Tuesday, May 20, 2008

প্রসঙ্গঃ নারী, এবং আমরা

-মঞ্জীরে এলাহী

আমার জন্ম গ্রামে। খুব কাছ থেকেই আমি দেখেছি গ্রামের মানুষের জীবনাচরণ। সেই জীবন পদ্ধতিকে আমি প্রায়ই চিন-া করতাম এবং এখনও করি। কত যে প্রশ্ন মাথার ভেতরে জমাট বাধত! কতক জবাব পেতাম, কতক পেতাম না। আসলে মানুষের শৈশব যে তাকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে তা কেউই কাউকে বোঝাতে পারে না। সবাই ই তার নিজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারে। আমি সে সময়ের মানুষের সুখ দুঃখ নিয়ে বেশ চিন-া করেছি। বেশ ভালভাবেই বুঝলাম সেখানকার সবচেয়ে মানুষিকভাবে পরাধীন থাকে নারীরা।
আমার মনে হয়েছে খুব কম সময়েই মৌলিক মানবিক দিকে তাদের সুখ দুঃখকে নূন্যতম মূল্য দেয়া হয়। পড়াশুনা, সামাজিক কাজকর্ম, পারিবারিক কাজ, বিয়ে, এসব ক্ষেত্রে মতামত দেয়া বা নিজেদের এসবে সিদ্ধান- নেয়ার ক্ষেত্রে তারা খুব কমই স্বাধীনতা ভোগ করে। এ সবের মত প্রতিটা ক্ষেত্রেই তারা পুরুষদের, বিশেষকরে তাদের কর্তা পুরুষদের মুখাপেক্ষী থাকতে বাধ্য হয়। কারণ নিশ্চয়ই আছে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল তারা প্রায় সবাই ই বুঝতে পারে না যে তারা তাদের কর্তাব্যাক্তিদের মুখাপেক্ষী। আবার কেউবা বুঝলেও তা মেনে নেয়। কারণ তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
আমি বলব না যে এটা এই জন্যই যে কোন বিশেষ পুরুষ বা কোন পুরুষ গোষ্ঠী তাদেরকে এই একচ্ছত্র আধিপাত্যের অধীন থাকতে বাধ্য করে। বরং এটা বলব যে গ্রমের সবাই (বিশেষ করে নারীরা) এমন একটা পরিবেশের মধ্যে আছে , এমন একটা প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে আছে, এমন একটা মানুষিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আছে যে তারা এই অধীনতার মধ্যে থাকছে। আর আমার কাছে মনে হয়েছে যে নারীরা বেশ স্বাভাবিকভাবেই এই জীবনে অভ্যস- হয় খুব ছোটবেলা থেকেই।
আবার আপনি যদি গ্রামের কোন মহিলাকে এ ব্যাপরে জিগ্যেস করেন, দেখবেন বেশিরভাগ নারীই এই অধীনতার ব্যাপারে ক্ষোভ দেখাবে। তারা পুরোটা দোষ দিবে হয় পুরুষদের উপর নাহয় নিজেদের কপালের উপর। তাদের কেউ একবারও ভেবে দেখবে না যে এ ব্যাপারে তারা নারীরা কতটুক দায়ী। এধরণের উদহরণ অহরহ আমাদের সামনে চাক্ষুষ। ব্যাপারটা পরিষ্কার করছি। ধরুন কোন গৃহসে-র মেয়ের সাথে তার শাশুড়ী ঝগড়া বাধায়। তাকে মারধর পর্যন- করে। প্রায়ই মেয়েটা বাপের বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে। এই গৃহসে-র কর্তী তার বেয়াইনকেই এক্ষেত্রে সব অপরাধের মালিক করবে। খূব কম ক্ষেত্রেই সে তার মেয়েকে দোষারোপ করবে। সে তার বেয়াইনকেই ‘খবিশ’ বলবে। কিন' দেখা যায় যে ঐ গৃহস-কর্তীই তার পুত্রবধুর সাথে নিয়মিত ঝগড়া করে। নির্যাতন করে। সে কিন' একবারও ভেবে দেখে না যে যার সাথে সে ঝগড়া করছে বা যাকে সে নির্যাতন করছে সেও তার মেয়ের মত কারো মেয়ে। এক্ষেত্রে সেও কিন' তার বেয়াইন থেকে কম যান না। হা! হা! ব্যাপারটা এরকম, “তোমার বিচার আমি মানছি ঠিকই, তবে তালগাছটা কিন' আমার!”
হয়ত অনেকে বলবেন এটাতো গ্রামের কথা। শহর এখন অনেক আধুনিক। সেখানে দিন বদলে গেছে। আগের মত নেই আর। শহরের সাথে সাথে এখানকার মেয়েরাও বেশ আধুনিক হয়ে গেছে আজকাল। হয়ত কথাটা ঠিক। তবে এখানে দেখেছি মিশ্র মানুসিকতা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি। আমার সাথের বেশির ভাগ মেয়েকেই দেখতাম যেন কোন রকমে অনার্সটা পাশ দিতে পারলেই হল। ব্যাস এসে গেল তাদের বিয়ে। আর মাস্টার্স পাশ পর্যন- বিয়েটা খুব কম জনেরই আটকায়। বন্ধুদের বেশিরভাগেরই মাস্টার্সএর আগেই বিয়ে হয়ে যায়।
হা! হা! বিয়ে হয়ে যায়। একবারও হয়ত ওদের মনে এই প্রশ্নটা জাগে না যে কেন ওদের বিয়ে হয়, আর ছেলেরা বিয়ে করে। এখানে কি একটা অধিপতিশীল ধারণা গোপনে হলেও খুব শক্তিশালীভাবে কাজ করছে না? হয়ত মেয়েরা এটা বুঝতেই পারছে না। আর পুরুষেরাও হয়ত বুঝতে পারছে না। আর সত্যি বলতে কি পুরুষদের এই ব্যাপারটা বোঝার দরকারও পড়ে না। কারণ আমাদের এই তথাকথিত প্রগতির নামে চরম গোড়া ও একপেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের কেবল এই মজাদার আধিপাত্যটাই পেলে হল। এর বাইরে, এটা বৈধ না অবৈধ, তাদের জন্যএটা মঙ্গলময় না অমঙ্গল, এটা কোন ধরণের প্রগতি বা এই শ্রেনীবিভক্ত সমাজের জন্য কোন কারণটই বা দায়ী তা তাদের জানার কোন দরকার নেই।
সে যাইহোক। আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখতাম যে মেয়েদের মানুসিকতাটা এরকম যে কোনরকমে তাদের বিয়েটা ঘটে গেলেই হল। তারপর “ছেলেদের ঘাড়ের উপর বসে জীবনটা নিশ্চিনে- পার করে দাও”। বেশ অনেকবারই আমি আমার মেয়ে সহপাঠিদের মুখে শুনেছি এ ধরণের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মেয়েদের মুখে এ ধরণের কথা শুনে বা তাদের মনে এ ধরণের মানুসিকতা দেখে আমি আসলেই বেশ অবাক হয়েছি। ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এর আসল কারণটা কি। হয়ত এটা ওদের একটা খেয়াল। হয়ত এই ব্যাপারটা ওরা বেশ ‘এনজয়’ করছে। হয়ত আমি যা ভাবছি এসবের কিছুই না। কিন' এটাওতো ঠিক যে এ পর্যায়ের মেয়েদের মধ্যে এ ধরণের ভাবনা থাকাটা মেয়েদের কতখানি সীমাবদ্ধ অবস'ার কথা জানিয়ে দেয়!
অনেকে বলেন নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে এ ধরণের ভয়াবহ অবস'া থেকে নারী’রা মুক্তি পাবে। বেশ ভাল কথা। শুনে ভাল লাগে। নারী বন্দি বা এ ধরণের ভয়াবহ অবস'াটা কারও কাম্য নয়। নারী মুক্তি বা এ ধরণের ভয়াবহ অবস'ার আশু সমাধান আমিও প্রচন্ড ভাবে কামনা করি। কিন-ু কিছুতেই আমার বুঝে আসে না যে অনেকের দেয়া এই অর্থনৈতিক ফর্মূলা বা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার তত্ত্ব এই ভয়াবহ অবস'ার কি রকম অবসান করবে। এখনতো পৃথিবীর নারীদের মধ্যে আমেরিকা, য়্যূরোপের নারীরাই সবচেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করে। তো কে বুক উচিয়ে বলতে পারবে যে সেখানকার নারীরা বেশ নিরাপদেই আছে? রাত বারটার সময়েও কোন নারী নির্ভয়ে মাথা উচিয়ে সদর রাস-া দিয়ে হন হন করে হেটে যেতে পারে? অথচ পুরুষরাতো ঠিকই পারে। সত্যি বলতে কি আমাদের নারীরা যেরকম সামাজিক অনিরাপত্তার মধ্যে জীবন পার করে দিচ্ছে তেমনি পৃথিবীর সব নারীরাই একই সামাজিক অনিরাপত্তার মধ্যে জীবন পার করছে। একটুও ব্যতিক্রম আর পৃথিবীর কোথাও নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ক্লাস নিচ্ছিলেন আমাদের নৃবিজ্ঞান কোর্সের স্যার(নাসি-ক)। বিভিন্ন আলোচনা করতে করতে সে হঠাৎ যে প্রশ্নটা করলেন তাতে আমরা চমকে উঠলাম। সে আমাদের বলল “আচ্ছা ধরে নাও গভীর রাত। নির্জন রাস-ায় একজন স্বাস'্যবতী সুন্দরী মেয়ে হেটে যাচ্ছে। হঠাৎ সে দুজন জোয়ান লোকের সামনে পড়ে গেল। তো, কি করে ঐ সুন্দরী তার লাঞ্চনাকে ঠেকাবে, হ্যা ?” আমরাতো থমথমে। হতবাক হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি ঘেমে গেলাম। এই যখন অবস'া স্যারই তখন বললেন “পারলে না! এটাতো খুব সহজ। লোকদুটো সংযমী হলেইতো হয়ে গেল।” স্যার উত্তরটা বলার সাথে সাথেই আমরা ধপাস করে ঠিক বোকা বনে গেলাম। এত সহজ উত্তর! আসলেই কত সহজ উত্তর! আর আমাদের মথায়ই আসল না ব্যাপারটা!
ঠিক এরকমই হয় আমাদের। খুব সহজ ব্যাপারটা আমাদের মাথাতেই আসে না। আমরা সবসময়েই যাই যত সব জটিল জটিল ফর্মূলায়। আমরা যখন এই প্রসঙ্গে আসি অর্থাৎ নারী প্রসঙ্গে আসি তখন প্রথমেই মনের ভেতরে ঠিক অবচেতনেই কাজ করে যে ‘নারীরা অসহায়! তাদের এইরকম ঘৃণ্য অসহায়ত্বকে সরানোর জন্য একটা ফর্মূলা বের করতেই হবে।’ মানেটা কি দাড়াল! ঠিক শুরুতেই মহা ভুল দিয়েই যাত্রা করলাম। এটাকি সত্য নয় যে আমরা নিজেদের ‘মানুষ’ হিসেবে না দেখে যদি ‘নারী’ আর ‘পুরুষ’ হিসেবে দেখতে থাকি তাহলে কখনই এই শ্রেনী বিভক্তির অবসান হবে না। হওয়ার তো কোন কারণও থাকতে পারে না। কারণ সমাজ যদি মানুষ দিয়ে না হয়ে নারী আর পুরুষ দিয়ে হয় তাহলে আবশ্যিকভাবেই সমাজ বর্তমানের মত গোড়া পুরুষতান্ত্রিক হবে অথবা মর্গানের তত্ত্ব দেয়া আদিমকালের চধষধবড়ষরঃযরপ সংস্কৃতির মত গোড়া মাতৃতান্ত্রিক হবে, যেখানে সন-ান আর পুরুষেরা নারীদের পরিচয়ে পরিচিত হবেন। সম্পত্তি মালিক আর বণ্টনকারী ছিলেন নারীরা।
অনেকে হয়ত বলতে পারেন যে সেই অবস'াতেই যাওয়া হল নারীস্বাধীনতার বা এই ভয়াবহ অবস'ার অবসানের মোক্ষম পথ। কিন-ু তাদের বেশ হতাশ করেই বলতে হচ্ছে যে চাইলেই কেউ সেই অবস'ায় হুটকরে যেতে পারবেন না বা কোন বিশাল বিপ্লবের মাধ্যমেও সেই অবস'ায় যাওয়া সম্ভব নয়। খোদ মর্গানই বলেছেন যে মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হয়েছে দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায়, নানা প্রেক্ষাপটগত ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কারণে।
সে যাই হোক। আমি সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার ধারণা সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হোক বা পিতৃতান্ত্রিক হোক কোনটাতেই সমস্যা নেই যদিবা সেখানে নারী পুরুষের পরিচয় প্রাধান্য না পেয়ে বরং ‘মানুষ’ পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে। সমাজ যদি কেবল মাতৃতান্ত্রিক হয় বা পিতৃতান্ত্রিক হয় তাহলে কখনই এই সামাজিক শ্রেনীকরণের অবসান হবে না। সেখানে হয় নারী অধিপতিশীল হবে নাহয় পুরুষ অধিপতিশীল হবে। সেখানে হয় পুরুষ কতৃক নারী লাঞ্চিত হবে নাহয় নারী কতৃক পুরুষ লাঞ্চিত হবে। এটা কখনও কোন সমাধানের ব্যাপার হতে পারে না। আসলে সমাজটা এমন হলেই কেবল সবারশানি- আসতে পারে যে সেখানে কেউ কারও উপর অধিপতিশীল হতে চাইবে না। সমাজের ভিত্তিটাই হবে সহানুভূতির উপর। যে সমাজে কোন আইন করে নারী নির্যাতন বন্ধ করা দরকার হবে না। সামাজিক শিক্ষার সামগ্রিক ভিত্তিটাই হবে সব রকম নির্যাতনের বিরুদ্ধে। যেখানে মানুষ ‘মানুষ’ই থাকবে। অমানুষ হয়ে যাবে না।
সেই সমাজটাতে থাকা চাই নৈতিকতার সুষম শিক্ষা যার মাধ্যমে রাতের নির্জনে স্বাস'বতী সুন্দরী নারীই কেবল নিরাপত্তা পাবে না বরং একান- নিরালায় মানুষ তার নিজ মনটাকেও কুৎসিকতা, বন্যতা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে। যেখানে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় কেউ তালগাছ দাবী করবে না বরং বিবেক আর ন্যায়বোধের মাধ্যমেই সবাই পরিচালিত হবে। অন্যের দোষ খোজার সাথে সাথে নিজেকেও সংশোধন করবে।
এমন সমাজটা যদি আমরা গড়তেই পারি যার মূল প্রাণ হল নৈতিকতা আর সংযম, তাহলে কেবল আমাদের এই মহা সংগ্রামের নারী মুক্তিই নয় বরং সাথে সাথে পৃথিবীর মানুূষগুলোর মুক্তিও নিশ্চিত। আর সত্যি বলতে কি নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্যই হোক আর পর্দা পালনের জন্যই হোক নারীরা যে এখন বোরখায় মুখ ঢেকে রাখছে তারও প্রয়োজন পড়বে না তখন। কারণ জ্যান- মানুষগুলোর মধ্যে কেউই কোন নারী বা পুরুষের দিকে লালসা আর প্রবৃত্তির মানসে তাকাবেও না।
হয়ত বিশ্বাস হবে না আমার কথা। হয়ত আমাকে কল্পনা বিলাসী অথবা পাগলও ভাবতে পারেন কেউ কেউ। আমি তাদের বোঝাতেও চাইব না বা তাদের দোষও দেয়ার ইচ্ছা নেই আমার। তবে এটুকুতো অনুরোধ করতে পারি যে প্লিজ ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখুন! ভাবলেতো আর পয়সা লাগে না। প্লিজ ভাবুন। আসুন দেখি সেরকম সমাজ জন্মানোর কোন ফর্মূলা আমরা কোন উপায়ে বের করতে পারি কি না। ॥

No comments: