলল, তুই এখানে নেমে যা বাঘা ৷ আমি তো বিলকুল হতবাক ৷ আমার মুণ্ডতে ব্যাপার স্যাপার কিছুই ঢুকছে না তখন৷ আমি অবাক হয়েই শুধালাম, মানে কি বলছিস তুই?

হীরু ডাটের সাথেই বলল যা বলছি পষ্টাপস্টি বলছি। বুঝতে তোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷

আমার খুবই অবাক লাগছে তখন৷ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ও যাবে কোথায়?

সে ফস করে বলে ফেলল, রানী আমার সাথে যাবে৷

আর বলব কি ভাইজান৷ আপনার কাছে বলতেও এখন লজ্জা হচ্ছে ৷ কথাটা শুনে, শালা, মাথার রক্ত আমার টগ বগ করে ফুটে উঠল৷ খেপে উঠে বললাম , শালা, মেয়ে মানুষটা কেড়ে আনলাম আমি , আর তুই বলছেস কিনা একলা তোর যাবে তোর সাথে? সো কি কথা রে?

হীরু তেমনি ডাটের সাথেই বলল, ওকে শুধিয়ে দ্যাখ না, কার সাথে যাবে? আমি তখন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সেই মেয়েটিকে ই জিজ্ঞেস করলাম , কার সাতে সে যেতে চায়৷

মেয়েটি এক মজার জবাব দিল৷ বলল, কার সাথে যেতে হবে তার আমি কী জানি? যার গায়ে বেশি জোর, সেই তো আমাকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে তোমাদের দুজনের কার বেশি জোর সে তোমরাই ভাল বোঝ ৷

হীরু আর আমি দুজনেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি৷ এক মুহুর্ত সে কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, তোমরা দুজনেই তো এনেছ ৷ দুজনেই নিয়ে চল ৷


হীরু কিন্তু তবু ত্যাড়া হয়েই রইল৷ বলল, না, তা হবে না৷ আজ ও আমার সাথেই যাবে৷ তুই আজকে রমনা গ্রীণ থেকে একটা জোগাড় করে নে গে যা অত ভাবছিস কেন? টাকা ফেললে জিনিসের অভাব নেই এদেশে৷ বলেই হীরু ওর পকেট থেকে খান কয়েক একশো টাকার নোট আমার মুখের সামনে তুলে ধরল৷


রাগের চোটে আমি তখন দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি৷ পায়ে ছিল আমার স্পোর্টস শু ৷ বাঁই করে ডান পা টা উঠিয়ে ওর হাতের তলায় মারলাম কষে এক লথি ৷ বললাম , শালার ব্যাটি শালা, টাকার খুব গরম দেখাচ্ছ? তোর টাকায় আমি মুতে দিই৷
লাথির ঘায়ে হীরুর হাতের নোটগুলি ছিটকে পড়ল৷ কিন্তু সে দমল না৷ ব্যাটা রেগে উঠে বলল, তা হলে তুই যাবি না?
আমি চেচিয়ে উঠে বললাম, না, যাব না৷


সে আবার বলল. ঠিক বলছিস?

আমিও ঝেড়ে বললাম, ঠিক , ঠিক ঠিক ৷ একশোবার ঠিক৷

ও বাব্বা, ব্যাটাচ্ছেলে এবার করল কি, পকেট থেকে সেই যুদ্বের সময়কার চুরি করে রাখা পিস্তলটা বের করে আমার বুকের দিকে তাক করে ধরল৷ ওর দুটো চোখ তখন ভাটা মতন জ্বলছে ৷ সত্যি বলতে কি আমি ঘাবড়ে গেলাম৷ শালার ব্যাটা তো গুলি ছুঁড়ে দেবে দেখছি৷ মহুর্তে আমার মনে হল, বাঁচতে হলে এখন কমফুর ট্রেনিংটা কাজে লাগাতে হবে৷ আমি তাই ভেবে চট করে রেডি হয়ে গেলাম৷

হিরু পিস্তলটা ধরেই বলল, তবে এই যা....

ওর কথা শেষ হবার আগেই আমার ডান পা টা বাঁই করে আবার উঠে গেল৷ লাগল গিয়ে ওর হাতে ।সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে দড়াম করে গুলির একট আওয়াজ হল৷ আর সেই মুহুর্তে আমি দিলাম দৌড়। উন্দো মুন্দো ছুটতে লাগললাম ৷ কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়ে গেলাম পুলিশের হাতে ৷ হীরুও ধরা পড়ল ৷ পরে শুনলাম, ঐ গুলিটা তলপেটে লেগে সেই মেয়েটি ওখানেই মারা পড়েছে ৷ তারপর সেই চাঞ্চল্যকর রাণী হত্যার মামলায় হীরুর ফাসি হয়ে গেল৷ ড্রাইভারের সাক্ষী সাবুদ নিয়ে হাকিম আমাকে দিল যাবজ্জীবন্ ৷ মরতে মরতে গেলাম বেঁচে ৷


বাঘা কেমন যেন একটু বিমনা হয়ে পড়েছিল ৷ সে একটু থেমে বলেছিল, সত্যি কথা কি ভাইজান হিরুটার মধ্যেও অনেক গুড কূয়ালিটি ছিল৷ গরীব দুঃখী দেখলে পকেটে হাত দিয়ে যা কিছু উঠত ৷ কিন্তু ঐ রকম একটা মানুষ ও সঙ্গ দোষে খারাপ হয়ে গিয়েছিল৷ এখন যদি সে এই মজলিসের সংস্পর্শ আসতে সুযোগ পেত, তবে আমাদের মতন সেও আলোর পরশ পেত৷


শেষ দিকে বাঘার গলাটা একটু ধরে এসেছিল৷ বাঘা বলেছিল,

আল্লার রহমত, ভাইজান৷ এ জন্যে সর্বদা আমি মহান আল্লা তায়ালার শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারি না৷ আমি সেই বাঘা আল্লার মেহেরবানীতে এখন তো একেবারে বদলে গেছি৷

বাঘার এই ঘটনা বৃত্তান্তই মাহতাবকে একদিন উত্সুক করে তুলেছিল এই মজলিসটি কী? তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী এসব জানবার জন্যে ৷ তারপর থেকেই মাহতাবের মনে দূর্বার আকর্ষন জেগেছিল্ মজলিসের সদস্যদের বক্তব্যে কী এমন আকর্ষণ আছে, যা বাঘার মতন একটি উচ্ছৃঙ্খল ছেলেকে আকৃষ্ট করতে পারে? কী এমন শক্তি আছে, যা তাকে ভিন্ন এক মানুষে পরিণত করে দিতে পারে?


এই বাঘা সেদিন মাহতাবকে আরো বলেছিল জেলখানায় ঢুকে দেখলাম, ভাইজান, গোটা জেলখানাটা চোর ছ্যাচ্চোরের একটা আখড়া৷ এই কারখানাতেই সারা দেশের জন্য ক্রিমিনাল তৈরী হচ্ছে ৷ ছিচকে চোর, সিধেল চেরবা পেটের দায়ে চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে এখানে আসে ৷ এসে দস্তুরমত ট্রেনিং নিয়ে ডাকাত হয়ে বেরিয়ে যায়, তরপর সেখানে গিয়ে পাকা পোক্ত ডাকাত হয়ে দুনিয়া কে মজা লোট করে বেড়ায়৷ প্রথম যখন আমি এখানে আসি, ওদের দেখে আমারও ঐ রকম একটা খেয়াল চেপেছিল ৷ নিজেকে বলতাম, বাঘা রে! যাবজ্জীবন হলেও তো একদিন জেলখানা থেকে তুই ছাড়া পাবি৷ তখন বাইরে গিয়ে কী করবি? এদেশে বাঁচতে হলে তোকে তো বাঘা হয়েই বাঁচতে হবে ৷ ভাল মানুষ হয়েছিস কি , অমনি অন্য একটা বাঘা এসে শালা, গাঁক করে তোর হলকুমে দাঁত বসিয়ে দেবে৷ তারপরেই কাম ফতেহ৷ তখন? কিন্তু শেষমেশ মাথা থেকে ঐ খেয়ালটা নামিয়ে দিল মজলিসের এই সদস্যরা ৷ আমার ধ্যান ধারণা ওরা একে বারেই পাল্টে দিল৷ ওদের আলোচনায় মরণের পরের জগতটা, ভাইজান চোখের ওপর জ্বল জ্বল করে ভেসে উঠল৷ এই দুনিয়াতে তো তন্দুরের রুটির মতই ছেকা খেলাম, আবার সেই পরকালও যদি যায়....


মাহতাব বাঘাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ঐ মজলিসের লোকেরা এখানে কী করে ঢোকে?

বাঘা জবাব দিয়েছিল, কেন, আসামী হয়ে ঢোকে৷

- ভাল মানুষরা আসামী কেন হবে?

- ভাল মানুষও আসামী হয়, ভাইজান চোরের হাতে যদি ক্ষমতা থাকে, তখন ভাল মানুষের আর আসামী না হয়ে উপায় কি?

বাঘা বলেছিল, ঐ যে মজলিসের সেক্রেটারী সাহেবকে তো দেখছেন? বেটে খাটো মানুষ ৷ আধপোড়া কালচে তামাটে গায়ের রঙ্ যেদিন পুলিশে ৷ ঐ ভদ্রলোককে জেলখানায় নিয়ে এলো, সেদিন আমরা বুঝিনি ওর মধ্যি একটা জ্ঞানের সাগর লুকিয়ে আছে ৷ ওর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে আমরা দলে দলে অল্পদিনের ভেতরেই মজলিসের সদস্য হয়ে গেলাম ৷


শুনে বাস্তবিকই মাহতাবের মনে দারুণ ঔত্সুক্য জেগেছিল ৷ একে তো এই পার্থীব জীবনের প্রতি তার মনে প্রবল বিরাগ, তার ওপর বাঘার এই ঔত্সুখ্য জাগানো কথা, মাহতাব আকৃষ্ট হয়েই এদিন মজলিসের সেক্রেটারীর সাথে যোগাযোগ করেছিল৷ তারপরেই এই আলোর পরশে মাহতাবের হৃদয় মন সত্যি সত্যি আলোকিত হয়ে উঠেছে ৷ অল্প দিনের ভেতরেই সে মজলিসের প্রাথমিক সদস্য হয়ে গেল৷ আর বাঘাও তাকে মাহতাব ভাই হিসেবে পেয়ে মনে মনে আনন্দ লাভ করল প্রচুর ৷





বাঘা চলে যাওয়ার পর বহুক্ষন ধরে মাহতাব বিগত দিনের ষ্মৃতিটুকু রোমন্থন করতে লাগল৷ আনমনাভাবে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বাঘার ঐ ত্রস্ত পদচারনার কথা মনে করে এখন তার খুবই আনন্দ হচ্ছে ৷ একদিন ওর ঐ দুটি পা অন্যায়ের আয়োজনে ঐ রকমই চঞ্চল হয়ে উঠত ৷ সেটাও তো মাহতাব দেখেছে ৷ আবার সেই দুটি পা ই আজ ন্যায় প্রতিষ্ঠার আয়োজনে তেমনি ভাবেই তত্পর হয়ে উঠেছে ৷ মনটি তার সেই একই আছে, গতিটাই কেবল ঘুরে গেছে কু থেকে সু এর দিকে ৷ বাঘার জীবনের এই চিত্রটি ভাবতে গিয়ে এক সময় মাহতাবের নিজের জীবনের ছবিটিও জ্বল জ্বল করে মনের পর্দায় ভেসে উঠল৷


জীবনটা মাহতাবরে শুরু হয়েছিল দারিদ্র আর টানটানির মধ্য দিয়ে ৷ ছোট বেলায় মায়ের মৃত্যু হয়ে ৷ পরের পাঁচটি বছর ওর বাপের সান্যিধ্যেই কাটে৷ তারাপুর বাজারে ওদের একটা দর্জির দোকান ছিল৷ মাহতাবের বাপ সেখানেই কাজ করত৷ কিন্তু কাজ ঠিকমত জুটত না৷ পাড়া গাঁর ছোট বাজার ৷ শক্রবার আর সোমবার সেখানে হাট বসত৷ হাটের দিন লোকের আনাগোনা বাড়ত যথেষ্ট৷ তখন দুচারটি অর্ডার পাওয়া যেত দূর দূরান্তের লোকেদের কাছ থেকে৷ হাটের দিন লুঙ্গী সেলাই এর কাজটি ও মোটামুটি ভালই জানত৷ তাতে করে কিছু নগদ পয়সা আসত৷ মাহতাবের বাপের দৃস্টি শক্তিটা ছেলেবেলা থেকেই কমে গিয়েছিল৷ ফলে কাপড় সেলাই করতে গেলে সেলাইটা তার ব্যাকা ত্যাড়া হয়ে যেত ৷ খদ্দেরদের বেশির ভাগ লোকই তো সৌখিন৷ পয়সা দিয়ে তারা পোশাক বানাবে, সেলাই খারাপ হলে বরদাশত করবে কেন? এই সব কারণে উঠতি বয়সের তরুণরা মাহতাবদের দোকানের ধারে কাছেও ঘেষত না পাড়াগায়ের তরুণ যুবকরা মাসে দুমাসে একেকবার শহরে যেত সিনেমা দেখতে ৷ আর সিনেমার নায়ক নরায়িকার পোশাকা আশাক দেখে এসে, সেই রকম ডিজাইনের অর্ডার দিত৷ ওদের আশঙ্কা হত, বুড়ো দর্জিটা ঐ রকম সৌখিন পোশাক তৈরী করতে তো পারবেই না, কাপড়ই হয়ত নষ্ট করে ফেলবে৷ তারা অর্ডার দিত উঠতি বয়সের দর্জিদের দোকানে৷ সেই সব দর্জিরা নিজেদেরও থাকত রকমারী টেরিকাটা চুল, আর পোশাকে থাকত চোখ ভোলানো আকর্ষণ৷ তাদের সাথে মাহতাবের বাপের প্রতিযোগিতা করার সাধ্য ছিল না৷ ফলে ওদের ব্যবসা যতই জমজমাট হয়ে উঠতে লাগল, মাহতাবের বাপের ততই শ্রীহীন হয়ে পড়ল৷ আর তার জন্যেই তাদের সংসারে অন্ন বস্ত্রের অনটন সব সময়ই লেগে থাকত ৷
মাহতাবের চার বোন ছিল৷ তাদের দুচার জন ওর জন্মের আগেই মারা যায়৷ বাকী দুজনকে অবশ্যি সে দেখেছে ৷ মায়ের মৃত্যের পর তারাও একে একে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে৷ সংসারের অসচ্ছলতার জন্যেই মাহতাবকে বাপের কাজে সাহায়তা করতে হত। বাপের পায়ের কাছ মাদুর পাতা ছোট একটা চৌকি ছিল৷ তার ওপরে বসে বসে সেলাই করা জামাতে সে ঘাট বাধত৷ ওর বাপ আরও কিছুদিন বেছে থাকলে হয়ত বাপের ব্যাবসাতেই মাহতাবকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়তে হত। সংসারের নিদারুণ দারিদ্রের জন্যেই ছোট বেলায় সে বই হাতে করতে পারেনি৷ লেখাপড়ার ব্যাপারে তার বাপের কোন আগ্রহই ছিল না৷


মাহতাবের বাপও একদিন চোখ বুজল৷ তখন ওকে আশ্রয় নিতে হল মামার বাড়ি ৷ সেখানেও প্রথম দিকে ওর জন্যে এক রাশ দুঃখ কষ্ট ওত পেতে বসে ছিল৷ সকালবেলা পান্তা খেয়ে এক পাল গরু নিয়ে সে মাঠে যেত৷ কোন কোন দিন গরু চরানোর বদলে নিড়ানী হাতে যেতে হত ধানের ক্ষেতে ৷ আষাঢ়ে রোদের ভেতর ওকে আউশ ধানের ভুই নিড়াতে হত৷ অনভ্যাসের দারুণ ধানের পাতার আচড়ে আর ভ্যাপসা গরমে পিঠের ওপর ফোষ্কা পড়ে যেত ৷ সেই ফোষ্কা ফেটে গিয়ে দাগড়া দাগড়া ঘায়ে সারাটা পিঠ যেত ভরে৷ একদিন পিঠ ভরা ঘা নিয়ে মাহতাবকে কাঁদতে দেখে মামার মনটা ব্যথিত হয়ে উঠেছিল৷


বাপ মা মরা ছেলেটা এক মুঠি ভাতের জন্যে কী নিদারুণ কষ্ট করছে! মামা ওর মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন৷ ছেলেটির ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে কূল কিনারা না পেয়ে, শেষমেশ ওকে তিনি ষ্কুলে পাঠানোই সব্যস্ত করলেন৷ দুদিন পর বই বগলে মাহতাব ষ্কুলে যাওয়া শুরু করল ৷ আর ঠিক প্রথম পরীক্ষাতেই বোঝা গেল, গরীবের ঘরে জন্মালে কী হবে, ছেলেটি অসাধারণ মেধাবী ৷ অনায়াসে এমন সব কৃতিত্ব সে দেখাল যা দেখে ষ্কুলের শিক্ষকগণও চমত্কৃত হয়ে গেলেন৷ মাহতাব একটার পর একটা বৃত্তি পেয়ে পাশ করে যেতে লাগল৷ আর এই ভাবেই ওর জীবনের আমূল পট পরিবর্তন হয়ে গেল৷ জীবনটা এক পথে চলতে চলতে হঠাৎ মোড় নিয়ে ভিন্ন পথ ধরল।


সেই ছেলে বেলার কথা বার বার মাহতাবের মনে পড়ছে ৷ দুঃখ কষ্ট বেদনায় মুষড়ে পড়ে সে কতদিন যে দয়াময় আল্লার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করেছে, তার কি হিসাব নিকাশ আছে? চোখের পানিতে বুক গিয়েছে ভিজে৷ আল্লাহ একদিন অনুগ্রহ করলেন৷ কিন্তু যেদিন আল্লাহ ওর ভাগ্য খুলে দিলেন, সেদিন থেকেই মাহতাব আল্লাকে ভুলতে শুর করল৷ অতীতের দিনগুলি তার দৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেল্ বিষ্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল বেদনা লাঞ্ছনার ইতিহাস ৷ একমুঠি খাদ্যের জন্যে পরমুখাপেক্ষী মাহতাব যেদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানের শিরোপা ছিনিয়ে আনল, সেদিন তার সুনামের সৌরভে চারদিক মম করতে লাগল৷


তার ঘরে এল মুনীরার মতন সুন্দরী নারী, বধু হয়ে ৷ কিন্তু হায়, প্রবৃত্তির অদম্য তাড়নায় বিভ্রান্ত হয়ে সেই সতী সাধ্বী নারীকেও মাহতাব একদিন অনায়াসে পায়ে ঠেলতে পারল৷


কিন্তু তারপর? তারপর কী পেল মাহতাব? কোথায় গেল তার সম্মানের শিরোপা? কোথায় গেল তার শিক্ষার গৌরব, সম্পদে অহঙ্কার? কার অদৃষ্ট ইঙ্গিতে আজ সে লৌহ কপাটের অন্তরালে পাচ পাচটি বছর ধরে তিল তিল করে অপরাধের শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছে? কে দিল এই বিদ্রোহীর উপযুক্ত শাস্তি?


ভাবতে ভাবতে মাহতাবের দুটি চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হেয় উঠেছিল চোখের পাতা উপচিয়ে কয়েকটি ফোটা পানি ওর গণ্ড চিবুক এবং দাড়ি বেয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ল ৷ তাড়াতাড়ি সে কাপড়ের খুটে চোখ দুটি মুছে ফেলল৷


লৌহ করার অন্তরালে আজ পাঁচটি বছর মাহতাবের কেটে যাচ্ছে এখানকার দিনও এখন দ্রুত আসছে ফুরিয়ে ৷ আজ শিক্ষার ও সম্পদের গর্ব এবং অহঙ্কার একেবারেই ধুলিষ্মাত্ হয়ে গেছে৷ এই জেলখানার বাইরে এখন ওর জন্যে এক নতুন লাঞ্ছনার জীবন অপেক্ষা করে আছে৷ সেই দুঃসহ জীবন সে কেমন করে বরণ করে নেবে, ভাবতে গিয়ে মনটি ওর বার বার শঙ্কিত হয়ে উঠছে৷


আজাকল অহরহ মুনীরার কথা তার মনে পড়ে ৷ বড় কষ্টে, অসহ্য যাতনায় পড়ে সে একদিন মাহতাবকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিল। মুনীরার শুভ্র নির্মল হৃদয় সেদিন মাহতাবের সেই দুরুন অত্যাচার কেন যে সহ্য করতে পারে নি, আজ মাহতাব তার সবটুকুই মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে পারে ৷ এখানে এসে ভাল মানুষের সাহচর্য না পেলে হয়ত ঐ সত্যটুকু বোঝবার মতন যোগ্যতাও তার কোনদিন হত না৷ লালসার তীব্র হলাহল আকন্ঠ পান করে সেদিন যে সে মৃত্যুর আয়োজন করেছিল, মুনীরার দিব্য দৃষ্টি তাকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিল বলেই তো সে তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছে৷ মাহতাব একদিন মহামূল্য হীরককে ছুড়ে ফেলে এক খণ্ড কাঁচের জন্যে মোহমুগ্ধ হয়ে উঠেছিল৷ আজ তার ভীষণ পরিণতি দেখে ওর অন্তরাত্মা প্রতি মুহুর্তে বেদনায় ডুকরে ডুকরে উঠছে৷


কিছুদিন আগে রওশন মাহতাবের সাথে দেখা করতে এসেছিল ৷ রওশন একটি ভদ্রঘরের একজন সুশীলা মুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হয়েছে।
মাহতাবের কাছে এলেই অনেক কথা সে বলে৷ তার কাছ থেকেই গজনফার ও নন্দিতার খবরটাও মাহতাব জানতে পেরেছে৷ বাবা জেন্দপীরের উরশে যাবার পথে গাড়ি উল্টে বহু লোকের সাথে ওরাও দুজন আহত হয়৷ মারাত্নক যখম হওয়ার পর ওরা কেউই আর সুস্থ হয়ে উঠে অফিসে যেতে পারে নি।এদিকে জিনিয়াও সেই কবি ছোকবার সাথেই নাকি আজকাল থাকে ৷ ওরা বিয়ে করেছে কিনা জানা যায় নি৷ তবে দুজনে যে একটা গানের ষ্কুল খুলেছে, সেটা রওশন একদিন নিজ চোখেই দেখে এসেছে৷


এসব কথা শুনতে মাহতাবের সেদিন খুব তিক্ত মনে হয়েছিল। কেউ গানের ষ্কুল খুলুক, আর না হয় নরকের ষ্কুল খুলুক, তা নিয়ে মাহতাবের আজ আর মাথা ব্যাথা নেই। একটি মাত্র সংবাদ জানবার জন্যে এখন ওর প্রাণটা আকুলি বিকুলি করছে ৷ কিন্তু সেই সংবাদটি না দিয়েই রওশন চুপ করে গিয়েছল৷


মাহতাব জিজ্ঞেস করেছিল, মুনীরার কোন খোঁজ জানিস, রওশন?

রওশন বলেছিল, অনেক দিন তো খোজ খবর রাখি না৷ ঢাকার বাইরে যাবার আর সময় পেলাম কই? ইচ্ছে ছিল একবার খোজটা দিয়ে আসব, তা আর হয়ে ওঠে নি৷

মাহতাব প্রশ্ন করেছিল, মুরীরা হয়ত এতদিন বিয়ে করে ফেলেছে, তাই না? তোর কি মনে হয়?

রওশন এক মুহুর্ত চিন্তা করে বলেছিল, আমার কিন্তু উল্টোটি মনে হয় রে, মাহতাব!

- কী মনে হয় তোর?

- তোকে তো সে এই জন্যে ছেড়ে যায় নি যে, অন্য কোথাও কারুর প্রেমে সে পড়েছে৷ তোর প্রতি কখনো সে অপ্রসন্ন ছিল না৷
আমি জানি, সে তোকে ভালওবেসেছিল আল্লার জন্যে আর ত্যাগও করেছিল আল্লারই জন্যে ৷ তাই আমার মনে হয়, সেই অসাধারণ মেয়েটি যা কিছু করেছে, ভেবে চিন্তেই করেছে৷

মাহতাবের চোখ দুটি ছল ছল করে উঠেছিল৷ সে ধরা গলায় প্রশ্ন করেছিল, শুনি দীর্ঘ দিন যদি স্বামীর জেল হয়, তা হলে নাকি স্বামী-ষ্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়?

- কিন্তু কেউই যদি কাউকে ছাড়তে না চায়, তখন? রওশন পাল্টা প্রশ্ন করেছিল৷

মাহতাব মলিন মুখে তাকিয়ে শুধুমাত্র একট দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল৷ কিছুই সে বলতে পারে নি৷

রওশন মাহতাবের ভাব সাব দেখে বলেছিল, এই জেলখানায় এসে ভাল মানুষের সংস্পর্ষ পেয়ে তুই আজ যা হয়েছিস, এটা যদি মুনীরা ভাবী দেখতে পেত, আমার ধারণা আবার তোকে সে মাথায় তুলে নিত৷ কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য, আমি জানি না, সে কেমন আছে, কোথায় আছে৷


মাহতাবের মুখে সেদিন কথা ফোটে নি। রওশনকে বিদায় দিতে গিয়ে সেদিন সে বোবা হয়ে গিয়েছিল৷



অতীতের সমস্ত অপরাধের কথাও মাহতাবের আজ বার বার মনে পড়ছে ৷ দুনিয়ার সাময়িক লোভে মত্ত হয়ে সে একদিন বলগাহীন অশ্বের মতন দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলেছিল৷ হঠাৎ পথের মাঝখানেই তার চৈতন্যোদয় হল৷ তার সেই যাত্রা আজ এমন এক মোহনায় তাকে পৌছে দিয়েছে, যেখানে আনন্দ ও বেদনার দুটি ধারা পাশাপাশি বয়ে চলেছে ৷ তার অন্তহীন দৃশ্য মাহতাব যেন অন্তরের চোখ মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে অবিশ্রন্ত অশ্রুপাতও মাহতাবের সেই দৃস্টিকে ঝাপসা করতে পারছে না৷




মাহতাব দির্ঘক্ষণ বিমূঢ়ের মতন বসেই ছিল৷ বাঘার ডাক শুনে সম্বিত্ ফিরে এলো৷ বাঘা বলল, মাহতাব ভাই, আপনি এখনও বসে আছেন? কত বাজে জানেন? তিনটে পঞ্চাশ৷ আপনি শীগগীর সভায় চলে যান৷ আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে এক্ষুণি আসছি৷


মাহতাব বাঘার অলক্ষ্যে চোখ দুটি মুছে বলল, যাচ্ছি৷

- আর এক মিনিটও দেরি করবেন না, বলেই বাঘা তার দাওয়াতী লোকদের খোজে দৌড় দিল৷

দুপুর বেলা বেতের ঠেস চেয়ারে হেলান দিয়ে একখানি বই এর পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল মুনীরা৷ শাহীন ষ্কুলে গেছে, এক্ষুণি ওর ফেরার কথা৷ ষ্কুল থেকে ফিরলে ওর পোশাক-আশাক বদলে দিতে হবে৷ তারপর হাত মুখ ধুয়ে, খাইয়ে দাইয়ে কিছুক্ষণ ঘুমুলে এই ঢুলুনিটা আর থাকে না৷


দক্ষিণের জানালাটা হাট করে খোলা। বাতাবী গাছের ওপর দিয়ে দূরের স্বচ্ছ নীল আকাশটা শুধু চোখে পড়ে। গোটা দুই শঙ্খচিল ডানা মেলে চক্রাকারে উড়ছে৷ কয়েক খণ্ড সাদা মেঘ আকাশের ও প্রান্তে শুভ্র কাশফুলের মতন থোকায় থোকায় ভাসছে৷ মুনীরা বইটি বন্ধ করে সেই দিকে চোখ ফেরাল৷ দুপুরের ঝিম ধরা আকাশে উড়ন্ত দুটি শঙ্খচিল খুব কাছাকাছি হয়ে এখন অলস গতিতে ভাসছে৷ মুনীরার মনে হল, এই দুপুরের আকাশ, উষ্ণ মধুর বাতাস, ভাসমান খণ্ড খণ্ড মেঘ এবং সমস্ত চরাচর জুড়েই এখন যেন আলস্যর ঝিমুনী ধরেছে৷ কোথাও এতটুকু চাঞ্চল্যের লেশমাত্র নেই৷ প্রকৃতি নিবিড় ক্লান্তি আর অবসন্নতায় আচ্ছন্ন ৷ মুনীরা মোহমুগ্ধের মতন আকাশের দিকে কতক্ষন তাকিয়েছিল মনে নেই। সহসা শাহীনের পদশব্দে ওর ধ্যানভঙ্গ হল৷


ঘরে ঢুকেই শাহীন, আম্মি গো, আম্মি! বলে আনন্দে চীত্কার করে উঠল৷

মুনীরা জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে তেমনি অলস গলায় কোনমতে উ বলে জাবাব দিল৷

আম্মি, আমার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে৷ শাহীনের হাতে একখানি কাগজ৷ কাগজখানি সে মায়ের দিকে এগিয়ে দিল৷

মুনীরা হাতের বইখানি টেবিলের ওপর রেখে বলল, কী হয়েছে, দেখি?

আজ শাহীনের রেজাল্ট আউট হবে, সেটা সকালেও মুনীরার মনে ছিল! কিন্তু তারপরেই সেকথা সে ভুলে গিয়েছিল৷ আজাকাল হটাৎ হঠাৎ মুনীরা অনেক জিনিসই ভুলে যায়৷ চিন্তা শক্তিটা কেমন যেন শ্লথ হয়ে গেছে৷ কিছূদূর এগিয়ে যেতে যেতে চট করে মাঝপথেই সেটা পথ হারায়৷ তখন হয় কেউ ষ্মরণ করিয়ে দিলে মনে পড়ে , না হলে সে ভুলেই যায়৷ আর তা মনে করতে পারে না৷


প্রোগ্রেস রিপোর্টখানি হাতে নিয়ে আনন্দে ওর মুখখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বিষ্মত মুখে বলল, ফাস্ট হয়েছিস?

- হ্যাঁ আম্মি ৷ আর রতন সেকেণ্ড হয়েছে ৷ ও আমার থেকে অনেক কম নম্বর পেয়েছে ৷ স্যার না, আদর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, রতন তোমার চেয়ে তিরিশ নম্বর কম পেয়েছে ৷ তুমি ভাল করে পড়বে, নইলে রতন তোমাকে সেকেণ্ড করে ফেলবে৷ ইস, রতনটা যা অঘা না, আম্মি ! গুডস মানে লিখে দিয়েছে ভালগুলি। হি হি কি বোকা। তুমি না শিখিয়ে দিয়েছ, গুডস মানে মাল? না আম্মি ? আমার খুব মনে থাকে৷ আমি তাই ই লিখে দিয়েছি৷ আদব আখলাকেও রতন আমার থেকে পাঁচ নম্বর কম পেয়েছে ৷ হায় আল্লাহ, রতনটা এমন দুষ্টু, জানো আম্মি, জোহরের নামাযের সময়, নামায পড়তে গিয়ে খিক খিক করে হাসে ৷ নামায পড়তে পড়তে হাসলে আল্লাহ গুণাহ দেয় না? কী ভীষণ বদ রতন!

ওর বকবকানির দিকে খেয়াল নেই মুনীরার ৷ সে তখন প্রোগ্রেস বিপোর্ট পড়তেই ব্যস্ত! শাহীন সব সাবজেক্টেই পচানব্বই এর ওপরে নম্বর পেয়েছে৷ অঙ্কে একেবারে পুরো একশোই৷ সে যে খুব ভাল পড়াশুনা করে তাও নয়৷ তাকে পড়াতে বসানোও ভারী শক্ত৷ কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ওর পড়া তৈরী হয়ে যায়৷ যা কিছু পড়ে, সব মনে থাকে ৷ প্রগ্রেস রিপোর্টের ওপর চোখ বুলাতে গিয়েই মুনীরার হাঠাৎ করে শাহীনের বাপের কথা মনে পড়ে গেল৷ মাহতাবও এমনি ধরনের মেধাবী ছাত্র ছিল৷ ষ্কুল কলেজ সর্বত্র লেখাপড়ায় অন্য ছাত্রদের সে টেক্কা দিয়েছে৷ অথচ আসল পরীক্ষতেই সে অবশেষে ফেল মারল৷


মুনীরা প্রগ্রেস রিপোর্টটি দেখছে আর নানান কথা ভাবছে ৷ শাহীন মায়ের গা ঘেষে দাড়িয়ে বলল, দু তারিখে সবার আব্বাকে ষ্কুলে যেতে হবে ৷ স্যারারা তাদের নিয়ে মিটিং করবেন৷

মুনীরা অন্যমনষ্কের মত বলে দিল, বলিস তোর মামাকে৷

শাহীন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মামাকে যেতে বলে নি, আম্মি! আব্বাদেরকে যেতে বলেছে৷ হেড স্যার ক্লাসে এসে বললেন, তোমাদের সবাইকে কাল চিঠি দিব৷ তোমরা গিয়ে তোমাদের আপন আপন আব্বার হাতে সেই চিঠি দেবে৷ বলেই ফস করে একেবারে মুখের কাছে মুখ এনে শাহীন প্রশ্ন করল, রতনের আব্বা রোজ ওকে ষ্কুলে রেখে যায়৷ আমার কেন আব্বা নেই, আম্মি? সবার আব্বা আছে, আমার আব্বা নেই কেন?


ওর প্রশ্নটা কানে যেতেই মুনীরা চমকে উঠল৷ এ প্রশ্নের সে কী জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে বোবা চোখে শাহীনের মুখের দিখে তাকাল৷

মাকে জবাব দিতে না দেখে শাহীনের মনের মধ্যে উৎসক্যটা আরো বেড়ে গেল। বার বার বলতে লাগল, বল না আম্মি, আম্মি গো......রতন সে দিন বলল, শাহীন তোর আব্বা কোথায় থাকে রে? আমি বলতে পারি নি। আম্মি!


ক্ষুদে রতনের কাছ থেকেই প্রশ্নটা শাহীনের মনের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে৷ সেদিন টিফিনের সময় লাইব্রেরীর ওপাশে কামিনী তলায় বসে দুজনে নুন ঝাল দিয়ে বাদাম ভাজা খাচ্ছিল ৷ রতন বলেছিল, বিকেলে আমরা চিড়িয়াখানায় যাব রে, শাহীন৷ আমার আব্বা নিয়ে যাবেন৷ আমাদের সাথে তুই যাবি? যেতে চাস তো বল, আমি আব্বাকে বলব৷


- না রে ভাই, আমার মামা কারুর সাথে আমাকে কোথাও যেতে দেন না৷ একদিন মামার সাথেই গিয়ে চিড়িয়াখানা দেখে আসব৷

- মামার সাথে? হঠাৎ রতনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, শাহীন তার আব্বার সাথে যাবে না৷ যাবে মামার সাথে ৷ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা শাহীন, তোর আব্বা কোথায় রে? তোর আব্বাকে তো কোনদিন দেখি নি৷

- আব্বা? শাহীনও অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ এ প্রশ্ন তো তার মনে জাগে নি কখনো! সেই প্রথম শাহীনের মাথায় একটি উত্তরহীন প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খেতে শুরু করে ৷ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই সাধারণ প্রশ্নটি শাহীনের মনে এমন প্রকট হয়ে কোনদিন জাগে নি ৷ আর জেগে থাকলেও সেদিনের মতন অমন করে কখনো তার মনে আলোড়ন তোলেনি৷

শাহীন একটি মুহুর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিয়েছিল, তা তো জানিনে রে, রতন!

রতন বলেছিল, তোর আব্বা কি মরে গেছে তাহলে?

শাহীন বোকার মত বলেছিল, আমি যে কিছুই জানি নে৷

- শুধাস তো তোর আম্মি কে৷

তারপর থেকেই সত্যটা জানবার জন্যে ওর ঐ কচি প্রাণে ঔত্সুক্য জেগেছে৷ আব্বার কথা তাকে জানতেই হবে৷ প্রত্যেক দিন সে মনে করে জিজ্ঞেস করবে৷ কিন্তু বাসাতে এলেই আর মনে থাকে না৷ বাসায় এলে খেলাধুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয় কিনা৷ খাচার টিয়া পাখিটিকে ছোলা, লাল মরিচ, খোরাতে বদনার নলে করে পানি দেয়ার ভার দিয়েছে খসরু, তার ভাল রকম তদারকি আছে৷ টবে গোলাপ চারা, পাতা বাহার, ক্ষুদে পাম গাছ আছে, তার যত্ন আত্তি করতে গিয়ে ব্যস্ততায় আসল কথাটা শাহীনের মন থেকে রোজ হারিয়ে যায়৷ আগামী দুতারিখে ষ্কুলে পি,টি,এ অর্থাৎ পেরেন্টস টিচার্স এসেসিয়েশন হবে৷ সেদিন সবারই আব্বারা যাবেন ষ্কুলে। স্যারদের সাথে আলাপ করবেন৷ শাহীনেরও তো আব্বার সেখানে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু শাহীনের আব্বা কোথায়?


মুনীরাকে নিরুত্তর দেখে শাহীন আবার জিজ্ঞেস করল, আম্মি, বলছ না কেন? আমার আব্বা কোথায়?

মুনীরা এবার বিরক্ত মুখে ঝাঝিয়ে উঠে বলল, জানিনে৷

শাহীন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল৷ তারপর হঠাৎ ৷ তার মুখখানি কালো হয়ে উঠল৷ অনেক আনন্দ বুকে নিয়ে সে নাচতে নাচতে মায়ের কাছে তার পাশের সুখবর বয়ে এনেছিল৷ মা যে এমন ঝটকা দিয়ে কথা বলবে, শাহীন তা ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারে নি৷ ধীরে ধীরে ওর মুখের হাসি মুখেই মিলিয়ে গেল৷ ঠোট উল্টে, চোখে কাচলে সে কেদে ফেলল৷ শাহীনকে কাঁদতে দেখে মুনীরারও বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল৷ তারও দুচোখ বারে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷


মুজাফফর হোসানই ঠিক এমনি সময় বাইরে থেকে ফিরছিলেন ৷ হঠাৎ মা ও ছেলের দিকে তার চোখ পড়ে গেল ওদের এমনি করে কাঁদতে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন৷ এমনটি তিনি আর কখানো দেখেন নি৷ মুজাফফর মুহুর্ত খানিক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে মুনীরাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে, মনি?


মুনীরা ভাই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করে আচলে চোখ মুছে চুপ করে রইল৷

মুজাফফর আবার প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে? তোদের কেউ কি কিছু বলেছে?

মুনীরার কাছে থেকে কোনই জবাব পাওয়া গেল না৷

মুজাফফর আবার প্রশ্ন করলেন, খসরু তোমাদের কি কিছু বলেছে আব্বু?

শাহীন এবার কাঁদতে কাদতে বলল, না মামা, খসরু ভাই কিছু বলে নি৷ আম্মি আমাকে বকেছে৷

মুজাফফর এগিয়ে গিয়ে শাহীনকে বুকে তুলে নিলেন৷ বললেন, কেন, বকল কেন? হারে, তুই আমার আব্বুকে কেন বকেসিছ?

আচ্ছা, তুমি চুপ করো, আব্বু৷ দাড়াও ওকে আমি মজা দেখাচ্ছি৷ কেন সে আমার আব্বুকে বকবে? বলে শাহীনের গালে একটা চুমু দিয়ে বললেন, তুমি কি কিছু করেছিলে আব্বু?

শাহীন আদরে অধীর হয়ে তেমনি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি কিচ্ছু করি নি মামা৷ শুধু আম্মিকে শুধিয়েছিলাম, রতনের আব্বু আছে, আমার আব্বু নেই কেন? অমনি রেগে গিয়ে আম্মি আমাকে ধমক দিল৷ মুজাফফর হোসাইন হঠাৎ শিশুর মুখের এই প্রশ্নটি শুনে স্তম্বিত হয়ে গেলেন৷ মনে হচ্ছে তার কাছেও এ প্রশ্নের সহজ কোন উত্তর নেই৷ আপন করণীয় ঠিক করতে গিয়েই তার বেশ কয়েকটি মুহুর্ত পার হয়ে গেল৷ বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে শাহীনের মাথাটি নিজের ঘাড়ের মধ্যে রেখে পিঠে মৃদু হাত বুলাতে বুলতে বললেন, সে কথা তুমি আমাকে কেন শুধাও নি, আব্বু? তোমার আম্মি কী জানে?


- রতন যে আম্মিকে শুধাতে বলে দিয়েছে৷

- ও তাই? কিন্তু রতন তো ছোট মানুষ৷ সেই ই মস্ত বড় ভূল করেছে৷ তোমাকে সে ঠিক মত বোঝাতে পারে নি৷ আমার সাথে চল৷ আমি তোমাক সব কিছু বলব৷ হবে তো?

শাহীন ফোপাতে ফোপাতে ঘাড় নেড়ে সায় দিল৷

মুজাফফর আবার ওর গালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, এবার থেকে কোন কিছু শুধাতে হলে, আমাকেই শুধাবে৷ কেমন? আচ্ছা বাবা শাহীন, বল তো দেখি, তোমার আম্মি বড়, না আমি বড়?

শাহীন ঘাড় তুলে মামার মুখের দিকে তাকাল৷ বলল, আপনি বড় ৷

- বাহ বাহ ঠিক বলেছ, আমার আব্বু৷ আবার বল তো বাবা, যে বড় সে বেশি জানে , না যে ছোট সে বেশি জানে?
শাহীনের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠল৷ বলল, যে বড় সেই বেশি জানে৷

- চমত্কার! আমার আব্বু ঠিক বলেছে৷ এবার বল দেখি , তোমার আম্মি বেশি জানে, না আমি বেশি জানি?

- আপনি৷ বলে শাহীন মামার ঘাড়ের মধ্যে আবার মুখ লুকিয়ে হাসতে লাগল৷

- তা যদি জানো, তবে আমাকে না শুধিয়ে তোমার আম্মাকে শুধালে কেন? শুধানো তো ঠিক হয়নি৷ তাই না?

- জ্বে হ্যাঁ ৷ বলে শাহীন ঘাড়ের মধ্যে মুখ লুকিয়েই রইল৷

মুজাফফর ওকে বুকে নিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন ৷ কিন্তু টেবিলের ওপর একখানি ছাপা কাগজ পড়ে থাকতে দেখে বললেন, ওটা কী গো?

- আমার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, মামা৷

- কই, দেখি দেখি ৷ বলে প্রগ্রেস রিপোর্টটি মুজফফর হাতে তুলে নিলেন৷ তারপর বাম হাতে শাহীনকে বুকে ধরে, ডান হাতে কাগজটি নিয়ে পড়তে গেলেন৷ কিন্তু চশমা নেই বলে পড়তে পারলেন না৷ বললেন, চল চল৷ ও ঘরে গিয়ে তোমার রিপোর্ট পড়ে দেখি৷

ঘরে ঢুকে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মুজাফফর আনন্দের আতিশয্যে হইচই করে উঠলেন, আরে খসরুর মা , কোথায় গো! শীগগীর করে এদিকে এসো৷

আসমা বেগম একটু দিবানিদ্রার আয়োজন করছিলেন৷ ধড়মড়িয়ে উঠে, ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

- এই দেখো, আমাদের মুনীরুদ্দীন আহমদ বাবা জীবন, পরীক্ষায় কী করেছে৷

- ওমা, কী করেছে, বল না শুনি?

- কী করবে? ফাস্ট হয়েছে৷ অঙ্কে একেবারে একশোর মধ্যে একশোই৷

- তই নাকি? আলহামদুরিল্লাহ্ ওকে দাও দিকি আমার কোলে৷ বলেই আসমা বেগম শাহীনকে কোলে নিয়ে ঘন ঘন কয়েকটি চুমু দিয়ে বললেন, হবে না? বাপকা বেটা সিপাহী কা ঘোড়া৷

মুজাফফর হোসাইন এই আনন্দঘন পরিবেশে হঠাৎ অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন৷ আসমা বেগমের কথা শুনে হঠাৎ তার কী হল , পকেট থেকে রূমালখানি বের করে চশমাটি খুলে দ্রুত আপন চোখের উপর চেপে ধরলেন৷


সেদিনই সন্ধ্যার সময় খসরু এক গাদা বই বগলে বাসায় ফিরছিল৷ সন্ধ্যার আবছা অন্ধাকারে বাইরের রোয়াকের ওপর একজন আগন্তুককে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে সেইখানেই থমকে দাড়ল৷ আবছা অন্ধকারে মানুষটিকে চেনা যাচ্ছে না৷ আগন্তুকের মাথায় নেটের ঘোন টুপি, মুখে দাড়ি, বড় মসজিদের ইমাম সাহেবর মতন অনেকটা দেখতে ৷ খসরু এক কদম এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, এখানে এখানে কারুর মাথে কি আপনি দেখা করবেন?


আগন্তুক বলল, মুজাফফর সাহেব বাসায় আছেন?

- আমি তো বাইরে ছিলাম, সঠিক বলতে পারব না৷ আব্বার তো এখন থাকার কথা৷ একটু ভেতরে বসুন৷ যদি থাকেন, আমি ডেকে দিচ্ছি!

আগন্তুক বলল, আমার বসার দরকার হবে না, শুধু একটা কথা বলেই আমি চলে যাব ৷ একটু ডেকে দিলেই ভাল হয়৷

খসরু 'আচ্ছা ডেকে দিচ্ছি' বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল৷ কিন্তু এক মুহুর্ত পরেই আবার ফিরে এসে বলল, আব্বা যদি আপনার পরিচয় জানতে চান তো , কী বলব?

আগান্তুক বলল, দেবার মত পরিচয় তো কিছুই নেই, শুধু বললেই হবে সে একজন লোক আপনাকে একটা কথা বলে চলে যাবে৷
খসরু লোকটির আপাদমস্তক ভাল করে বার দুই দেখে নিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল৷

কিছুক্ষণ পর মুজাফফর হোসাইন বাইরে এলেন৷ আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে তাকে সালাম দিয়ে বলে উঠলেন, আমার সাথে কথা বলবেন?

প্রত্যুত্তরে আগন্তুক কোন কথা না বলে এক মুহুর্তে সটান মুজাফফরে পায়ের ওপর দুম করে পড়ে গেল৷ তারপর ভাইজান আমাকে ক্ষমা করুন বলে তার পা ধরে কাঁদতে লাগল৷

মুজাফফর আকষ্মিক এই ঘটানায় একেবার হতচকিত হয়ে পড়ে ছিলেন ৷ পর মুহুর্তেই বিষয়টি অনুমান করে শান্ত কন্ঠে বললেন, মাহতাব, ওঠো! মাহতাব পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে আপনি ক্ষমা করুন, ভাইজান! আপনি ক্ষমা না করলে আমার অপরাধের মাফ হবে না৷ বলে সে পায়ের ওপরেই পড়ে পড়ে ডুকরাতে লাগল৷


মুজাফফর আর একটি কথাও বলতে পারলেন না ৷ শুধু মাত্র হাত ধরে ভুলুণ্ঠিত মাহতাবকে টেনে তুললেন৷ এবং একমুহুর্ত পরেই তিনি সেখান থেকে দ্রুত বাসার ভেতরে চলে গেলেন।


মাহতাব সেই আবছা অন্ধকারের মধ্যে দাড়িয়ে দাড়িয়ে চোখের পানিতে বুক ভাসাতে লাগল৷ কিন্তু একটি মিনিট অতিক্রান্ত হবার পরই মুজাফফর হোসাইন আবার দ্রুত এসে ঘরে ঢুকলেন ৷ এবার তার বুকের ওপর শাহীন৷ খসরু বাইরের সুইচাটা অন করে দিতেই আলোয় ঘরটি ভরে গেল৷


মুজাফফর মুহুর্ত কাল এক দৃষ্টে মাহতাবের আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিলেন৷ আজকের এই মানুষটিকে আর আগের মানুষের সঙ্গে মেলানো যায় না৷ এ যেন সেই মাহতাবের কল্পনাতীত রুপান্তর ৷ তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই মাহতাব এখন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা ৷ পাপের সহস্র দরিয়া পাড়ি দিয়ে এখন সে পুণ্যের শুচি শুভ্র বেলাভুমিতে এসে দাড়িয়েছে৷


মুজাফফর রুদ্ব কন্ঠে, বললেন, সত্যিই কি তুমি ক্ষমা চাও, মাহতাব?

মাহতাব কোন জবাব না দিয়ে আবার মুজাফফরের পায়ের ওপর হাত রাখতে গেল৷

মুজাফফর বাধা দিলেন৷ বললেন, দাড়াও৷ আমার কাছে নয়, ক্ষমা চাইতে হলে, তোমার এই নিষ্পাপ সন্তানের কাছেই তা চাইতে হবে৷ আজকেও সে আমাকে বারবার শুধাচ্ছিল, আমার বাবা কে? আমার বাবা কোথায়? আমি তার সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারি নি৷ বলতে বলতে মুজাফফর হোসাইন হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলেন৷ সমস্ত পরিবেশটা এক মুহুর্তে বেদনার্ত হয়ে উঠল৷




মুজাফফর অশ্রুরূদ্ব কন্ঠে বলতে লাগলেন, মুনীরুদ্দীন আহমদ, শাহীন, বাপ আমার! তোমার সামনে এই যে মানুষটিকে তুমি দেখছ, আজ বার বার যাকে তুমি খোঁজ করছিলে , এ সেই৷


শাহীন অবাক চোখে মাহতাবের দিকে তাকাল৷

মুজাফফর বললেন, ঐ মানুষটিই তোমার আব্বা- তোমার পরিচয় ৷ যাও, তুমি ওর কোলে যাও৷

শাহীন একটু ইতস্তত করছিল৷ মুজাফফর বললেন, তুমি আজ আমাদের সকলের হয়ে ওকে মাফ করে দাও, বাপ৷ যাও, ওর বুকে যাও৷


মাহতাব হাত পাতল৷ শাহীন ওর বুকে গিয়ে ঘাড়ের ভেতর মুখ লুকাল৷

মাহতাব অশ্রু সিক্ত চোখে দুয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখল, মুনীরা একপাশে পাথরের মূর্তির মতন স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে৷ দুটি চোখে তার দুটি অশ্রু ধারা নিয়নের শুভ্র আলোতে চিক চিক করছে৷


দক্ষিণের জানালাটি খোলাই ছিল৷ সহসা কোথায় থেকে দমকা একটা বাতাস বাতাবী ফুলের একরাশ মিষ্টি গন্ধ বয়ে আনল৷ তারই স্নিগ্ধ সৌরভে সারা ঘর মুহুর্তে সুরভিত হয়ে উঠল৷




সমাপ্ত

No comments: