Sunday, April 6, 2008

মুনিরা-৬

এটা আমার মা-হারা বোন৷ এর ভাবী হলেও তুমি, মা হলেও তুমি৷


শুনতে শুনতে মুনীরার চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল ৷ চকিতে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে সে অশ্রু গোপন করে নিয়ে বলল, মাথায় তুললেই সেখানে দাঁড়িয়ে মানুষে নাচবার সুযোগ পায়৷ ভাইজানকে বলে দিও, এ কাজটি যেন তিনি কখনো না করেন৷


আসমা বেগম বললেন , তা সে করতে যাবে কেন? ওর ভয় ছিল তোমাদের মিল-মহব্বত বনি-বনার ব্যাপার নিয়ে৷ তা যখন হয়ে গেছে, তোরা সুখে শান্তিতে আছিস জানতে পারলেই তো মিটে গেল৷ তাতেই তার সুখ৷


আসমা বেগমের কথা শুনে মুনীরার বুকটা কেপে উঠল৷ নিজের কাছেই তার এই নীরবতাকে প্রতারণা মনে হচ্ছে৷ মনের ভেতর এক-একবার ছটফটিয়ে উঠছে ৷ মুনীরা খুব কস্টের সাথে সেই অস্বস্তিটা দমন করে নিল৷


আসমা বেগম কী ভেবে জিজ্ঞেস করলে, মাহতাব এখন ঠিক মত নামায ধরেছে তো?

মুনীরা থতমত খেয়ে গিয়েছিল৷ সামলে নিয়ে বলল, ও তো বাইরে-বাইরেই থাকে বেশিক্ষণ ৷ সব তো আমি জানিও নে ৷

- তার পর সে ঘুষ-ঘাষ? খায়-টায় নাকি? আসমা বেগম হাসি মুখে প্রশ্ন করলেন ৷

- তা তো আমি জিজ্ঞেস করিনে ৷

- রশি একেবারে ঢিলা করে দিসনি দেখিস ৷ স্ত্রীর ডিউটি হচ্ছে মিসগাইডেড স্বামীকে সাধ্যমত ফিরিয়ে রাখা ৷ ঢিল পেলে তো চ্যাংড়া মানুষ বখে যাবেই৷

মুনীরা কোন জবাব দিলনা দেখে আসমা বেগম বললেন , তোর ভাইজান বলছিল, দিনাজপুর থেকেই তোর কাছে যাবে ৷ গেল কিনা কে জানে?

মুনীরা মনে মনে আতংকিত হয়ে উঠল৷ ভাবল, যদি ভাইজান এই সময় ওখানে যান, তাহলে এক তরফা মাহতাবের বক্তব্য শুনে হয়ত তার ওপর নিদারুন চটে যাবেন৷ মুখে বলল, গিয়ে দেখবেন, বাসায় আমি নেই৷ তখন কী করবেন?

- তখন আর কী করবে? হয়ত মাহতাবকে পাকড়িয়ে সাথে করে নিয়ে আসবে৷

মুনীরা কেমন হতাশ কন্ঠে বলে উঠল, আসুক৷

বিকেলে হাসিনা বিদায় নেওয়ার সময় মুনীরাকে কাছে ডেকে বলল, তোকে একটা কথা বলে যাই রে মনি৷

- কী কথা বল ৷

- একটা নির্বোধ লোকের সাথে তোর বিয়ে হয়েছিল ঠিক, কিন্তু ...

মুনীরা জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে বলল, কিন্তু কি?

- লোকটি যতই যা হোক, এখনও সে তোর স্বামী, তাই না?

মুনীরা কোন জবাব না দিয়ে হাসিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ৷

হাসিনা আবার প্রশ্ন করল, নাকি, তোদের সত্যিকারের ছাড়া-ছাড়ি হয়ে গেছে?

মুনীরা জবাব দিল, না, ঠিক তা হয়নি৷

- যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে আমি তোকে বলব, তুই এক কাজ কর৷ তুই ঐ মানুষটির মঙ্গলের জন্যে দোয়া কর৷ আল্লাহ অনেক দুরাচারীকে সুপথ দেখিয়েছেন, তাকেও হয়ত দেখাবেন৷

মুনীরার চোখের চাহনিটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে উঠছে ৷ হাসিনার ধারণার সাথে একমত হতে না পেরে, সে যে কি করবে ভেবেই ঠিক করতে পারছে না৷


হাসিনা বিষয়টি মুনীরার কাছে স্পষ্ট করে তোলার উদ্দেশ্যে বলল, তোর যে বয়েস, এই বয়েসে কোন ভাই তার বোন কে ঘরে রাখতে পারে না৷ রাখা ঠিকও নয়৷

মুনীরা বোবা হয়ে শুনছে৷

- একজন মানুষকে ছেড়ে আরেকজনের ঘরে যদি যেতে হয়, সেটাও তো সহজ ব্যাপার নয়৷ তা তো জানিস?

মুনীর অন্তরাত্মা হাসিনার কথায় ছটফট করে উঠল৷

হাসিনা বলল, সেই মানুষটি ও যে খারাপ হবে না, তার কি তরা কি কোন ঠিট আছে?

মুনীরাকে নির্বাক থাকতে দেখে বলল, কি বলিস গ্যারান্টি আছে?

মুনীরার কাছে কোন যুক্তি নেই। বাধ্য হয়ে যে সে অসহায়ের মত বলে উঠল, কিন্তু জানিস ওর র্কমকাণ্ডের কথা মনে হলে আমার দারুণ ঘৃণা হয় ৷ আমি কিছুতেই সইতে পারিনা ৷

হাসিনা সান্তনা দিয়ে বলল, শোন মনি ৷ পাপ কে ঘৃণা কর, পাপিকে নয় ৷ পাপি হয়ত অপরাধের ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর হাছে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে৷

মুনীরা দুমুহুর্ত চুপ করে কথাটি ভেবে দেখল৷ তার পর বলল, ঠিক আছে, তোর কথা আমি ভেবে করে দেখব৷

হাসিনা খুশি হয়ে বলল, তোর জন্যে আমি দোয়া করছি ৷ আল্লাহ তোর পেরেশানী দূর করুন৷

হাসিনা চলে যাওয়ার পর মুনীরা খাটের ওপর গিয়ে চুপ করে পড়ে ছিল৷

কখন যে ঘুম এসে গেছে টেরও পায়নি৷ আসমা বেগমের মৃদু স্পর্শে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল, ভাবী শিয়রে দাড়িয়ে ৷ মুনীরাকে জাগতে দেখে আসমা বেগম বললেন, ওঠ, একটা বেজে গেছে, চল্ খাবি চল্৷

মুনীরার শরীরে বড্ডা ক্লান্তি বোধ হচ্ছে ৷ ভাবীকে সে বলল, শরীরটা কেমন কেমন লাগছে৷ খাওয়ার মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না ৷
আসমা বেগম আরো ঝুঁকে পড়ে হাতের উল্টো দিকটা মুনীরার কপালে ঠেকিয়ে বললেন, জ্বর জ্বর করছে নাকি? কই কপাল তো গরম নয়৷ কেমন লাগছে বলতো শুনি?

- পেটের মধ্যে খারাপ লাগছে ৷ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ৷

- রাতে ভাল ঘুম হয়নি, বুঝি?

মুনীরা শুয়ে-শুয়েই বলল, ঘুম কিছু নষ্ট হয়েছে ৷ হাসির সাথে কথা বলতে বলতে রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল৷ বলতে বলতে সে ঝট করে উঠে বসল ৷ তারপর দৌড়ে বাইরে গিয়ে চেয়ারে বসতেই হড় হড় করে অনেকখানি বমি করে ফেলল

আসমা বেগম মুনীরাকে বমি করতে দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন৷ কাছে গিয়ে ওর কাঁধের উপর হাত রেখে কিছুক্ষন বসে রইলেন ৷ বমি করা শেষ হলে জিজ্ঞেস করলেন, পেটে কিছু পরেছে বোধহয়৷ নইলে বমি হচ্ছে কেন?

মুনীরার তখনও সামান্য সামান্য উটকি হচ্ছে দেখে আসমা বেগম বদনার নলের ধারা দিতে দিতে বললেন, কি জ্বালা দেখ্ দিকি৷ এত বেলায় এমনিতেই খাওয়া দাওয়া করিসনি৷ তার ওপর সকালে যা খেয়েছিস তার কিছুই দেখছি হজম হয়নি৷ ওঠ চল, আর বমি হবে না৷ শুয়ে থাকলে আরাম পাবি৷


মুনীরা আসমা বেগমের হাতে ভর দিয়ে উঠে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল৷ খুবই সে ক্লান্ত- হয়ে পড়েছে৷ এমনিতে ওর শরীর-স্বাস্থ্য ভাল৷ অসুখ-বিসুখ বড় একটা হয়ই না৷ কিন্তু কিছু হলে ভারি কাহিল হয়ে পড়ে৷

আসমা বেগম সিলিং ফ্যানের সুইচটা অন করে দিলেন৷ পাখাটা বন বন করে ঘুরতে লাগল৷ ক্লান্ত মুনীরা চোখ বন্ধ করে চুপ চাপ পড়ে রইল৷ মুখখানি তার ফ্যাকাসে লাগছে৷

আসমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন লাগছে রে?

চোখ বন্ধ করেই সে জবাব দিল, একটু ভাল৷

- এখন কী কষ্ট হচ্ছে?

- মাথার চাঁদিটা গরম হয়ে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠছে ৷

আসমা বেগম দেয়ালের কোয়ার্জ ঘড়িটার দিকে তাকালেন৷ একটা-বিশ বাজে৷ বললেন, আর মিনিট দশেকের ভেতর খসরু এসে যাচ্ছে ৷ আসুক, এলেই ওকে ডাক্তারের কাছে পঠিয়ে দিচ্ছি ৷ মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া ঘুম-টুম সব কিছুতেই তোর বড্ডো অনিয়ম হয়েছে ৷ নইলে এমন হবে কেন?

মুনীরা ক্লান্তিতে আগের মতই চোখ বুঁজে পড়ে রইল৷ মুখ-চোখে দারুণ ক্লান্তির ছাপ ৷ চোখ দুটো একটু যেন বসে গেছে ৷ মুখখানি ফ্যাকাসে লাগছে দেখতে ৷ দুটি চোখের নীচ দিয়ে কেমন নীলাভ মতন বেষ্টনী দেখা যাচ্ছে ৷ একরাশ ঘন কালোচুল বালিশ উপচে খাটের প্রান্ত টপকে ঝুলে পড়েছে নীচে ৷ আসমা বেগম ওর চুলের ভেতর ধীরে ধীরে আঙ্গুল দিয়ে নাড়া চাড়া করতে লাগলেন ৷


ঠিক মিনিট দশেকের মধ্যে খসরু ব্যাগ কাঁধে ঘরে ঢুঁকে বলল, আম্মি খেতে দিন৷ মুনীরার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল, ফুপু আম্মার কী হয়েছে? অসুখ নাকি?

- তোর ফুপু আম্মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ৷ বমি-টমি করে একবারে যাচ্ছে-তাই ৷ একটু ডক্তারের কাছে যা না, বাবা ৷

- এই দুপুর বেলা ডক্তার চাচা তো ডিসপেন্সারীতে নেই৷

- তাতে হয়েছে কী পাগল৷ তোকে ডাক্তার খানায় যেতে কে বলছে? তুই সোজা তোর ডাক্তার চাচার বাসায় চলে যাবি৷ গিয়ে তোর ফুপু আম্মার অসুখের কথা বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে চলে আসবি ৷

মুনীরা আপত্তি করে বলল, না না, ডাক্তার ডাকতে হবে না৷ এখন আমার বেশ ভাল লাগছে৷ খসরুকে তুমি খেতে দাও৷ খেয়ে দেয়ে তারপর দরকার হলে অবস্থা বলে ওষুধ আনুক ৷

আসমা বেগম আস্বস্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে, তবে তাই কর৷ চল আগে খেয়েই নে৷ বলেই মুনীরার দিকে ফিরে বললেন, তুই এক গ্রাস খেয়ে দ্যাখ না কী হয়? এখন যখন একটু ভাল লাগছে..

- একটু দেরি কর ৷ ঘরে লেবু আছে?

- লেবু? লেবু তো বোধহয় আছে! দাঁড়া লেবু কেটে তোর খাবার আমি এখানেই নিয়ে আসছি৷

মুনীরা বাধা দিয়ে বলল, না না, আনতে হবে না৷ আর একটু সুস্থ হলে আমি নিজেই গিয়ে খেতে পারব৷ খসরুকে খেতে দাও৷ খিদেতে ওর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে ৷

মুনীরা চিৎ হয়ে শুয়েছিল৷ সিলিং ফ্যান বন বন করে ঘুরছে ৷ ঘোরার সাথে সাথে থর থর করে কাপছে৷ ঘরময় স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে৷ মুনীরার মাথার ভেজা চুলগুলি শুকিয়ে উঠেছে৷ রেশমের মতন সেই মসৃণ চুলের একটা অংশ ফুর ফুর করে উড়ে ওর চোখ মুখ, গায়ের আসে পাশে খেলা করছে৷ মুনীরার শরীরটা এতক্ষনে সুস্থ মনে হচ্ছে৷ আসমা বেগম ঘরে ঢুকে ওর চোখ মুখের স্বাভাবিক অবস্থা দেখে বললেন, খসরুকে ঔষধ আনতে পাঠাচ্ছি ৷ ঔষুধ এনে দিলেই ইনশআল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে ৷


- টিফিনের পর খসরুর ক্লাস নেই? বলতে বলতে মুনীরা উঠে বসল৷ মাথার চুলগুলি দু'হাতে গুছিয়ে কানের পাশ দিয়ে পিঠের ওপর নামিয়ে দিয়ে চুপ করে বসল৷

আসমা বেগম বললেন, তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না৷ আমি কালকে ষ্কুলে চিঠি দিয়ে দেব৷ মাস্টার সাহেব তাহলে ওকে আর বকবেন না৷

মুনীরা বলল, অযথা কামাই করে কী হবে? এখন তো বেশ ভাল লাগছে৷ অন্য কিছু হলে আরো খারাপ হয়ে যেত৷ খসরুর কামাই করার দরকার নেই ৷ ও ষ্কুলে যাক৷

খসরু পাশে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল, মুনীরা বলল, খসরু তুই ষ্কুলে যা, বাবা! আমার শরীর এখন অনেক ভাল ৷ চল, খেতে দেবে চল৷

এই একটা ব্যাপার ৷ ছোটবেলা থেকে মুনীরার বরাবরের অভ্যেস, ওকে খেতে দিয়ে কাছে বসে বসে গল্প না করলে ওর খাওয়াই জমত না৷ মুনীরার ছোটবেলার সেই সব স্মৃতি আসমা বেগম ভুলে যাননি৷ মুনীরা যখন ছোট শিশুটি, তখন বধুবেশে এ-বাড়িতে ঢুকেই ঐ একরত্তি মানুষটিকে লালন করবার ভার পাওয়ার পর প্রথম প্রথম যে বিড়ম্বনা মনে হয়নি, তা নয়৷ কিন্তু কোন অজান্তে , কেমন করে ঐ জড় পিণ্ডের মতন শিশুটি তাঁর মাতৃত্বে দাবিদার হয়ে পড়েছিল, আসমা বেগম টেরও পাননি ৷ এ বাড়িতে ঢুকে আরো একটা ব্যাপার তাঁর চোখে পড়েছিল৷ একজন সৌম্য-শান্ত প্রৌঢ় মানুষ বই-পুস্তকের বিরাট গাদার মধ্যে প্রায় সময় ডুবে থাকতেন৷ তখন এই খাটটি ছিল পুব-পশ্চিমে লম্বা করে পাতা ৷ পুব দিকের কোণাতে জানালার ধার ঘেঁষে উঁচু একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল পাতা ছিল৷ তার ওপরেই থাকত গাদা গাদি করে ঠাসা বই সমেত এই সেগুন কাঠের বুক শেল্ফটি৷ পাশে চেয়ার পেতে নিবিষ্ট মনে পড়াশোনা করতেন মুকাররম হোসাইন, আসমা বেগমের শ্বশুর৷


প্রথম দর্শনে প্রৌঢ় লোকটিকে ভয় ভয় লাগত আসমার ৷ মুখে কাচা-পাকা দাড়ি, মাথার চুল বেশির ভাগই পাকা৷ রাশভারী চেহারা ৷ কিন্তু যে মুহুর্তে আসমা বেগম কে তিনি আম্মাজান বলে সম্বোধনর করে ডেকেছিলেন, ঠিক সেই মুহুর্তেই মনে হয়েছিল স্নেহ-দরদের সহস্র উত্স-মুখ এক সঙ্গে খুলে গেছে ৷ আর তারই স্নিগ্ধ ধারায় আসমা বেগম সূচি-স্নাত হয়ে উঠেছেন ৷ আসমা বেগম শিশুকাল থেকে পিতৃহারা৷ পিতৃত্বের অনুপম পরশে তারও হৃদয় সেদিন ধন্য হয়ে উঠেছিল৷


মকাররম হোসাইন দক্ষিণমুখো হয়ে বসে পড়াশুনা করতেন ৷ সেখানে এবার আর একটি আসনের ব্যবস্থা হল৷ মুকাররম হোসাইন বৌমার পড়াশুনার ভার নিজ হাতেই তুলে নিলেন৷ আসমা বেগমের লেখাপড়ার ভালো সুযোগ হয়নি৷ মুকাররম হোসেইন নিজেই আপত্তি করেছিলেন৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষা থাকতে পারে, তবে সুশিক্ষা নেই, এটাই তার ধারণা ছিল৷ শিক্ষার সেই ঘাটতি পুরণের দায়িত্বও তিনি পালন করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে৷


মুকাররম হোসাইন আসমাকে ডাকতেন আম্মাজান বলে, আর আসমাও তাঁকে ডাকতেন আব্বু বলে৷ এমনি করে উভয়েই উভয়ের সন্তানে পরিণত হয়েছিলেন৷ এই সুত্র ধরেই পিতৃহারা আসমা বেগম যেমন একজন পিতা লাভ করেছিলেন, তেমনি মাতৃহারা মুনীরাও পেয়েছিল মাতৃরুপিনী ভাবীকে ৷ সেই ভাবীরই অকৃত্রিম স্নেহরসে বেড়ে উঠেছে মুনীরা৷ তার জন্যেই মুনীরা সেই অতীত অভ্যেসটি আজো ভূলতে পারেনি৷


আসমা বেগম মুনীরাকে খেতে দিয়ে বললেন, হাসির সাথে আগেই তোর প্রোগ্রাম হয়েছিল নাকি?

ধরা পড়বার ভয়ে মুনীরা মুখের গ্রাস নামিয়ে বলল, না ঠিক আগে থেকে প্রোগ্রাম ছিল না, হঠাৎকরেই..

আসমা বেগমের সহসা অন্য কথা মনে পড়ে গেল৷ বললেন, ও হাঁ, সেদিন একটি মেয়ে এসেছিল রে মনি তোর বয়েসেরই হবে ৷

- কোত্থেকে এসেছিল?

- বলল তো ঢাকা থেকে ৷ ওদের বাড়ি নাকি মাহতাবদের দেশে ৷

- দেখতে কেমন? মুনীরা প্রশ্ন করল৷

আসমা বেগম হেসে ফেললেন৷ বললেন, কেমন কী বলব? খুব সাজ-গোজ করা মেয়ে৷ মুখে লাল টুকটুকে লিপস্টিক , গালে রুজ ঘষেছে ৷ চুলগুলি পনীটেল করে বাঁধা ৷ দারুণ কড়া আধুনিকা৷

-কী বলল এসে?

- দেখলাম কথাবার্তাতেও বেশ চালু ৷ তোকে ভাবী-ভাবী করে বলছে ৷ বলল, আপনি নাকি মুনীরা ভাবীর বড় ভাবী? বললাম বড়ই হই আর ছোটই হই, আমিই তো সব৷ আমি ওর একটাই ভাবী৷ পরিচয় জানতে চাইলাম তো বলল, মাহতাব নাকি ওর বাবার ছাত্র৷ সে নাকি মাহাতবের ঠিক ছোট বোনের মতন৷ চিনিস মেয়েটিকে?

মুনীরা শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, চিনি৷ তারপর কী বলল?

- তোর কথা শুধাল৷ বলল, মুনীরা ভাবী আসেনি? আমি বললাম , না তো৷ আমার বাপু সন্দেহ-সন্দেহ লাগছিল৷ ঢাকায় থাকে ৷ তোকেও জানে শোনে৷ আবার তুই এসেছিস কিনা শুধাচ্ছে এসব কেমন- কেমন যেন তখন আমার উল্টা-পাল্টা লাগছে৷ আমার ভয়ও হল৷ আজাকাল কত রকমের চিটফিট ঘুরছে৷ কার মনে কী আছে, বলার জো আছে কিছু? আমি ওকে জিজ্ঞেস ও করলাম৷ ঢাকায় থাকো, অথচ সেও ঢাকায় আছে, খবর জানো না, কী ব্যাপার? জাবাবে সে অনেক কথাই বলল, ডাকায় মিছিল- টিছিল হচ্ছে ৷ গোলমাল লেগে গেছে ৷ ওদের কে হেস্টেলে ছাড়তে হয়েছে৷ দিন সাতেক তোর সাথে নাকি তার দেখা নেই৷ তোর নাকি আসবার কথা, ইত্যাদি৷ যা সে বলল, সত্যি- মিথ্যে সেই জানে৷

মুনীরা জবাব দিল, সবই সত্যি ৷

- তাহলে আমি তো অন্যায় করেছি রে মনি! আসমা বেগমের মুখ খানি পাংশু হয়ে উঠল৷

- অন্যায় কেন?

- যাই বলিস মেয়েটিকে আমি সন্দেহ করেছি৷ অযথা মানুষকে সন্দেহ করা তো পাপ৷ আসমা বেগম অনুশোচনা করতে লাগলেন!

- কিন্তু আজকাল সাবধান না হলে তো উপায় নেই ৷ মানুষ কত রকমে কৌশল করে মানুষকে চিট করছে৷ একটু সাবধান না থাকলে কি চলে?

আসমা বেগম তবু আশ্বস্ত হতে পারলেন না বললেন, তা যাই বলিস মনি, মেয়েটির সাথে আবার তোর যখন দেখা হবে, আমাদের বাসাতে আসতে বলিস৷

আমি মাপ চেয়ে নিব ৷

- আরে ধুর ৷ ও একটা ছেলে মানুষ, ওর ব্যাপারে নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না৷ তারপর বল, শেষ পর্যন্ত সে কি করল?

- চলে গেল আর কি করবে? আমি ওতো জোরে করে ওকে থাকতে বলিনি ৷ যাই বলিস ওর ওই সাজ-গোজ পোশাক- আশাক দেখেই আমার কেমন যেন লাগল৷ কলেজে পড়া মেয়ে হবে সভ্য-ভব্য ৷ ঐ রকম সঙ সাজে কেন? শুনছি ওর বাপ নাকি মাস্টার মানুষ৷

মুনীরা হেসে বলল, শুধু মাস্টার নয় ভাবী ৷ কোন এক জবরস্তপীরের নাকি মুরিদও৷ মুখে বিরাট দাড়ি বুক পর্যন্ত ৷ মাথায় সব সময় টুপি পরেন ৷ হাটু পর্যন্ত আলখেল্লা ৷


আসমা বেগম বললেন, স্ববিরোধী, বুদ্ধি-শুদ্ধি মাথায় কিছু কম নাকি?

- বুদ্ধি কম হলে হেডমাস্টারী করে কীভাবে?

- তা জানিনে, কিন্তু পীরের মুরীদ হয়ে মেয়েকে নর্তকি সাজায় কীভাবে?

মুনীরা হেসে ফেলল, ও বাবা, তুমি দেখছি অন্তর্যামী৷ আসলেই কিন্তু ও মেয়ে নর্তকী ৷ খুব নাটক-ফাটক করে বেড়ায়৷ গান গাইতেও পারে৷ নজরুল গীতি৷

- সত্যি! আসমা বেগমের গলায় বিষ্ময় ঝরে পড়ল৷

মুনীরা হেসে বলল, কেন, তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

- বিশ্বাস হবে না কেন? খুব হচ্ছে ৷ কিন্তু দেখিস, বেশি যেন প্র্রশ্রয় দিস নি, মনি৷ আমাদের মাহতাব আবার রগঢিলে মানুষ৷ গান শুনতে গিয়ে আবার যেন কাত হয়ে না পড়ে৷ বলেই আসমা বেগম হি হি করে হাসতে লাগলেন৷

মুনীরাও সে হাসিতে যোগ দিল বটে, কিন্তু সেই হাসিরই অন্তর্গত কী একটা জিনিস হঠাৎ ছুরির মতন কচ করে ওর বুকে গিয়ে বিঁধল৷ মুনীরার হাসিমুখ সহসা বিকৃত হয়ে উঠল৷



জিনিয়ার ফিরতে ফিরতে দিন পনের লেগে গেল৷ ফেরবার সময় একবার মনে হয়েছিল মুনীরার সাথে সে দেখা করে যাবে৷ মুনীরা নিশ্চয় এতদিন তার ভাই এর বাসায় এসে গেছে৷ এখানে না এলে সে যাবেই বা কোথায়? আসুক-না আসুক সংবাদ একটা সে নিয়ে যেতে পারবে৷ কিন্তু আসার সময় সেটা আর সম্ভবপর হয়ে উঠল না৷ কোচে উঠলে মাঝ পথে নেমে কারুর সাথে দেখা করার কোন জো থাকে না ।একবার তার মনে হয়েছিল কোচে না গিয়ে সাধারণ বাসেই যাবে৷ পথে যাত্রা বিরতি করে মুনীরার খোঁজ খবর নেবার চেষ্ঠা করবে । কিন্তু ওর ভাইয়ের বাড়ির কথা মনে পড়তেই সাহস করেনি৷ ওদের বাড়িটা জিনিয়ার কাছে শ্বাসরুদ্ধকর বলে মনে হয়েছে ৷ মুনীরার ভাবীর সাথে আলাপ হবার পর ওর উত্সাহটুকু তক্ষুণি মিইয়ে পড়েছিল৷ মুনীরার ভাবীর সৌম্য ভাবমুর্তির কাছে জিনিয়ার নিজেকে কেমন যেন খেলো-খেলো মনে হয়েছে ৷ এই রকম অবস্থা ওর প্রায় কোথাওই হয় না ৷ ও দেশে গেলে জিনিয়ার ঝকমকে পোষাক আশাক, মুখে পুরু পুরু রুজ লিপিস্টিক, সাজ সজ্জায় অত্যাধুনিকতা, সব কিছু দেখে মেয়ে-মরদের তাক লেগে যায় ৷ সবাই জিনিয়াকে বিষ্ময়ের দৃষ্টিতে দেখে ৷ কিন্তু মুনীরার ভাবীর চোখে তো সেই বিষ্ময়ের ভাব ছিলই না, বরং কেমন নিস্পৃহতা লক্ষ্য করে জিনিয়া ঘাবড়ে গিয়েছিল৷


কয়েকটি মুহুর্ত মাত্র ৷ কিন্তু তাও ওর নিদারুণ আড়ষ্টতার মধ্যেই কেটেছে৷ আর শেষ মুহুর্তের সেই ভয়টাই ওকে মুনীরার ভাই এর বাসায় যাওয়া থেকে বিরত রেখেছে৷


ঢাকায় ফিরে জিনিয়া এবার সরাসরি মাহতাবের বাসায় গিয়ে উঠল৷ বাসটি এখন নিতান্ত জনশুন্য ৷ সেখানে নির্জনে পড়াশোনার বেশ সুযোগ হবে৷ আর ফাঁকে ফাঁকে মাহতাব বায়না ধরলে তাকে গানও শোনানো চলবে ৷ মাহতাবের মানসিক অবস্থার বিষয়ে জিনিয়ার মনে সামান্য শংকা ছিল৷ কিন্তু এখানে এসেই ওর সেই শংকাটি নিতান্ত অমূলক প্রমাণিত হল৷ কারণ মাহতাব ওর উপস্থিতিটা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে৷ কারুর শুন্য দেউলে একটি দীপবর্তিকা জ্বলে উঠলে সহসা যেমন আঁধার কেটে যায়, মাহতাবের ও তেমনি গাঢ় আঁধার জিনিয়ার আগমনের সাথে সাথেই উধাও হয়ে গেল৷


ছুটি শেষ হওয়ার নিদিষ্র্ট কোন তারিখ নেই ৷ রাজনৈতিক ক্রাইসিস যত বাড়ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানরগুলির বন্ধ থাকার সম্ভাবনাও ততই তীব্র হয়ে উঠছে ৷ জিনিয়ার মা অবশ্যি হোস্টেল খোলার আগে ওকে ঢাকায় যেতে বারণ করেছিলেন ৷ কিন্তু ওর বাবার তাতে পড়াশোনা খুবই ব্যাঘাত ঘটে৷ সেটা একটা দিক ৷ অন্যদিকটাই বেশি দুশ্চিন্তার কারণে ৷ আজকাল দেশ-গ্রামেও কেমন যেন সব বখাটে ছেলেদের উপদ্রব শুরু হয়েছে ৷ ছোট লোকের বাচ্চা সব ৷ ঘরে ছুঁচোর কেত্তন কিন্তু বাইরে তাদেরই আবার কোঁচার লটকন৷ চাল-চুলোর হদিস নেই , মেয়ে ভাগানোর তালে ঘুর ঘুর করে ঘোরে৷ জিনিয়ার অবশ্যিরুচিবোধ আছে৷ এই সব বখাটে ছোকরাদের সে মনে প্রানে ঘৃণা করে৷ কিন্তু তা বলে তো আর চোখ কান বন্ধ করে বসে থাকা যায় না৷ রাতবিরেতে হতচ্ছাড়ারা কোথাও ঘর দরজা ভেঙ্গেও নাকি সর্বনাশ করছে৷ এসব কারণে জিনিয়ার জন্যে ঢাকা থাকাই নিরাপদ ৷ হোস্টেল বন্ধ আছে থাকুক৷ মাহতাবের বাসা তো আর বন্ধ নেই৷


হলোও তাই৷ জিনিয়ার মা বাপের ধারণা ছিল, মাহতাবের বৌ যখন ওকে ভালবাসে তখন দুশ্চিন্তার আর কারণ নেই৷


জিনিয়ার নিজেরও দুশ্চিন্তার অবশ্যি কারণ ছিল না ৷ তবে মুনীরার উপস্থিতির বদলে অনুপস্থিতিটাই বেশি লোভনীয় হয়ে উঠল৷



সেদিন অফিস থেকে এসে মাহতাব দেখল জিনিয়া কী একটা বই নিয়ে ডিভানের ওপর শুয়ে শুয়ে পড়ছে৷ গেন্দা দরজা খুলে দিতেই মাহতাব যে মচ মচ করে ঘরে ঢুকল, জিনিয়া সেদিকে তাকিয়েও দেখল না৷

গায়ের সার্টটি হ্যাংগারে টাঙাতে টাঙাতে মাহতাব বলে উঠল, কী বইয়ে অমন ডুবে আছেন, মাহারাণী৷

জিনিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে বলল, দারুণ ইন্টারেস্টীং বই,মাতু ভাই! পড়েছ কখনো?

মাহতাব ওর পাশ ঘেঁষে ডিভানে বসে, জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বলল, বই এর নামই শুনলাম না, তার পড়েছি না পড়েছি কি করে বলব?

- মে-ঘ-দু-ত৷ বাব্বা, সেই কালিদাস বাবুর মেঘদুত?

কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল জিনিয়া ৷ কালিদাস বাবু? ই হি হি হি৷ তোমার কি আক্কেল, মাতু ভাই? কাশিপুরের কালিদাস কোবরেজ পেলে নাকি তুমি? ই হি হি হি৷ পেটে আমার যে ব্যথা হয়ে গেল গো...

মাহতাব কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সাথে বলল, কেন, হয়নি?

জিনিয়া বেদম হাসতে লাগল, হবে না কেন? একশোবার হতেই হবে৷ না হয়ে যাবে কোথায়?

মাহতাব এবার লজ্জিত মুখে বলল, মেঘদুতের লেখক কালিদাস বাবুই তো মনে পড়ছে৷ সেই যে কবে দাদার আমলে ইন্টারভু দিতে গিয়ে একবার পড়েছিলাম৷ ভালো করে মনেও আছে নাকি ছাই? মেঘ দুত-কালিদাস, সোনার তরী-রবীন্দ্রনাথ, অগ্নী-বীণা-নজরুল ইসলাম... কেন, ঠিক হচ্ছে না?

জিনিয়ার সারা শরীর তখন ও হাসির গমকে ঠির ঠির করে কাঁপছে৷ হাসতে হাসতে বলল, তাই বলে তুমি অতবড় একজন সাহিত্যিককে বাবু বলে ডাকবে? বলবে নাকি রবীন্দ্রনাথ বাবু, নজরুল ইসালাম সাহেব? যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মামলা চালাতে গিয়ে তোমার ব্রেণের ইষ্কু-রুপ ঢিলা হয়ে গেছে৷ আমি আর বাঁচিনে ই হিহিহি৷

মাহতাব বলল, আমি একবার ঐ বইটা দেখেছিলাম, শালার, এমন সব ছবি ছিল বইটায়, চোখ ফেরানো যায় না-
ছবি নেই?

- থাকবে না কেন? আছে ৷ এটা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য, তা তুমি জানো? তুমি কোন আক্কেলে যাচ্ছে-তাই বলছ? মুনীরা ভাবী তোমার ধাতুগত পরিবর্তন করে ছেড়েছে, দেখছি৷

- এই, আলতু-ফালতু বলবি না, বলে দিচ্ছি৷ বলেই মাহতাব জিনিয়ার গাছ-কোমর করে কাপড়-পরা শরীরে তর্জনির খোঁচা দিতেই জিনিয়া তড়বড়িয়ে গড়াগড়ি দিয়ে খাটের অন্য প্রান্তে গিয়ে শাসিয়ে উঠল, এই ফাজিল ছোকরা, অমন কাতুকুতু দিলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি৷

মাহবাব দাড়িয়ে উঠে বলল, ভাল না হয় যা হয় হবে৷ খাওয়া দাওয়া সেরেছিস?

তোমার গুণের সাগর গেন্দুমিয়া দিলে তো খাব? তোমাকে আমাকে এক সাথে না বসিয়ে সে পাতে ভাত বাড়বে বলে তো মনে হয় না৷

- গেন্দুমিয়াও তবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত?

পায়ের জুতো জোড়া আলনার শুকেসে ফেলে কোমরে হাত রেখে মাহতাব দাঁড়িয়ে বলল, খুব যে আজকাল কবিতা চচ্র্চা হচ্ছে, ব্যাপার খানা কি?

- দেখছি মহাকবি কালিদাস মেঘদূতকে দিয়ে কেমন করে যক্ষ-প্রিয়ার মান ভঞ্জন করতে চেয়েছেন ৷ আমাদের ও একজন বিরহীনী যক্ষপ্রিয়া আছেন, তার কাছেও তো মেঘদূত যাবে ৷ কী উপায়ে সেটা সম্ভব তার হদিশ তালাস করছি, জানো?

মাহতাব এই তত্ত্ব-কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারল না তবে জিনিয়াকে কবিতা নিয়ে পড়তে দেখলে ওর মনের মধ্যে হঠাৎ খচ করে ওঠে ৷ সেই আধুনিক কবিটির কথা ওর মনের পড়ে যায়৷ বেচারার মাথায় এক ঝাড় উসকো-খুসকো চুল৷ পরনে মলিন নীলচে জিনসের সরু প্যান্ট৷ পাছার উপর এখানে সেখানে গুটি কয়েক পট্টির পকেট ৷ হাঁটুর সামান্য ওপরে বেঢব ডাবটি ৷ সেটা জুড়ে ইংরেজী হরফে লেখা আছে, আই লাভ ইউ ৷ মাহতাবকে জিনিয়ার সহোদর ভেবে এই ছন্নছাড়া প্রেমিক কবি হামলাতে হামলাতে মাহতাবের বাসা পর্যন্ত এসেছিল৷ জিনিয়াকে দষ্তুরমত রেডিওর আর্টিস্ট বানানোর জন্যে তার নাকি বেজায় গরজ ৷ ছন্নছাড়া কবিটির সাথে রেডিও অফিসে কোন বিশেষ ব্যক্তির নাকি জানা-শোনাও রয়েছে ৷ আর সেই ব্যক্তি কবিকে নাকি রেজিস্টার্ড গীতিকার বানিয়ে দেবার আশ্বাসও দিয়ে দিয়েছেন ৷ সেই সুবাদে শোনা গেছে, কবির সাথে জিনিয়াও দু-চারদিন পার্ক -টার্ক ভ্রমণ সেরে এসেছে ৷ কিন্তু এত সব জেনেও মাহতাব গোটা ব্যাপারটা সর্তকতার সাথে চেপে গেছে ৷ কারণ এই সময় জিনিয়াকে বিগড়ে দিয়ে লাভ নেই ৷ মাহতাবের ঘরে আলো জ্বালাবার কিংবা ঘরটি অন্ধকার করবার বোতামটি এখন যে জিনিয়ারই হাতে ৷


একটু খোঁচা দেবার জন্যই মাহতাব বলল, এই কবিতার প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠার পেছনে কোন কবি-প্রীতি নেই তো রে?
জিনিয়া চমকে উঠেছিল৷ মুহুর্তেই সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, হঠাৎ এই সন্দেহ?

- হঠাৎ আর কি? নারীর মনেভাব দেবা নজানন্তি- কুতা মনুষ্যা ৷

জিনিয়া পরিবেশটাকে হালকা করে বলে উঠল, ওরে বাপরে! এযে সেই কালিদাস বাবুকেও এক হাত দেখিয়ে দেয়ার মতন ব্যাপার হল তোমার৷ ব্যালান্স সিটের তলা দিয়ে রসের ফল্গু-স্রোত যে তর তর করে বয়ে চলেছে৷

মাহতাব সাহস পেয়ে বলল, তবে যে! আগাগোড়া না জেনেই যত খাটো করে তুই আমাকে দেখিস , আমি সত্যি অতো খাটো নই, জানিস?

জিনিয়া অভিনয় করে বলে উঠল, খাটো করে দেখি? বলো কী মাতু ভাই? কত কী যে তোমার মাথায় আসে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই৷ এখনও তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না৷ তাই না?

মাহতাব স্তদ্ব হয়ে জিনিয়ার চোখের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল৷

তারপর ধীর গলায় বলল, তোর কাছ থেকে একটা কথা জানতে চাইরে, জিনি৷ বল, আমাকে ঠিক ঠিক জবাব দিবি?

জিনিয়া অদ্ভুত বাঁকা ঠোঁটের হাসি হেসে বলল, ও বাবা, কথাটি জানতেই পেলাম না, তার জবাব দেব কেমন করে?

- কথা তো বলবই৷

- আগে বল, শুনি৷

- তখন তুই ঠাট্টা করে উঠবি৷

- না, ঠাট্টা করব না বল৷

মাহতাব কেমন ফেস ফেসে গলায় বলল, আমাকে তুই বিয়ে করবি, জিনি? জিনিয়ার মুখ-চোখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল৷ এক মুহুর্ত মাহতাবের মুখের দিখে স্থির হয়ে চেয়ে থেকে বলল, আমাকে বলছ?

- না তো কাকে?

জিনিয়ার চোখ দুটি সাপের চোখের মতন একবার ঝিলিক দিয়ে উঠল৷ ঠোঁটের কোণটা একটু কুঁচকে গেলো, অদ্ভুত এক রকম হাসি হেসে বলল, তোমাকে বিয়ে করবার জন্যে তো একদিন আমিই একপায়ে খাড়া ছিলাম, মাতু ভাই৷ তখন তো পায়ে ঠেলেছিলে৷ ভুলে গেছ?

- তখন আমি তোকে বুঝতে পারিনি রে৷ সত্যি বলছি বুঝতে পারিনি ৷

বিষয়টা খুব গাম্ভীর্যপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে জিনিয়া হালকা করবার জন্যে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, এতদিনে বুঝতে পারলে তাহলে? বুঝলে বুঝলে বিধবা হয়ে তবেই বুঝলে? কিন্তু কোনো বিধবা পুরুষকে বিয়ে করার ব্যাপারে আমার মনে যথেষ্ট দ্বিধা আছে, মাতু ভাই৷

মাহতাব কথার খেই হারিয়ে চুপ করে রইল৷

জিনিয়া বলল, বিয়ে করার এত সাধ কেন হল শুনি? লাইসেন্সটা না হলে কি তোমার মনে পাপ বোধ ঠোকর দিচ্ছে নাকি?

- না৷

- সে আমি জানি৷ আর সেটা আমারও নেই ৷ আমি সে শিক্ষাও পাইনি৷ যাক সে কথা৷ লাইসেন্স ছাড়াই তো তোমার ঘরেই আছি৷ তোমার ভাত খাচ্ছি...

- ফাজলামো করিস না, জিনি৷ মাহাতাব একটু ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল৷

জিনিয়া হাসতে হাসতে বলল, সত্যি কথাটার ভেতর ফাজলামো কোথায় দেখলে ।

- তুই বিয়ে করবি কিনা তাই বল৷ ওসব আজে বাজে কথা আমি শুনতে চাইনে৷

জিনিয়া তেমনি তরল ভাবে বলতে লাগল, বেশি সুবিধাটা কী হবে তাই শনি? লাইসেন্স করা একজন সুন্দরী অপ্সরা তোমার ছিল৷ তার লাইসেন্সটা তোমার ড্রয়ারেই রয়ে গেছে৷ সে আকাশের পরী, আকাশেই উড়ে গেছে৷ তুমি তার কী করতে পারলে?
মাহতাব বলল, সব কিছুই পারতাম৷ ইচ্ছে করেই আমি সেদিকে পা বাড়াই নি ৷ ওকে নিয়ে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম৷ সে যা চায়, তা দিতে গেলে আমার দুনিয়াটাই একেবারে নিরানন্দে ভরে যেত৷

- আর আমি? জিনিয়া প্রশ্ন করল৷

মাহতাব কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করে বলল, তোর গালে দেব একটা কিল৷ তুই তা জানিস না?

জিনিয়া হেসে বলল, কিল মারো আর যাই করো, কে জানে শেষমেশ তুমি আমাকে নিয়েও আবার হাঁপিয়ে ওঠো কিনা৷

মাহতাব গদগদ কন্ঠে বলল, না রে না, তোকে নিয়ে আমি কোন দিনই হাঁপাব না৷ তুই তো ষড়ঋতুর মতন বৈচিত্রময়ী৷ প্রতি মুহুর্তে রঙ বদলাবি, আর তোকে আমি নানা রূপে উপভোগ করব ৷

- উরিব্বাস৷ তুমি যে ভয়ানক কবি হয়ে উঠলে মাতু ভাই৷ প্রেমে পড়লে মানুষ যেমন কবি হয়, তেমন নয় তা?

- ফাজলামো ছাড়, জিনি৷ হয় তুই আমাকে কথা দিবি, নয়ত না বলে দিবি৷ এই দুই এর এক৷ আমি অন্য কিছু বুঝিনা৷

জিনিয়া তেমনি বাঁকা ঠোটে হেসে বলল, কথা যদি দিতেই হয়, তাও তো ভেবে চিন্তে দিতে হবে? হুট করে তো আর কথা দেয়া যায় না৷ আবার শেষ তক তোমার সেই সুন্দরী রমণীর জন্যে হৃদয় আমার কেমন কেমন করে রে, যদি হয়, তখন? আমি তো সতীন নিয়ে ঘর করতে পারব না৷ তাও যে সে সতীন নয়৷ যাকে বলে প্যারাগন অব বিউটি৷

মাহতাব ক্লান্ত হয়ে বলল, এখন তো তুই নানান কথাই বলবি৷ কিন্তু জানিস, আমি তোর জন্যই ওকে বিদেয় করলাম৷ এখন তো তুই দিল্লাগী করবিই , সে আমি বুঝি রে..

- কী তুমি বোঝ? আমি কেমন করেই বা তোমর সাথে দিল্লাগী করলাম? আগে শখ করে হেটেল মোটেলে ডাকতে , এখন তো তোমার নিজের ঘরেই আছি৷ তখন কত আদর করে সেই যে হেঁড়ে গলায় গাইতে এসো এসো আমার ঘরে এসো... এখন তো আমি সেই তাই- না চাহিতে যাহা পাওয়া যায়৷

মাহতবের মাথায় জিদ চেপেছে ৷ খপ করে জিনিয়ার একটা হাত ধরে বলল, তুই বিয়ে করবি কিনা বল৷

জিনিয়া কঁকিয়ে ওঠার ভান করে বলল, উরিব্বাবারে৷ হাতটা আমার ভাঙ্গল৷ এই হাত ছেড়ে দাও৷ বলছি বলছি, বিয়ে করব, করব৷ হল তো?

মাহতাবের সন্দেহ যায় নি ৷ প্রশ্ন করল, বিয়ে তো করবি, কিন্তু কাকে?

- তোমাকে..... তোমাকে....তোমাকে হল তো? এবার হাত ছাড়৷

মাহতাব জিনিয়ার হাতটা ছেড়ে দিল৷

জিনিয়া বলল, তোমার বোধহয় খিদের কথাও ভুল হয়ে গেছ ৷ কিন্তু আমার যে এখন পেটের ভেতর চোঁ চোঁ করছে ৷ গেন্দার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এই গেন্দা, খেতে টেতে দিবি, হতচ্ছাড়া?

গেন্দ শশব্যস্ত হয়ে উঠল, অনেক্ষণ আগেই তো দিয়েছি , আপা৷ আপনেরাই তো খাইত্যাছেন না৷ ভাত তরকারী ব্যাকটি ঠাণ্ডা বরফ অইয়া যাইত্যাছে৷

দুজনেই এবার লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল৷

ওরা খেতে বসেছে ঠিক সে সময় কলিং বেলের আওয়াজটি শোনা গেল৷ অসময়ে এই আওয়াজটি শুনে বিরক্তিতে মাহতবের দুটি ভ্রু কুচঁকে উঠল৷

গেন্দা জিজ্ঞাসু মুখে মাহতাবের দিকে তাকাল দড়জা খুলে দেবে কিনা সে জানতে চায়৷


- কে দেখ ৷ ড্রইং রুমে বসতে বল ৷ মাহতাব গেন্দা কে হুকুম করল৷

গেন্দা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলেন মুজাফফর হোসইন ৷ দিনাজপুর থেকে সোজা তিনি ঢাকায় এসেছেন ৷ মুনীরার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে মনটার ভেতর ছটফট করছিল৷ কাজের চাপে তিনি এতদিন কিছুতেই সময় করে উঠতে পারে নি৷ গতকালই হাতের কাজটি শেষ হয়ে গেছে ৷ আর দেরি না করে রাত্রির কোচেই তিনি উঠে পড়েছিলেন ৷


হাতে একটি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে মুজাফফর ঘরে ঢুকলেন৷ তাঁর পেছনে পেছনে রিকসা ওয়ালা রাজশাহীর ফজলি আমের একটা ঝুড়িও এনে নামিয়ে রেখে গেল৷ ঘরে ঢুকে মুজফফার সারাটা ঘর ভালকরে দেখে নিলেন৷ বোনের বাসায় এই প্রথম আসা ৷ মনে তাই কিছু কৌতুহল জাগছে ৷ ঘরের ডান দিকের মেঝের ওপর চৌকস একটা সুজনি বিছানো রয়েছে ৷ চাদরের ওপর ঠিক মাঝ বারাবর এক জোড়া ডুগি-তবলা ৷ তার পাশে ঝকমকে বার্ণিশ করা একটা হারমোনিয়াম ৷ পুব পুশ্চিম করে পাতা ডিভানটা সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা৷ দেয়ালের পাশে দরজার দিকে মুখ করে রাখা বড়োসড়ো একখানি শোকেস৷ শোকেসের ওপরে সাত-আট ইঞ্চি উঁচু কাঠের একটা নারী-মুর্তি ৷ একেবারে উলঙ্গ দেহে মাথার ওপর আড়া -আড়ি ভাবে হাত রেখে দাড়িয়ে ৷ সেই নারী- মুর্তিটির কাঁধের টের কনুই এর ওপর ভর রেখে আর একটি উঙ্গল মিশমিশে কালো পুরুষ-মুর্তি মুখে আঁড়বাশি নিয়ে দাড়িয়ে আছে শ্রীকৃঞ্চ স্টাইলে ৷ সেদিকে মুজাফফর হোসাইনের চোখ পড়তেই তার মনে হল তিনি কোন ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন৷ এ-ঘর তো মুনীরাদের হতে পারে না৷ বেশ কিছুক্ষন বসে বসে তিনি ভাবতে লাগলেন৷ মনটা তার উশখুশ করতে লাগল৷ মুজাফফর অধীর আগ্রহে এই বাড়ির কর্তা ব্যক্তিটির অপেক্ষা করতে লাগলেন৷


ওদিকে গেন্দা মারফত্ মাহতাবের কাছে মুজাফফর হোসাইনের খবর পৌঁছে গেছে৷ খবর পেয়ে ওরা দুজন ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি শুরু করেছে ৷ ওরা যে মুহুর্তকাল আগে অসম্ভব ক্ষুধার্ত ছিল৷ এখন সে কথাটি বিলকুল ভুলে গেছে৷


কী করবে স্থির করতে না পেরে মাহতাব একবার গেন্দার দিকে তাকল৷ ওর চোখমুখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে৷ ছোড়াটার প্রতিই অকারন তার সীমাহীন রাগ এই মুহুর্তে চন চন করে উঠেছে৷


ছোঁড়াটা যদি দরজা খুলে না দিত, তাহলে হয়ত এই ঝনঝাটের সম্মূখীন তাকে হতে হত না৷ একটু আগে মাহতাব নিজেই যে ওকে দরজা খুলতে হুকুম দিয়েছিল, এখন সেটাও বেমালুম ভুলে গেছে ৷


অদ্ভুত বিহবলতার মধ্যে মাহতাবের মুহুর্তগুলি তর তর করে কেটে যাচ্ছে ৷
সিদ্ধান্ত স্থির করতে না পারাতেই প্রায় মিনিট পনের সময় অতিবাহিত হয়ে গেল৷


কাউকে সাড়া দিতে না দেখে মুজাফফরের ধারনাটা মজবুত হয়ে গিয়েছিল যে, নিশ্চিত তিনি ভুল বাসায় উঠে এসেছেন৷ বাসার নম্বরটা হয়ত তার কাছে রং নম্বর হয়ে পৌছেছে৷ তাই ভেবে দু মুহুর্ত ইতস্ত করে মুজাফফর একবার উঠতে গেলেন৷ গৃহ কর্তার সাথে দেখা হয়নি ভালই হয়েছে৷ সুতরাং শীঘ্র শীঘ্র ওঠাই ভাল৷


আসন থেকে উঠেই হঠাৎ তার দৃষ্টি পশ্চিমের দেয়ালে৷ এতক্ষন সেদিকে তার নজর পড়ে নি সেদিকে চোখ পড়তেই মুজাফফার আবার ধপাস করে বসে পড়লেন৷ না, বসার ব্যাপারে তার ভুল হয়নি৷ ওই তো দেয়ালে মুনীরা মাহতাবের ফটো ঝুলছে৷ ঠিক এই মুহুর্তে মনে পড়ল, মুজাফফর এই ঘরে ঢোকার আগে দরজার মাহতাবের নাম ও ডেজিগনেশন সহ একটি নেম প্লেটও দেখে ছিলেন৷ কী আশ্চর্য ঘরের ভেতরটায় চোখ পড়ে তাও বিলকুল ভুল হয়ে গিয়েছিল!


মুজাফফর এবার নিশ্চিত হয়ে ডাক দিলেন, মনি!

হল ঘরের মধ্যে একটা প্রতিধ্বনির মতন শব্দ উঠল নি... ৷ কিন্তু কেউ সাড়া দিল না৷

আবার ডাকলেন, মাহতাব?

ঠিক তেমনি আবার যেন একটা শব্দ শুলেন আ... ব...৷ কিন্তু কারুর কোন সাড়া শব্দ নেই৷

বিস্মিত মুজাফফরের কাছে গোটা পরিবেশটাই ভুতুরে হয়ে উঠল৷ অথচ একটু আগে একটি বেটে খাটো গোলগাল ছেলে ঘর খুলে দিয়ে গেছে ৷ তারও এখন পাত্তা নাই৷ আবার তিনি পশ্চিমের দেয়ালের দিকে তাকালেন, সেখানে মুনীরা মাহতাবের এনলার্জড ফটোটি অগের মতই ঝুলছে৷


মুজাফফর হোসাইন কী করবেন ভাবছেন। ঠিক এমনি সময়ে মাহতাব এসে সামনে দাঁড়ালো। মাহতাবের চোখে মুখে দারুণ বিরক্তির চিহ্ন বিরাজ করছে। সে যেন মুজাফফরকে চেনেই না এমন ভঙ্গিতে বলে উঠল, কী চান, বলুন।


মাহতাবের মুখের কথাটি উচ্চারিত হতেই মুজাফফর একেবারে হতচকিতে হয়ে উঠলেন৷ জীবনে কখনো এমন ধরনের বিষ্ময় এর ঘোরে তিনি পড়েন নি৷ বিমূঢ়ের মত বলে উঠলেন এ কী বলছ তুমি মাহতাব?


মাহতাব আত্মরক্ষার জন্যে প্রষ্তুতি নিয়েই এসেছিল ৷ তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল ঠিকই বলছি৷ এ ছাড়া আমি আর কী বলব? আমার কিছুই বলার নেই৷


মুজফফর হোসাইন মাহতাবের দ্বিতীয় উক্তি শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন৷ তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন ? মাহতাবের কী এমন ব্যাপার হতে পারে?
নাকি মাহতাব পাগল হয়ে গেছে ? মুজাফফর নিজেকে সংযত করে শান্ত কন্ঠে বললেন৷ মনি কোথায় ? মনিকে ডাক৷


মাহতাবের ধারনা মুনীরার ব্যাপারে সব কিছু জেনে শুনেই মুজাফফর তাকে শাসন করতে এসেছেন৷ তাই সে রাগের চোটে ঘাড় বেকিয়ে দাড়িয়ে রইল৷ মুজাফফরের কথায় কোন উত্তর দিলনা ৷


মুজাফফর অবার জিজ্ঞেস করলেন, মনি কোথায়, বলছ না কেন?

- সে কোথায় সেটা আপনিই ভাল জানেন৷

- মানে? মুজাফফরের চোখের ভ্রু কুঁচকে উঠল, কী সব তুমি বলছ, মাহতাব?

মাহাতাব আবার লা-জাবাব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷

মুজাফফর অধীর হয়ে প্রশ্ন করলেন কেন, মনি এখানে নেই?

- না৷ মাহতাব তাচ্ছিল্যের সাথেই জবাব দিল৷

- নেই? কী বলছ? সে এখানে নেই? মুজাফফরের কন্ঠস্বর উদ্বেগাকুল হয়ে উঠল৷

- বললাম তো, নেই৷ মাহতাব তিক্ত কন্ঠে আবার উত্তর দিল ৷

মুজাফফরের কন্ঠস্বর এবার উচ্চগ্রামে উঠল, তাহলে সে গেছে কোথায়?

- জানিনে৷ মাহতাবের ঝাড়া জবাব৷

মুজাফফরের সারাটা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠল৷ জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মূখীন আর তাঁকে কোনদিনই হতে হয়নি৷ তিনি আসন থেকে ঝাঁ করে উঠে দাঁড়ালেন৷ তারপর আকষ্মাৎ ভীষণ চিত্কারে ফেটে পড়লেন, জানো না মানে? হোয়াট ডু ইউ সে? এই, জানো না মানে কী?


এবার মাহতাবের চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ইউ ষ্কাউণ্ডেল৷ জানো না মানেটা কী? ভীষন রাগে মুজাফফরের সমস্ত শরীর এখন থর থর করে কাঁপছে ৷ তিনি বলতে লাগলেন, জানো না? সে কোথায় গেছে, জানো না? দাঁড়াও তোমাকে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি ৷ তুমি আমাকে চেনো? তোমার আমি কী করতে পারি সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারো? আনগ্রেটফুল! ইউ কেম টু মী লাইক এ লিকিং বীচ৷ সেদিন তোর মুখে আমি লাথি না মেরে তোকে সিংহাসনে বসিয়েছিলাম৷ ছোট লোক ৷ তুই আমার সে করুণাকে দূর্বলতা মনে করেছিলি, তাই না? ভেবেছিস আমি তোকে এমনিতেই রেহাই দেব ৷ নো নো নো ৷ মুজাফফর হোসাইন সহসা রাগে-দুঃখে একেবারে উম্মাদ হয়ে উঠলেন ৷ চীত্কার করে বলতে লাগলেন, আমার বোনকে তুই কী করেছিস? এই খুন করেছিস? তুই খুনী মার্ডারার? ওয়েট৷ আই শ্যাল সি ইউ, ওয়েট ৷


মুজাফফরের এই আকষ্মিক ব্যবহারে মাহতাব ভয় পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে ৷
জিনিয়াও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দৌড়ে মাহতাবের পাশে এসে দাড়িয়েছে ৷ ওর ভয় হয়েছে এই ক্রোধান্ধ মানুষটি হঠাৎ না জানি কী না কী করে বসে৷


জিনিয়াকে দেখে মুজাফফর হোসাইন বলে উঠলে, এই, তুমি কে? আমার মুনীরার খবর তুমি জানো?

জিনিয়া কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিল, মুনীরা ভাবী চলে গেছে৷

- চলে গেছে? কবে?

- দিন পনের হবে৷

- কোথায় গেছে?

- তা জানিনে৷

মুজাফফর এবার হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কেন গেল? এমনি-এমনি তো চলে যাবার মানুষ সে নয়? আমি তো তেমন করে তাকে গড়ে তুলি নি ৷ সে কিছুতেই যেতে পারে না ৷ এই ষ্কাউণ্ডেল আমার বোনকে হত্যা করেছে ৷ এই, সত্যি করে বল, কী করেছিস? সত্যি করে বল ৷

মুজাফফর মাহতাবের চোখে চোখ রেখে তাকালেন ৷

মাহতাবের মুখে এখন আর একটি কথাও ফুটছে না৷ সে যেন অকষ্মাৎ পাথরের মূর্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে ৷ একটু আগেও মাহতাব ধারণা করেছিল, কিছু একটা চোট পাট দেখালেই হয়ত মুজাফফর ঘাবড়ে যাবেন ৷ কিন্তু এখন হিতে বিপরীত হয়ে গেছে ৷ হত্যার অভিযোগ এনে মুজাফফর মাহতাবকে ভীত করে তুলেছেন ৷


দুমুহুর্ত স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে মুজাফফর বললেন, বুঝতে পেরেছি, তোর জবাব দেবার শক্তি নেই৷ ঠিক আছে, আজ আমি যাচ্ছি৷ তোর বত্রিশ নাড়ীর টান মেরে যদি বার না করি, তাহলে জানবি আমি বাপের ছেলে নই ৷ বলেই তিনি সেই মুহুর্তে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ৷


হতবুদ্ধি জিনিয়া ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলল, এই গেন্দা, দেখ তো এগুলি কী রেখে গেল এক দৌড়ে দিয়ে আয়৷


গেন্দা আমের ঝুরি আর মিষ্টির প্যাকেট হাতে করে পেছনে পেছনে ছুটে গেল ৷ নির্বাক মাহতাব পাথরের মতন নিশ্চল দাড়িয়ে রইল৷




সারাটা পথ মুজাফফরের যে ভাবে কেটেছে, তা ভাবতে গিয়ে তার নিজের শরীরই এখন অবশ হয়ে আসছে৷ এই রকম অবাঞ্ছিত ঘটনার মুখোমুখ তাকে কখনোই হতে হয়নি৷ মুজাফফর যে পরিবেশে বড়ো হয়েছেন, সেখানে তিনি চিরদিন পবিত্রমনা ও উন্নত চরিত্রের মানুষের আনাগোনা দেখেছেন৷ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এখন অবশ্য বিচিত্র ধরনের মানুষের সাথে তার দেখা শোনা হয়, কিন্তু কারুর কোন ব্যবহারের প্রতি মুজাফফর গভীরভাবে দৃষ্টি দেবার অবসর পান না৷ ঐ সব মানুষকে সাধারণত তিনি এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন ৷


কিন্তু মাহতাবের ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ৷ তার সাথে মুজাফফরের আত্নীয়তার সম্পর্ক হয়েছিল ৷ মাহতাবকে অন্তর দিয়ে তিনি ভালও বেসেছিলেন৷ মুজাফফরের সেই ভালবাসা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ৷ সেই ভালবাসার পাত্র আজ তার সাথে এ কী ব্যবহার করল? মানুষ এতদূর নীচে নামতে পারে? একদিন এই মাহতাবই বিনয়ে বিগলিত হয়ে মুজাফফরের কাছে আত্নসমর্পণ করেছিল৷ সেই মানুষই আজ এই রকম অকল্পনীয় ঔদ্বত্য দেখাতে পারল?


আজ মনে হচ্ছে মুজাফফর সেদিন বড় রকমের একটা ভুল করে ফেলেছিলেন৷ মাহতাবের মেধা ও শিক্ষা দেখে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ ধারণা করেছিলেন মেধাবী মাহতাবকে সামান্য তদ্বিরেই তিনি ইচ্ছে মতন গড়ে নিতে পারবেন৷ এদেশের উচ্চশিক্ষার মধ্যে সত্যিকারের শিক্ষা নেই বলেই মজাফফরের বদ্বমূল ধারণা ৷ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সম্মানজনক ডিগ্রী লাভের পর মুজাফফরের অনেক সতীর্থকে তিনি ঘুষ খেতে দেখেছেন ৷ ভাগ্য গড়ার হীন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে অনেকেই জাতীয় সম্পদের অপচয় করছে ৷ তাদের অপকর্মের ফলশ্রুতি স্বরুপ রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, আর বড় বড় কল কারখানা, ইমারত বিল্ডিং হর হামেশা ধ্বসে পড়ছে ৷ উচ্চ শিক্ষা লাভের পরেও এরকম ভাবেই তাদের চরিত্র গড়ে ওঠে। এখানে শিক্ষার সাথে চরিত্র গঠনের নেই কোন বন্দোবস্ত ৷ মুজাফফর মনে করেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে হিংস্র শার্দুল তৈরীর ট্রেনিং দেয়া হচেছ, মানুষ গড়ার নয় ৷ ফলে যা হবার তাই হচ্ছে৷ গোটা দেশ ঐ সব তথাকথিত শিক্ষিতদের হান্টিং গ্রাউন্ডে পরিনত হয়েছে ৷ মুজাফফর এসব শিক্ষিত মানুষদের করুণার পাত্র বলে মনে করেন৷


মাহতাব কে নির্বাচন করতে গিয়ে যে ভুলটি তিনি করেছিলেন৷ এই মুহুর্তে সেটিও যেন তার চোখে স্পষ্ট হয়েই ধরা পড়েছে ৷ সে ছিল পিতৃমাতৃহীন একজন গরীব যুবক ৷ মাতৃকুলের দু'একজন আত্মীয় ছাড়া পিতৃকূলের পরিচয় দেওয়ার মতন কেউ তার ছিলনা ৷ বাল্যকালে মামার বাড়িতে সে মানুষ হয়৷ মেধার কারনেই সে উচ্চ শিক্ষা লাভে সক্ষম হয় ৷ মুজাফফরের ধারনা ছিল এরকম গরীব ও মেধাবী ছেলের মধ্যে নৈতিকতার ভিত্তিটা হয়ত মজবুত হবে ৷ দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনে যাদের জীবন গড়ে ওঠে, তাদের মধ্যে নীতি-নিষ্ঠার অস্তিত্ব আশা করা যায় ৷ এরকম একটা ধারনা তার বরাবর ছিল ৷ কিন্তু মাহতাবের সাথে মুনীরার বিয়ে দেবার পর তিনি স্পষ্টবুঝতে পারলেন, তার ধারনাটা মোটেই নির্ভুল নয়৷ তবু আশা ছাড়েন নি৷ ভেবেছিলেন, মুনীরা তার চরিত্র-সুষমা দিয়ে মাহতাবের মধ্যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে৷ সে আশাও তার অবশেষে ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল৷ মাহতাব যে এই রকম ব্যবহার করবে, মুজফফর তা কষ্মিনকালেও কল্পনা করতে পারেন নি ৷ মাহতাবের আচরণ মনে করতে গিয়ে মুজাফফরের কলিজাটা জ্বলে যেতে লাগল৷ একটা নর-পশুর হিংস্র মূর্তি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই রাগে দাঁতে দাঁত চেপে তিনি অস্ফুটে বলে উঠলেন, ষ্কাউন্ডেল! কথাটা আবার উচ্চারণ করতে গিয়ে তিনি নিজেই আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন এই শব্দটি অতীত জীবনে আর কবে উচ্চারণ করেছেন, সে কথা এখন তিনি মোটেই ষ্মরণ করতে পারছেন না ৷ দুঃখে-শোকে তাঁর চোখ দুটি জ্বালা করে উঠল৷


বাসায় পৌঁছে সদর দরজার কড়া নাড়তে গিয়ে মুজাফফর হোসাইন একবার চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন৷ আসমাকে তিনি কী জবাব দেবেন? আসমা বেগম মুনীরাকে দেখতে যাওয়ার জন্যে বারবার করে বলে দিয়েছিলেন ৷ কী করে বলবেন যে, তিনি মুনীরাকে দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু দেখা তার পাননি৷


অবশেষে দরজার কড়া তাকে নাড়তেই হল৷ দরজা খুলে দিল খসরু৷
আব্বাকে দেখে খুশীতে ওর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ৷ আব্বার হাত থেকে সে ঝুড়ি ও মিষ্টির প্যাকেট নিতে গেল৷ মুজাফফর বলল, তুমি মিষ্টির প্যাকেটটা নাও, ঝুড়িটা ভারি হবে, ওটা আমি নিচ্ছি ৷ মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খসরু বলল, আব্বা, ফুপু আম্মা এসেছেন ৷


- আঁ, এসেছে? মনি এসেছে? হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত খবরটি শুনে মুজাফফর খুশীতে বিহবল হয়ে উঠলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, কবে এসেছে মনি?

- অনেক দিনই তো হল৷

- অনেক দিন! খুশী ও বিষ্ময় মেশানো গলায় আবার প্রশ্ন করলেন মজাফফর ৷

- তা দিন দশেক হল এসেছ ৷ বলতে বলতে আসমা বেগম সামনে এসে দাঁড়ালেন ৷ রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো?

- না৷ মনি কোথায়?

- ওই ঘরে শুয়ে আছে৷

- এখন অসময়ে শুয়ে কেন?

- এমনি শুয়ে আছে৷ খুব ভোরে উঠেছে৷ নামাযের পর পড়াশুনা নিয়ে বসেছিল৷ বোধকরি পড়তে পড়তেই ওর ঘুম এসে গেছে ৷ ডেকে দেব নাকি?

মুজাফফর বললেন, না থাক৷ ডাকার দরকার নেই ৷ বিশ্রাম করছে করুক ৷

বলতে বলতে তিনি তাঁর নিজের বেডরুমে এসে ঢুকলেন৷ বিছানার ওপর ধপাস করে বসে পড়ে প্রশ্ন করলেন, মনি এলো কার সাথে? একলা?

- একলা কেন হবে? ওর এক বান্ধবীর সাথে এসেছে ৷ তাকে তো তুমি চিনতে পারবে ৷ আহসান সাহেবর কথা তোমার মনে আছে?

- কোন আহসান সাহেব?

- এখানে কোর্টে হাকিম ছিলেন ৷ ভদ্রোলোকের যশোরে বাড়ি ৷

- হ্যাঁ হ্যাঁ ৷ মনে থাকবে না কেন?

- তাঁর এক মেয়ে ছিল হাসিনা, তার কথা মনে আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের মনির সমবয়সী৷ আমরা তাকে হাসি বলে ডাকতাম৷

- সেই হাসির সাথেই এসেছি৷

- তাই নাকি? তাকে কোথায় পেল মনি? হাসি ঢাকায় থাকে নাকি?

- না, থাকে ভেড়ামারায় ওর হাজবেণ্ডও ইনজিনিয়ার ৷ তোমাদের ওয়াপদাতেই কাজ করে ৷ হাসির শ্বশুর বাড়ি ঢাকায়৷
মুজাফফর প্রসঙ্গটিকে আর দীর্ঘায়িত করলেন না৷ পায়ের জুতো মোজা খুলে সেগুলি যথাস্থানে রাখলেন৷ তারপর গায়ের জামা কাপড় খুলে আলনায় রেখে বললেন, চল মনিকে দেখে আসি৷

মুনীরার ঘরে ঢুকে দেখলেন, বালিশে কাত হয়ে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে রয়েছে৷ মাথার চুলগুলি আলু থালূ হয়ে গালে, মুখে, কপালে লেপটে আছে ৷ মুখখানির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে নিদারুণ ক্লান্তির ছাপ ৷ ওকে বেশ রোগা রোগা লাগছে দেখতে ৷

মুজাফফর আস্তে করে মুনীরার পাশে গিয়ে বসলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে ডাকলেন , মনি, মনিরে!

সে ডাকে মুনীরার ঘুম ভাঙ্গল না৷ মুজাফফর এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকালেন৷

সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে আসমা বেগম বললেন, ফজরের নামাযের পরও কোআন শরীফ নিয়ে পড়তে বসে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ রকম করে ঘুমিয়ে পড়ে ৷ ওর শরীরটা বোধহয় ভাল যাচ্ছে না৷ আমিও সেই জন্যে ডাকাডকি করিনি৷ ওর যখন ভাল লাগে ওঠে৷

মুজাফফরের চেহারা খানি মলিন হয়ে উঠল৷ মুনীরার শারীরিক অবস্থাটা জানতে না পারলে তার মনে স্বস্তি আসছে না৷ ওর মাথায় আস্তে করে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে আবার তিনি ডাকলেন, মনি রে৷

মুজাফফরের কথা কানে যেতেই মুনীরা প্রথমে চোখ মেলে তাকাল৷ তারপর ভাইকে দেখেই বিস্মিত হয়ে বলল, ভাইজান! বলেই সে ধড়মড়িয়ে উঠতে গেল৷

মুজাফফর বাধা দিয়ে বললেন, উঠতে হবে না, শুয়ে থাক ৷ শুয়ে শুয়ে আমার সাথে কথা বল ৷ বলে ধীরে ধীরে বোনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন ৷

ভাই এর স্নেহ স্পর্শে মুনীরা চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল ৷ মনটি তার ভীষণ ভাবে শংকিত হয়ে উঠেছে ৷ ভয়ে সে এতটুকু হয়ে গেছে ৷

আসমা বেগম বললেন , মনি শুয়ে আছে, শুয়ে থাক৷ তুমি হাত মুখ ধয়ে নাও ৷ আমি চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়েছি৷ নাশতা তৈরী আছে ৷ সব কিছু এক্ষুণি রেডি হয়ে যাবে ৷

মুজাফফর সে কথায় খেয়াল না দিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকলেন ৷ বাথরুমের দরজা বন্ধ করতেই তার বুকের ভেতর তোলপাড় করে উঠল৷ এতক্ষণ উম্মূক্ত জায়গাতেই তার দম আটকে আসছিল, অথচ এই রুদ্ব দ্বার কক্ষটির ভেতরে ঢুকে তিনি স্বস্তি লাভ করলেন৷ কলের পানির সাথে আপন চোখের পানি মিশিয়ে দিয়ে বুকখানি তিনি হালকা করে নিলেন ৷




খেতে বসে মুজাফফর কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়েছিলেন৷ আসমা বেগম সামনেই বসে আছেন৷ স্বামীর পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, মাহতাব ওর সাথে এলো না৷ ব্যাপারটা আমার যেন কেমন কেমন মনে হচ্ছে৷ ওর কি কাজের এতই চাপ ? আর কাজ যতই থাকুক, মনিকে রেখে যাওয়াটা কি একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল নাকি?


মুজাফফর হোসাইন ভালো মন্দ কোন কথা না বলে, যেন শুনতেই পান নি তেমনি ভাব দিখিয়ে খেতে লাগলেন ৷


আসমা বেগম বললেন, আর বুজবই বা কী? মাহতাবের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই মনি তো ওর খুবই তারিফ করল ৷ মনে হয় মাহতাব আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে ৷ মনিকে আদর যত্নও করে৷ ওর কথাও শোনে৷ শুনবে না? আমি তোমাকে বলি নি?


মুজাফফর শুধু একবার মুখ তুলে ষ্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন৷ তারপর দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন৷ আসমা বেগমের কথার কোনই উত্তর দিলেন না৷ আসমা বেগম বললেন, ঢাকা হয়ে এলেই পারতে?

- তাতে কী লাভ হত? এতক্ষণে মুজাফফর ষ্ত্রীর কথার জবাব দিলেন৷

- ওমা, সে কি কথা গো? লাভ লোকসানের কথা বলছ কেন? সে হচ্ছে তোমার ভগ্নিপতি ৷ তাকে দেখে আসবে , তার জন্যে লাভ লোকসানের হিসেব করতে হবে নাকি?

- মুজাফফর আসমার কথায় ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন৷ কিন্তু মনের উষ্মা তিনি মনের মধ্যেই চেপে রাখলেন৷

-

মাহতাবের প্রতি আগের থেকেই মুজাফফর কিছুটা অপ্রসন্ন, সেটা আসমা বেগমের জানা ছিল৷ বিশেষ করে মাহতাব ঠিকমত নামায পড়ে না৷ চাকুরীতেও খুব তাকে পরিচ্ছ্নি থাকতে দেখা যায় নি । ঘুষ খাওয়ার দিকে তার লোভ আছে ৷ মনিকে সেটা সে খোলাখুলি ভাবেই বলেছে ৷ মুজাফফর ধরেই নিয়েছেন, যে লোক আল্লাকে ফাঁকি দিতে ভয় করে না, সে লোক মানুষের সাথে প্রতারণা করবে তাতে আর আশ্চ্যর্যের কি? জানতে পেরেই তিনে অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিলেন ৷ সে সময় আসমা তাকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, মাহতাবের রোগটি সাময়িক৷ সময় এলেই সেরে যাবে৷ সেই আশ্বাসে স্বামীকে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেননি, সেটাও তাঁর জানা ছিল৷ আসমা বেগম সেই কথাটিরই প্রতিধ্বনি করে বললেন, মনির কাছে মাহতাবের কথা শুনে আমার তো ভালই লাগল৷ যেটুকু দুর্বলতা আছে, সেটুকুও সেরে যাবে তুমি দেখে নিও৷ সব মানুষই তো আর এক রকম হয় না৷ কেউ তাড়াতাড়ি সারে, কারুর বা একটু দেরি লাগে৷


মুজাফফরের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এসে বেতের চোয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন৷ আসমা বেগম চীনে মাটির দুগ্ধ ধবল টী পট থেকে পেট মোটা একটা কাপে এক কাপ হালকা খয়েরী রঙের চা ঢেলে দিলেন৷ চায়ের গন্ধে ঘরটি সুরভিত হয়ে উঠল৷ মুজাফফর কাপের হাতলে আঙ্গুল ঢুকাতে গিয়ে বললেন, মনি মাহতাবের প্রশংসা করেছে না কী যেন বললে?


আসমা বেগম উত্ফুল্ল হয়ে উঠলেন৷ বললেন, তোমার বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না ৷

মুজাফফর হোসাইনের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল বললেন, বিশ্বাস আবার হবে না কেন? খুব হচ্ছে ৷

- তবে?

মাজাফফর চায়ের কাপটা পিরিচের উপর নামিয়ে রেখ আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকালেন৷ তারপর এক মুহুর্ত বিলম্ব করে বললেন, তবেটা মনির কাছেই শুনো ৷ সেই তোমাকে সব কিছু ভাল ভাবে বলতে পারবে৷

আসমা বেগম চাঞ্চল হয়ে উঠলেন ৷ প্রশ্ন করলেন, সত্যি সত্যি কী হয়েছে গো? মনি কি কিছু দোষ ঘাট করে চলে এসেছে নাকি?
মুজাফফর বললেন, সেটাও জানতে হবে ৷ তবে বুঝে শুনে ইচেছ করে সে তা করবে বলে মনে হয় না৷

- তাহলে? আসমা বেগম বিহবল দৃষ্টি মেলে স্বামীর দিকে তাকালেন৷

মুজাফফর হোসাইন চেয়ারে পিঠটা এলিয়ে দিয়ে বললেন, মনি কি উঠেছে?

- হ্যাঁ, ওকে হাত-মুখ ধুয়ে নাশাতা করতে বলে এসেছি৷

- নাশতা সেরে আসাক, প্রথমে তার কাছেই শোনো, আমি যা জানি তাও তোমাকে বলব৷

আসমা বেগমের মনে দুশ্চিন্তার ঝড় উঠে গেল৷ কিন্তু তবু জিদ করে তিনি আর কিছু জানতে চাইলেন না অন্তরে প্রবল অস্থিরতা নিয়ে চুপ করে গেলেন।

মুনীরার নাশতা সারা হলে আসমা বেগম তার কছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মনি, মাহতাবের সাথে তোর সত্যি সত্যি কোন কিছু নিয়ে মন কষাকষি হয় নি তো?

ভাবীর মুখের প্রশ্নটি শুনে মুনীরা চমকে উঠল ৷ কিন্তু মুহুর্তেই সে হতচকিত ভাবটি সামলে নিয়ে বলল, হঠাৎ করে এ প্রশ্ন কেন, ভাবী?

- আমাকে তুই ঠিক ঠাক বল না রে! কী জানি, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোদের মধ্যি মনোমালিন্য ঘটেছে৷

মুনীরা বলল, সন্দেহের কারণটা কী?

আসমা বেগম এই প্রশ্নের কী জবাব দিবেন, মুহুর্তকাল তা চিন্তা করে দেখলেন৷ তারপর বললেন, তুই যখন হাসির সাথে এলি, তখনই মনে খটকা লেগেছিল মনি এলো, মাহতাব এলা না৷ এমনটি হওয়ার কথা নয়৷ শেষমেশ হাসির কথা শুনে বিশ্বাসও হল, হতেও পারে৷ কাজের ঝামেলায় হয়ত মাহাতব আসতে পারেনি৷ এ দিকে তোর যাওয়াও তো ঢের দিন হল৷ খসরুর আব্বা যাব যাব করে আর যেতে পারে নি৷ মনটা খারাপ করেছে ভেবে মাহতাব হয়ত হাসিকে পেয়ে তার সাথেই পাঠিয়ে দিয়েছে৷ এখন তোর ভাই এর কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে, কী যেন একটা ঘটেছে৷ কিন্তু সেও দেখছি স্পষ্ট করে কিছু বলছে না৷


মুনীরা বিহবল কন্ঠে প্রশ্ন করল, ভাইজান কি কিছু বলেছেন?

- না, বলছে না কিছুই৷ আর সেটাই তো হয়েছে সমস্যা ৷ সেও বলছে তোকে শুধোতে ৷ আমি খুব জিদ করি নি ৷ ভাবলাম তোকেই শুধাই ৷ মুনীরা ভাবীর কথা শুনে চুপ করে রইল! তারপর মুহুর্ত কাল তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান তোমাকে কী বলেছে, আগে তাই বল৷

- উঁহু, কিছুই বলে নি৷

- তাহলে যে আমাকে এসব তুমি শুধাচ্ছ?

- কী জানি রে, তোর ভাইকে দেখলাম , মাহতাবের ওপর কেমন যেন চটা চটা ভাব, মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না৷ মনের মধ্যে নিয়েই ছটফট করছে ৷ মাহতাব আবার কোন খারাপ কথা- টথা বলে চিঠি-ফিটি দিয়েছে নাকি কে জানে৷
আসমা বেগম ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, আমি ওর কাছে জানতে চাইলে, ও আবার তোর কাছেই শুনতে বলল্ আমার হয়েছে ল্যাঠা৷ বল তো এখন কী করি?

মুনীরা কোন কিছু জাবাব দিতে না পেরে চুপ করে রইল৷

মুনীরার ভয় ও আশংকা দুইই ছিল৷ মুজাফফর তার এই ভাবে চলে আসার ব্যাপারটা জানতে পারলে কী মনে করবেন, সেটা অনুমান করাও তার সাধ্যের অতীত ৷ ভয়ে মুনীরা একেবারে সংকুচিত হয়ে পড়েছিল৷ কিন্তু ভাইজানের একটি ব্যবহারে মুনীরার দুশ্চিন্তার কালো মেঘটা বেশ খানিক অপসারিত হয়ে গিয়েছিল৷ ভাইজান এসেই প্রথমে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন ৷ ঘটনাটি হয়ত তাঁর জানা নেই৷ জানলে তিনি সেটাকে কী ভাবে গ্রহন করবেন, মুনীরা তার কিছুই অনুমান করতে পারছে না৷ আর মাহতাব যদি তাকে চিঠি দিয়ে কোন কিছু জানিয়েই থাকে, তাহলে ঘরে ঢুকে মুনীরাকে দেখেই ভাইজানের ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা৷ তিনি তাও হন নি৷ সম্পূর্ণ ব্যাপারটি মুনীরার কাছেও একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে৷


মুনীরাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসমা বেগম বললেন, কী হয়েছে সত্যি সত্যি বল না, ভাই!

মুনীরা তেমনি বোবা দৃষ্টি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে ভাবীর দিকে তাকাতে লাগল৷ তার মুখে একটিও কথা ফুটল না৷ চোখ দুটি শুধু টলটলে হয়ে উঠল৷

আসমা বেগম ওর চোখ দেখেই আঁচ করে ফেললেন৷ বললেন, মাহতাব কি তোকে মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে?
মুনীরা ধরা গলায় বলল, না৷

- তাহলে? আসমা বেগমের কন্ঠটি উদ্বেগে কেঁপে গেল৷

মুনীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি নিজেই চলে এসেছি৷

- তুই নিজেই চলে এসেছিস! বলিস কী? আসমা বেগম অবাক হয়ে গেলেন৷ এবার তার কন্ঠে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল৷
বললেন, তুই এই ভাবে তোর ভাই এর উঁচু মাথা মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছিস? এরই জন্যে কি তোকে আমরা বুকের মধ্যে করে মানুষ করেছিলাম? আসমা বেগম রাগে দুখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন৷

মুনীরা ভয়ে বিবর্ণ মুখে নীরব হয়ে রইল৷

আসমা বেগম ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভীষন চিত্কার করতে লাগলেন৷

মুহুর্তে তার ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে গেছে৷ তিনি চিত্কার করে বলতে লাগলেন, একটি সম্ভ্রান্তঘরের মেয়ে তুই৷ কত আদর--যত্নে--সুশিক্ষায় তোকে আমরা বুকে করে মানুষ করে তুলেছিলাম৷ লোকের কাছে মুখ হাসানোর জন্যই এসব করেছিলাম বলে তুই মনে করেছিস, তাই না?

কাল নাগিনী! তোর মতন মানুষ কে আমি দুধ কলা খাইয়ে মানুষ করেছিলাম কি এই ছোবল দেবার জন্যে? ঐ মুখ নিয়ে তুই কেন এখানে এসেছিস ? কেন? মরতে পারিস নি? হতভাগিনী, জবাব দিচ্ছিস নি ক্যান?

আসমা বেগমের মুখে এই ধরনের রূঢ় কথা মুনীরা জীবনেও কোনদিন শোনে নি৷ মায়ের কথা তার মনে পড়ে না৷ জন্মের পর ভাবীর কোলে বুকেই সে মানুষ হয়েছে ৷ মাতৃ স্নেহের অনাবিল ধারায় আসমা বেগম চিরদিনই মুনীরাকে আপ্লুত করে রেখেছিলেন৷ একটি দিনের তরেও তিনি মুনীরাকে রাগ করে কোন মন্দ কথা বলেন নি৷ আজ তার মুখের এই গালি শুনে মুনীরা স্তম্বিত ও কিংর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ল৷


আসমা বেগম মুনীরাকে নিরুত্তর দেখে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন৷ বলতে লাগলেন, স্বামীকে যদি পছন্দ না হয়ে থাকে, তাহলে আরো পথ খোলা ছিল, সেই পথ খুজে নিলেই পারতিস? তুই এই লোকটার উচু মাথা নিচু করবার জন্যে কেন, এখানে উঠে এসেছিস? কেন, কেন? আসমা বেগম উন্মাদিনীর মতন চিত্কার করতে লাগলেন৷


মুজাফফর আসমা বেগম কে বললেন , ওকে অমন করে বোক না বেগম৷ আসমা বেগম হাউ মাউ করে ডুকরে উঠে বললেন, বকবনা? ওর মুখেই শোনো ৷ ওই শয়তান টা নাকি নিজেই স্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে৷ শোনো, আমার যে মাথা খুড়তে ইচ্ছে করছে গো৷

মুজাফফর গম্ভীর গলায় বললেন, ওকে গাল-মন্দ করো না৷ ও ঠিকই করেছে ৷

আসমা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ঠিক করেছে? বল কী তুমি ? ঠিক করেছে?

- হ্যাঁ, ঠিক করেছে ৷ আমার বোন যে ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না, সে বিশ্বাস আমার আছে ৷ তুমি ওকে আর বকা বকি করো না৷

ভাই-এর মুখের শেষ কথাটি উচ্চারিত হতে না হতেই সাহসা মুনীরার মুর্ছিত হয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল৷ আসমা বেগম তাড়াতাড়ি ওর মাথাটি বুকের কাছে তুলে ধরে চিত্কার করে কেঁদে উঠলেন, ওগো, ফিট লেগে গেছে গো৷

মুজাফফর হোসাইন তাড়াতাড়ি বালতি করে পানি এনে মাথায় ধারা দিতে লাগলেন৷ আসমা বেগমের চোখ থেকে অনবরত অশ্রু-ধারা গড়িয়ে পড়ে মুনীরার মুখ বুক ভিজে যেতে লাগল! তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন মুখখানা যে সাদা হয়ে গেছে, আমার কী হবে গো?

মুজাফফর দৃঢ় কন্ঠে বললেন, অস্থি হয়ো না, মুর্ছা গেছে ৷ এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে৷

=================================================


মুনীরা একটু সুস্থ হয়ে উঠলে, দুপুরের দিকে মুজাফফর হোসাইন ও আসমা বেগম তার কাছ থেকে ঘটনাটি জানবার জন্যে আলাপ শুরু করলেন ৷

আসমা বেগম ও মুনীরা খাটের ওপর বসে৷ মুজাফফর একটি বেতের চেয়ার নিয়ে ওদের সম্মুখে বসে জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?

মুনীরা থেমে থেমে ক্লান্ত কন্ঠে বলতে লাগল, আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি যে, আমাকে সে হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে ৷ কোন আশ্চর্য জিনিস দেখানোর নাম করে মাঝে- মধ্যে ও আমাকে সিনেমায় থিয়েটারে নিয়ে যেত৷ ভয়ে আমি আপত্তি করতাম না৷ মাঝে মাঝে ভাবতাম, ভাইজানকে চিঠি দিয়ে জানাব৷ পরক্ষণে মনে হত, ভাইজান হয়ত ওর ওপর ভয়ানক অসন্তুষ্ট হবেন৷ তার ফলে ও হয়ত আরো বিগঢ়েই যাবে৷ তাই ভেবে আমি আপনাদের জানাই নি৷ বলেই মুনীরা একটু থামল৷


আসমা বেগম শুকনো মুখে জিজ্ঞেস করলেন, হোটেলে কেন নিয়ে যাবে?

মুজাফফর তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন, আগে ঘটনাটি শুনে নাও, তারপর কেন নিয়ে যাবে, শুনতে চেয়ো৷ বলেই মুনীরার মুখের দিকে তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন৷

মুনীরা বলতে লাগল, শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই হোটেলে নিয়ে সে হাজির করল৷ গিয়ে দেখি, অদ্ভুত সব পোষাক আশাক পরা উচ্ছৃঙ্খল নারী পুরুষের ভীড় জমেছে৷ আমি দেখেই বললাম, এখানে আর এক মুহুর্ত আমি থাকব না ৷ ও জিদ করে বসল৷ বলল, থাকতেই হবে৷

আমি বললাম, আমাকে তুমি মেরে ফেল, তাতেও আমি রাজী, কিন্তু এই সব মাতাল পুরুষদের মধ্যে আমি কিছুতেই যাবোনা ৷ ও বলল, তাহা যদি না যাও, তাহলে তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও ৷ আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারব না আমার তখন আর মাথার ঠিক নেই৷ আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছি! তুমি ওদের সাথে মাতলামী করতে চাইলে , যাও৷ সে রাগে আমার গালে, ঠাস করে একটা চড় কষে দিয়ে বলল, এতই যখন সতীপনা, তখন বিয়ে করতে সাধ জেগেছিল কেন?

আমি ওর কথার কোন জবাব দিই নি৷ একজন আধ বয়েসী লোক আমাকে মারতে দেখে বলল, অ নো নো, ডোন্ট স্ন্যাপ অন হার ফেস ৷ বলেই মাতাল লোকটি কী সব বলতে বলতে আমার দিকে হাত বাড়াল ৷ আমি ভয়ে চিত্কার করে উঠলাম৷ এই ব্যাপারটা দেখে ওর বোধহয় চৈতন্যোদয় হল! তারপর আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো৷

মুজাফফর ও আসমা মুনীরার কথা শুনতে গিয়ে কেমন যেন অবশ হয়ে পড়েছিল৷ দুজনই বিষ্ময়-বিমূঢ় হয়ে বসে রইলেন৷
মুনীরা চাবুকের ঘা দেওয়ার মতন বলে উঠল, এই জন্যে তুমি আমাকে বুকে করে মানুষ করেছিলে, ভাবী? একজন বেশ্যা বানানোর জন্যেই ... হু হু করে সে ডুকরে উঠল৷

আসমা বেগম মুনীরার কান্নার সাথে যোগ দিয়ে নিজেও কেঁদে উঠলেন৷

মুজাফফর একেবার পাথর হয়ে গেছেন৷ তাঁর চোখের পলকও আর পড়ছে না৷

বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে গেল

মুজাফফর প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠলে একসময় জিজ্ঞেস করলেন, তোকে আমি দুখানা চিঠি দিয়েছিলাম ৷ কিন্তু তুই কোন উত্তর দিসনি কেন?

মুনীরা চোখ মুছে বলল, আমি আপনার একটা চিঠিও পাই নি৷

- ও, তাহলে ঐ রাস্কেলটাই মেরে দিয়েছে৷ মুজাফফর ক্ষুব্দ কন্ঠে বলে উঠলেন, মানুষরূপী একটা পশু ৷ পশুরও অধম ৷ তারপর বলতে লাগলেন, তোর কাছ থেকে যখন কোনই জবাব পেলাম না, তখন মনটা খারাপ হতে লাগল ৷ ভাবলাম, আমার এখানকার কাজ তো শেষ হয়ে গেল, আমি নিজেই ঢাকা গিয়ে তোকে নিয়ে আসব ৷ সেই মোতাবেক কাল দুপুরের গাড়িতেই ঢাকা চলে গেলাম৷ গিয়ে যা কিছু দেখলাম, তা যদি আমি স্বচক্ষে না দেখতাম, তাহলে হয়ত ভুল করে তোর ভাবীর কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে আমিও তোকে বকাঝকাই করতাম ৷ আল্লার শোকর , তিনি আগেই আমার দৃষ্টিটা খুলে দিয়েছিলেন ৷

আসমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সেখানে কী দেখলে?

মুজাফফর বলতে লাগলেন, দেখলাম, তার ঘরের মেঝের ওপর ডুগি তবলা হারমোনিয়াম সাজানো ৷ সংগীতের আসর খুলেছে ৷ মুসলমানের ছেলে, রাধা কৃষ্ণের ন্যাংটা মূর্তি দিয়ে শোকেস সাজিয়েছে ৷ এটা যে মনিদের বাসা প্রথম প্রথম আমার বিশ্বাসই হয়নি! মনে মনে ভাবলাম, হায় আল্লাহ, এ আমি কোথায় এলাম? পরে জোর ডাকাডাকির পর সেই পশুটা বেরিয়ে এসে কী বলল জানো?


আসমা বেগম উত্সুক মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল,

- আমাকে যেন সে চেনেই না, তেমনি ভঙ্গীতে বলল, কী চান? এই হচ্ছে আমার সেই গুণধর ভগ্নিপতির প্রথম কথা ৷ মনে হল পায়ের জুতো খুলে ওর মুখের দাঁতগুলো খসিয়ে দিই৷ দিই নি সেটা ওর বাপের ভাগ্যি বলতে হবে৷ বলেই মুজাফফর হাপাতে লাগলেন৷

আসমা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর? তারপর মুনীর কথা জিজ্ঞাস করলাম৷ শয়তানটা কোন জবাব দিতে পারল না৷ জবাব দিল একটি মেয়ে ৷ দেখলাম ঐ মেয়েটিও ওর বাসাতেই আছে৷ এবার মুনীরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে রে ঐ মেয়েটি? মনি, চিনিস নাকি?

- সে কী করে সেখানে?

- সেখানে তো থাকে না, মহিলা কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করছে৷

- সেই-ই বলল, মুনীরা ভাবী চলে গেছে৷

আসমা বেগম মাঝাখানে প্রশ্ন করলেন, ও, যে মেয়েটি আমাদের এখনে এসেছিল?

মুনীরা বলল, হ্যাঁ সেই ৷

আসমা বেগম আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর তুমি কী করলে?

মুজাফফর বললেন, তখন আমার আর মাথার ঠিক নেই ৷ আমি যেন উম্মাদ হয়ে গেছি৷ চিত্কার করে ওকে গালাগালি করলাম, আমার বোনের খোঁজ যদি না পাই, তবে তোর বত্রিশ নাড়ী আমি টান মেরে বার করব ৷ বলে চলে এলাম ৷ মনিকে যদি আমি না পেতাম, ওর ভাগ্যে ভালই ছিল৷ কিন্তু যাক, মনি যখন চলে এসেছে, তখন ঐ খবিসের সাথে বোঝা পড়ার দরকারও আমার শেষ হয়েছে ৷ আমার বোনকে আমি ফেরৎ পেয়েছি, তার জন্যি আমি আল্লার হাজার হাজার শোকর গুজারী করছি৷ ঐ নর পশুর ঘরে আর আমি ওকে যেতে দেব না৷


আসমা বেগম স্তদ্ব হয়ে কিছুক্ষণ অধোমুখে বসে রইলেন ৷ নীরবতার মাঝ দিয়েই বেশ কয়েকটি মুহুর্ত কেটে গেল ৷ এক সময় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ও যে এত বড় শয়তান হবে, কশ্মিনকালেও আমি তা ভাবতে পারি নি ৷ বলেই আবার চুপ করে রইলেন৷ খানিকটা পর স্বগতোক্তির মতন বলে উঠলেন, এখন যে জটিল সমস্যা দেখা দিল ৷


মাজাফফর ঝাঝিয়ে উঠে বললেন, কিসের সমস্যা? আমি থোড়াই পরোয়া করি৷ আমার বোন আর কখনো ওর ঘরে যাবে না ও যদি জীবনে কখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারে, সেটা হবে আলাদা কথা ৷ কিন্তু ঐ রকম একটা নর পশুর কাছে আমি মনিকে কিছুতেই আর ফিরিয়ে দিতে পারি না ইমপসিবল৷


আসমা বেগম কী যেন বলত গিয়েই থেমে গেলেন৷ তারপর মুনীরাকে লক্ষ্য করে বললেন, তুই ও ঘরে যা মুনি ৷

মুনীরা অন্য ঘরে চলে গেলে আসমা বেগম স্বামীকে বললেন সমস্যা মানে-ভীষন জটিল সমস্যা ৷

মুজাফফর উত্সুক মুখে তাকিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল, কী সেটা?

আসমা বেগম চাপা গলায় বললেন, সব কিছু তো তুমি জানো না৷ আর জানো না বলেই তুমি এমন করে বলতে পারছ ৷ মনি তো মা হতে যাচ্ছে ৷

আসমা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে মুজাফফর লা জবাব হয়ে গেলেন ৷

মুখখানি তার সহসা পাংশু বিবর্ণ হয়ে উঠল ৷


অফিসে ঢুকেই নন্দিতার সাথে মাহতাবের দেখা হয়ে গেল ৷ প্রাত্যহিক নিয়মে আজো সে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ৷ ওকে এই ভাবে সম্ভাষন জানাতে দেখলে মাহতাবের খুব আনন্দ লাগে ৷ যতই দিন যাচ্ছে, নন্দিতাও ততই যেন মাহতাবের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে ৷ ওর আগের আচরণ আর এখনকার আচরণের মধ্যে মনে হয় আকাশ পাতাল ব্যবধান৷


আগে মাহতাবকে দেখে মেয়েটি কেমন গম্ভীর মুখ করে হেটে চলে যেত৷
কিন্তু বস্ হওয়ার সাথে সাথে তার সেই গাম্ভীর্য কোথায় যেন অন্তর্হিত হয়ে গেছে ৷ তার বদলে এখন তার মুখে সর্বদা পুষ্পের হাসি ঝলমল করে! এতদিন সেই হাসি ঐ ব্যাটা গজনফর আলী চাপা দিয়ে রেখেছিল৷


গজনফর আলী ঝানু মানুষ ৷ ধড়িবাজিতে তার জুড়ি নেই বলে অফিসের সবারই জানা৷ একবার সে ফরিদকে দিয়ে ডাইরেক্টর সাহেবকে দারুণ একটা ঘোল খাইয়েছিল ৷ সেকথা পাকিস্তান আমলের সব সাহেব- সুবোই ভাল করে জানে৷


ফরিদ বড় সাহেবের কাছে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট পেশ করল, বড় সাহেব তাকে অবিশ্বাস করে বলেছিলেন, এসব বিলকুল মিথ্যা ৷


আর যায় কোথায়! ফরিদ মুখের ওপর চট করে জবাব দিয়েছিল, আমি না হয় মিথ্যা বলতে পারি, স্যার! কিন্তু মেডিকেল সার্টিফিকেট কি আর মিথ্যা বলতে পারে? সার্টিফিকেটই তো বলছে আমি অসুস্থ ছিলাম ৷


ডাইরেক্টর সাহেব আর কী করবেন? ডাক্তারের সার্টিফিকেট প্রায় মিথ্যেই হয় এবং সেটা মিথ্যা বলার ক্ষমতা ও কারুর থাকেনা, সেও তো জানা কথা ৷ বাধ্য হয়েই সাহেব সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন ৷ চুপ করে গেলে হবে কী? দুদিন বাদেই খবর পাওয়া গেল ফরিদ বদলী হয়ে গেছে ৷ একেবারে সেই মর্দানে-পিউনিটিভ ট্যান্সফারে৷


খবর শুনে ফরিদ দৌড়ে গেল গজনফর আলীর কাছে ৷ গজনফর দুমুহুর্ত চিন্তা-ভাবনা করে, খুশীর চোটে ইউরেকা বলে লাফিয়ে উঠে বলল, কিল্লা ফতেহ হো গিয়া ৷


তারপর গজনফরের পরামর্শ মত ফরিদ বোচকা-বুচকি নিয়ে ঠিকই মর্দান যাত্রা করল ৷ এবং প্রথমেই গিয়ে উঠল সে অর্থমন্ত্রী শোয়েবের বাসায় ৷ ফরিদকে দেখে মন্ত্রী সাহেব খুবই আনন্দিত হলেন ৷ তার কারন এক সময় এই ফরিদই ছিল তার অত্যন্ত নিষ্ঠাভাজন পিওন ৷


মন্ত্রী সাহেব ফরিদকে কুশল জিজ্ঞেস করলেন, এবং কী ব্যাপারে সে গিয়েছে সেখানে তাও জানতে চাইলেন৷ ফরিদ বলল, মর্দানে যাচ্ছি, স্যার ৷ ট্রান্সফার হয়ে গেছে৷


- বেশ তো ভাল কথা, যাওয়ার আগে আমাদের এখানে দুদিন বেড়িয়ে যাও তাহলে ৷

- আগামী কালকের মধ্যেই সেখানে জয়েন করতে হবে, স্যার৷ পিউনিটিভ ট্রান্সফার কিনা৷

- ক্যায়া বাত? কী বললে ? কী জন্যে তোমাকে বদলী করল? গর্জে উঠলেন অর্থমন্ত্রী ৷

ফরিদ সুযোগ বুঝে এবার সব কথা আদ্য-পান্ত সুন্দর ভাবে, যেমন করে গজনফর আলি তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, অর্থমন্ত্রীর কাছে সবিস্তারে বর্ননা করল ৷ তারপর বলল, ঘরে থেকেই অসুস্থ ছেলে-মেয়েদের সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করতে পারি নি স্যার ৷ এখন তো তাদের মরা ছাড়া আর উপায় থাকল না৷


টলটলে চোখে অর্থমন্ত্রী শোয়েব উঠে দাড়ালেন, তুম ঠায়রো ফরিদ ৷ ম্যায় আবি আয়া হুঁ ৷ তারপর ঘরের ভেতর গিয়ে অল্পক্ষনের মধ্যে ফিরে এসে বললেন, তুমি এখনে থাকবে নাকি করাচি যাবে?


ফরিদের চোখ দুটো আনন্দে ঝিলিক মেরে উঠল৷ এখানে থাকলে বড় সাহেব কে যে টিট করা হল তার তো যথারীতি প্রর্দশন হচ্ছে না ৷ কথাটি চিন্তা করেই ফরিদ মাথা চুলকিয়ে বলল, বাল-বাচ্চার অসুক-বিসুখ, করাচি যেতে পারলে তাদের সেবা-শুশ্রষা করতে পারব ৷ সেখানে যেতে পারলেই ভাল হয় স্যার৷


- ঠিক আছে৷ তোমার বদলী কেনসেল হয়ে গেছে৷ তুমি যেখানে চাও, সেখানে গিয়ে জয়েন করতে পারো৷

ফরিদের মনে আছে বড় সাহেবের মুখ খানি হাড়ির তলার মতন কালো হয়ে গিয়োছিল ৷ সেও তো ঐ গজফর আলির মহিমাতেই ৷ পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত গজনফর কি রকম রূই-কাতলাকে এই রকম নাকানি-চুবানি খাইয়েছে?


এমনিতেই সে পাকা বুদ্ধির মানুষ৷ তার ওপর আরো একটা বাড়তি সুবিধা হয়েছে আজকাল৷ সে একজন পীর সাহেবের মুরীদী কবুল করেছে ৷ ফলে তার গুনপনা এখন বেড়ে গেছে চতুরগুণ৷ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ৷ তাই মাহতাবের বারোটা বাজানো এখন তার কছে মাত্র সময়ের ব্যাপার ৷ কি কি বিষয়ে এই তরুন অফিসারের আসক্তি, তার তত্বতালাশে মাস কয়েক যেতেই, অর্থ ও নারী বিষয়ে যে মাহতাবের ষোল আনা আসক্তি, সেটা বুঝতে গজনফরের আর বাকি নেই৷


সর্বদা মাহতাবের পেছনে লেগে থাকার বড় একটা মওকাও হচ্ছে এদিকে অফিসে ও গজনফরকে সাপোর্টার বাড়াতে হচ্ছে ৷ সাপোর্টার যত বাড়বে, বলও তার ততই বাড়বে ৷ কাদির মিয়া হাঁপানীর রোগী ৷ বছর দশেক ধরে ডাক্তার কবিরাজ আর ঝাড়ফুঁক, তাবিজ তুমার কিছুই সে বাদ রাখে নি ৷ কোন ফলোদয় হয় নি ৷ গজনফর তাকে বুঝিয়েছে, জেন্দা বাবার উরূসে গেলেই হাঁপানী বাপ বাপ করে পালবে৷ ব্যস, শুনেই আর দেরি করে নি কাদির৷ তড়িঘড়ি গিয়ে বাবার পাগড়ী ধরে মুরীদ হয়ে এসেছে ৷ তারপর থেকে এই বছর দুই ধরে হাপিত্যেসে রোগ মুক্তির জন্যে সে প্রতীক্ষা করছে ৷ ইউসুফ মিয়া কোন একটা কলেজে ডেপুটিশনে ছিল৷ অধ্যক্ষ সাহেবের পি, এ, থাকাকালে সেবার দেড় লক্ষ টাকার একটা দাঁও মেরেছিল৷ একটি বিদেশী সরকার মসজিদ নির্মাণের জন্যে চৌদ্দ লক্ষ টাকা মঞ্জুরী ঘোষনা দিলে, ইউসুফ মিয়া মসজিদের কর্মকর্তার সাথে রফা করতে সক্ষম হয় যে, বরাদ্দকৃত অর্থের প্রাথমিক কোটাগুলি থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা অধ্যক্ষ সাহেবকে দিয়ে দিতে হবে ৷ প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের পথে যে ঝুকি আছে, তার কথা ভেবে, মসজিদ কমিটি তাত্ক্ষণিক ভাবে রাজী হতে পারে নি ৷ কিন্তু এই মহৎ কাজের জন্যে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ঘুষ না দেওয়া অর্বাচীনতা ভেবে, ইউসুফ মিয়াকে সাড়ে তিন লক্ষ দিয়েই শেষমেশ বাকী টাকায় মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন ৷ ইউসুফ তার থেকে দুই লক্ষ টাকা অধ্যক্ষ সাহেবকে দিয়ে, বাকী দেড় লক্ষ টাকায় একটা রিকণ্ডিশণ্ড কোস্টার কিনে ছেড়ে দিয়েছে ঢাকা কাপাশিয়া রুটে ৷ এখন টাকা পয়সা আসছে দেদার ৷ কিন্তু তাহলে কি হবে বুকের মধ্যে সন্দেহের ধুকপুকানিটা কিছুতেই যেন দূর হচ্ছিল না ৷ সেখানেও গজনফর ছিল মুশকিল আসানের মতন ৷ বলে দিয়েছেও তাই৷ গত উরুস মুবারকে বারো হাজার টাকা দিয়ে এক পেল্লায় ষাঁড় নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে জেন্দা বাবার দরগায় ৷ তারপর বাবার পায়ের ধুলো মাথায় দিতেই বুকের ধুকপুকানিটা উঠে গেছে ৷


এমনি করে গজনফরের তদ্বিরে সারা অফিসে পীরে কামেল জেন্দা বাবার ভক্ত অনুচরদের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে দিন দিন ৷ ছেলে মেয়ে হয় নি? যাও বাবার কাছে৷ ঘুষ খেতে গিয়ে চাকুরী নিয়ে টানা হেচাড়ায় পড়েছ? যাও বাবার কাছে ৷ কারুর মাথায় লাঠি মেরে খুন করে ফাসির আসামী হয়েছ? যাও বাবার কাছে ৷ বাবা সর্বজ্বরহর বটি ৷ তোমাকে বেহেশতেও নিয়ে যাবে, আবার ফাসির দড়িও গলা থেকে খুলিয়ে দেবে৷ সব কাজেই বাবা তোমার মুশকিল আসান ৷ সেই বাবাই যখন গজনফরের হাতে, তখন আর তাকে পায় কে? গজনফরের রাগটা আজকের নয় ৷ সেই সেবার কাকদিয়া হাই ষ্কুলের ডেভেলপমেন্ট ষ্কীমের টাকার বখ্রা নিয়েই হয়েছিল গোলমালের সুত্রপাত৷ মাহতাব পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে অফিসের কাউকে একটা লাল পাইও দেয় নি ৷ সেই রাগে মাহতাবকে এক হাত দেখানোর জন্যে অনেক আঁতিপাঁতি করে খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল নন্দিতাকে ৷ নন্দিতা গজনফরের অনুগত ৷ নন্দিতার চাকুরীর ব্যাপারে গজফরের অবদান ছিল একক ৷ তাই নন্দিতাও তার প্রতি কৃতজ্ঞ ৷ এই সুন্দরীকে দিয়েই গজনফর মাহতাবকে সোজা ছুড়ে ফেলবে রসাতলে ৷


সেই নন্দিতার মুখের হাসি এখন ছুরির ফলার মতন মাহতাবের বুকের মধ্যে গেথে যাচ্ছে ৷ মাহতাবের মুখে হাসি ফুটে উঠল, কেমন আছেন মিস নন্দিতা ?

- ভালো আছি, স্যার ৷ আপনি ভাল তো ? নন্দিতার রক্তলাল ওষ্ঠাধরে খুশীর ঝিলিক বয়ে গেল৷

মাহতাব বলল, আমাদের আর ভাল থাকা?

- কেন স্যার? নন্দিতা উদ্রিব কন্ঠে জিজ্ঞেস করল ৷ প্রসাধন চর্চিতা লাবণ্যময়ী নন্দিতার কানের ঝুলন্ত দুল জোড়া ঝিলমিল করে উঠল ৷ মাহতাব চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল ৷ নান্দিতা জিনিয়ার চেয়ে সুন্দরী নয়, আর মুনীরার চেয়ে তো নয়ই। কিন্তু তার ঐ হাসির মধ্যে এমন একটা আশ্চর্য্য স্বকীয়তা লুকিয়ে আছে, যা তাকে অন্য সবার থেকে অনন্যতা দান করেছে ৷ এই এক আশ্চর্য ভিন্নতর জিনিস, যার উপলদ্বিও মাহতাবের কাছে অনন্য ৷

মাহতাব বলল, মিস, আপনার মায়ের শরীর কেমন?

- খুবই খারাপ, স্যার ৷ মা এখন আর মোটেই নড়াচড়া করতে পারেন না ৷ অষ্টপ্রহর কষ্টের জন্যে কেবল পড়ে পড়ে কঁকান৷
মাহতাবের চেহারায় বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠল। বলল, সত্যি আপানার কষ্টের কথা মনে হলে মনটার ভিতর খচ করে ওঠে ৷

মাহতাবের কথা শুনে নন্দিতার মনটাও নরম হয়ে আসছে ৷ আর এই জিনিসটিকেই তার ভয় ৷ এই নরম হওয়াটা গজনফর আলীর কাছে মোটেই পছন্দনীয় নয় ৷ নন্দিতাকে বার বার সে সাবধান করে দিয়েছে, অভিনয়ের নায়িকা অনেক সময় বেঘোরে আসল নায়িকা হয়ে বসে ৷ গজনফরের অবশ্যি সতর্ক দৃষ্টিও আছে৷ নন্দিতাকে আরো মজবুত আর সুদৃঢ় মনের অধিরিণী করে তুলতে তার চেস্টার ত্রুটি নেই ৷

নন্দিতা সতর্ক হয়ে গেল ৷ বলল, আপনার শরীর কেমন স্যার?

মাতাবের চোখ দুটি ঝিলিক দিয়ে উঠল ৷ অদ্ভুত তীক্ষ্ন হাসি ঠোটের ওপর নেচে গেল ৷ বলল, কেন, চা খাওয়াবেন নাকি? তা যদি খাওয়ান তো মিথ্যে করে হলেও বলতে পারি, উফ, মাথাটা বড্ডো ধরেছে ৷ বলেই মাহতাব নাটুকে ভঙ্গীতে হাসতে লাগল ৷


নন্দিতাও খিল খিল করে হেসে উঠল ৷ হাসলে মেয়েটির গালে টোল পড়ে ৷ বলল, আপনি যদি মিথ্যে করে বলতেই পারেন, তো আমি কি আর সত্য করে একটু চা আপনাকে খাওয়াতে পারব না, স্যার? খুব পারব৷ করে আনি?


- আনতে চাইলে সেটা পরে হবে খন ৷ শেষে কী জানি কখন আবার রেগে মেগে বলবেন, সাবোডিনেট হয়েছি বলে ব্যাটা যা -তা হুকুম করছে ৷

নন্দিতা জিভ কেটে বলল, ছি ছি আমাকে এত নীচ ভাবছেন, স্যার? আমি চাকুরী করে খাই, কিন্তু অত নীচে নামি নি৷ আমি আপনাকে ঐ রকম অপমান করব, তা যে আমর ধারণারও বাইরে ৷ আপনি ভাবতে পারলেন, স্যার?

মাহতাব একটু অপ্রতিভ হয়ে পরেছিল৷ বলল, এই দেখ , আপনি আবার উল্টো বুঝে রেগে গেলেন দেখছি৷ আমি ঠাট্রা করে বলেছি আর আপনি....

নন্দিতা খুশী হয়ে বলে উঠল ৷ তাহলে আমার কথাটাও আপনি ঠাট্টাই মনে করুন৷ আপনার কথাটাও ঠাট্টা, আমারটাও ঠাট্টা ৷ মন্দ কি ? বলতে গিয়ে নন্দিতার মুক্তোর মতন পরিপাটি দাঁতগুলো ঝিকমিক করে উঠল৷

মাহতাব বলল, চায়ের আয়োজনটা রেখেছি, ক্লান্তি বোধ করলে মাঝে মধ্যে এককাপ খেয়ে নিই৷ কিন্তু বললেন আমি চাটুক্তি করছি; সত্যি বলছি, আপনার হাতের তৈরী চা, চা তো নয়, যেন অমৃত৷ কোন তুলনাই হয় না৷

এ রকম প্রশংসায় মেয়েদের মুখ চোখ খুশীতে সাধারণত ঝল মলিয়ে ওঠে ৷ নন্দিতার হয়েওছিল তাই৷ কষ্ট করে সে সামলে নিয়ে বিনয় ও লজ্জা মেশানো গলায় বলল, আপনার অনুগ্রহ স্যার ৷ নইলে চা আমি যে কেমন বানাই, সেটা অন্য না জানুক আমার তো অজানা নেই৷

মাহতাব বাধা দিয়ে বলে উঠল, না না, মিস নন্দিতা ৷ যা সত্যি তাই আমি বলছি ৷ এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না৷ আপনার সেদিনের সেই চা, সত্যি অপূর্ব হয়েছিল৷ ম্যাচলেস!

নন্দিতা লজ্জিত মুখে বলল, ইঁস সো কাইণ্ড অব ইউ, স্যার!

আজ সকালের ঘটনাটি মাহতাবের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে ৷ মুনীরার পরিত্যক্ত আসনটি জিনিয়ার জন্যে বরাদ্দ কররা পর মুনীরার প্রয়োজনটুকু মাহতাবের কাছে হঠাৎই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল৷ অথচ তারপর থেকেই মুক্ত বিহঙ্গী জিনিয়াকে নিয়ে মাহতাব অন্তহীন দুর্ভাবনায় অনুক্ষণ বিব্রত হয়ে থাকত ৷ একদিন এমন ছিল , যেদিন জিনিয়াকে পাওয়া তার জন্যে ছিল খুবই সহজ ৷ মাহতাব সেদিন ইচ্ছে করেই জিনিয়াকে প্রত্যাখান করেছে ৷ জিনিয়াকে সেদিন মাহতাবের সস্তা জিনিস বলে মনে হয়েছিল৷ মাতহাব এর সঙ্গে যখন বিয়ে দেবার জন্যে জিনিয়ার বাবা উঠে পড়ে লেগেছেন, জিনিয়া তখন ক্লাস টেন-এর ছাত্রী ৷ সাদা-মাটা মেয়ে ৷ খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষন করার মতন আহা-মরি কিছু নয় ৷ ষ্কুলে ফাংশান হলে, মাঝে মাঝে স্টেজে উঠে হাটু দুমরিয়ে, পা দুটে পাশ দিয়ে পেছনে রেখে, হারমোনিয়ামটায় আঙ্গুল লাগিয়ে সে গান ধরত, কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা ৷ সে-সময় গলায় তার আজকের মতন এমন সুক্ষ কারুকাজ ছিলনা ৷ এমন মাদকতাময় দরদও তখন সৃষ্টি হয়নি৷ কাঁচাঁ গলায় গানের সুরটা কেমন ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেত ৷ নিতান্তু বালিকা বলেই ৷ তবু আধা-শহর আধা-পল্লীর এই ষ্কুলে জিনিয়া যা কিছু বাহবা পেত, তার কোনকিছুই মাহতাবের মনকে স্পর্শ করে নি ৷ তখন জিনিয়া চোখে কাজল দিত, কিন্তু তাহলে কী হবে? এখনকার এই বিদ্যুৎ-প্রভ-দৃস্টি ওর চোখে তখন ছিলনা ৷ তারপর গায়ে পড়া একটি মেয়ে ৷ উচ্চকাঙ্খী মাহতাবের মনে সেদিন কোনই রেখাপাত করতে পারে নি ৷ কিন্তু এখন? এখন সেই জিনিয়াই এক আকর্ষনীয়া সুন্দরী নারী ৷ তনুময় দোদুল্যমান মাধবী লতার ছন্দ৷ আজানুলম্বিত এলোচুলে শ্রাবন মেঘের রঙ ৷ দুচোখে বৈশাখের বিদ্যেৎ প্রভা ৷ জিনিয়া এখন হাজার লুব্ধক চোখের লক্ষবস্তু ৷ সুতরাং তার প্রতি মাহতাবের আগ্রহ ও আকর্ষণ দিন দিন সুতীব্র হয়ে উঠবে বৈকি৷


ব্যাপারটা ঘটে গেল একেবারে সকালেই ৷ কী একটা কাজে খুব সকাল সকাল মাহতাবকে একটু বাইরে যেতে হয়েছিল ৷ বাসা থেকে বেরুনোর সময় জিনিয়া আর সে এক সঙ্গেই বেরিয়েছিল ৷ জিনিয়ার যাওয়ার কথা বকসী বাজারে এক বান্ধবীর কাছে নোট আনতে ৷ একলাই সে গিয়েছে সেখানে ৷ বাইরের দরকার সেরে মাহতাব যখন বাসার দিকে যাচ্ছে, হঠাৎ ওর চোখ পড়ল জিনিয়ার দিকে ৷ জিনিয়া আর এক ঝাঁকড়া-চুলো ছোকরা প্রায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বিপরীত দিক থেকে হেটে আসছে ৷ ওদের ৷ ঐ অবস্থায় দেখে হঠাৎ মাহতাবের চোখ দুটো ভায়ানক জ্বালা করে উঠল ৷ হৃত্পিণ্ডে অস্থির স্পন্দন শুরু হয়ে গেল৷ তারপর মাথার মধ্যে কী রকম একটা অদ্ভুত আচ্ছন্নতা অক্টোপাশের মতন ওর চেতনাকে ছেয়ে ফেলল৷ মাহতাব আর চলতে পারছে না ৷ পা যেন ওর শরীরের ভার রাখতে গিয়ে হিম সিম খাচ্ছে৷ মাহতাবের মাথার মধ্যে একটা ঘর্ণি দিল ৷ তারপর রাস্তার পুর্ব দিকের রোয়াকের ওপর হঠাৎ সে পড়ে গেল৷


এই অবাক কাণ্ডটি জিনিয়ার লক্ষ্য এড়ায় নি ৷ সে দ্রুত এসে ঝাকড়া চুলো ছোকরার সহযোগিতায় মাহতাবকে ধরাধরি করে পাশের ডাক্তার খানায় নিয়ে বেঞ্চির ওপর শুইয়ে দিল ৷ মাহতাবের হাতে এতক্ষণও চশমার একটি খাপ ধরা ছিল৷ ওকে শুইয়ে দিতেই হাত থেকে খাপটি ছুটে বেঞ্চির তলে গিয়ে পড়ল৷ ওর অস্থিরতা ও কাতরাত দেখে ডাক্তার সাহেব উত্কন্ঠিত মুখ ষ্টেথোস্কোপ হাতে আসন ছেড়ে উঠে এলেন এবং মাহতাবের বুকে যন্ত্র লাগিয়ে তন্ন তন্ন করে অসুখের হেতু ও পরিনতি তালাশ করতে লাগলেন৷


ডাক্তার সাহেব কানের যন্ত্র খুলে চশমার ফাঁক দিয়ে দিয়ে জিনিয়ার মুখর দিকে তাকলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী বলুন তো ? ভদ্রলোকের হয়েছে কী?


ওরা দুজনই তখন কথা হারিয়ে ফেলেছে এবং বোকার মতন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে ৷ ডাক্তার সাহেবের কাছে ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যজনক ঠেকছে ৷ তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ভদ্রলোকের সাথে আপনার সম্পর্কটা কী?


জিনিয়া থতমত করে জবাব দিল, উনি আমার বস্ ৷

- আপনার সাথে কি বচসা হয়েছে? ডাক্তার সাহেব আবার প্রশ্ন করলেন ৷

এবার ঝাঁকরা-চুলো যুবকটি কেমন আমতা আমতা করে জবাব দিল, আমি কিছুই বলতে পারব না৷ আমরা রাস্তা দিয়ে আসছিলাম ৷ হঠাৎ দেখলাম উনি পড়ে গেলেন....

কথাটি বোধহয় মাহতাবের কানে গিয়েছিল৷ ওর ঠোঁট দু'টি সাহসা নড়ে উঠল ৷ দুচোখের পাতা ও ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেল ৷ নীচের ঠোঁট ওপরের দাঁতির তলে চেপে একবার ওহ বলে সে কাৎতে উঠল৷

মাহতাবের আর্তস্বর শুনে জিনিয়া সামনে এসে দাড়াল ৷ ওর চোখ কেমন ভীতি আর লজ্জা জড়ানো৷ ওর দিকে চোখ পড়তেই মাহতাব চিত্কার করে, যা যা আমার সামনে থেকে তুই সরে যা ৷

ধমক শুনে লজ্জায় জিনিয়ার মুখ কালো হয়ে উঠেছে ৷ লজ্জা ঢাকবার জন্যে সে ডাক্তার খানায় বড় থামটার আড়ালে গিয়ে দাড়াল।

ঝাঁকরা-চুলো ছোকরা এবার মাহতাবের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল, চলুন, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি ৷
মাহতাব খেঁকিয়ে উঠল, ও, নো নো, বী অফ, আমি একলাই যেতে পারব৷ বলেই সে কাতরানির সাথে এপাশ ওপাশ মাথা চালাচালি করতে লাগল ৷

ওদের এই অদ্ভুত আচরণ দেখে ডাক্তার সাহেব এবং রোগীরাও কৌতুক বোধ করতে লাগল ৷ যুবকটি বিনয় প্রকাশ করে বলল, আপনি অসুস্থ...

মাহতাব ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল, না না, আমি অসুস্থ নই, আপনি আপানার নিজের কাজে যান ৷ অয়েল ইওর ওন মেশেন ৷

অবস্থা ক্রমেই জটিল হতে দেখে ডাক্তার সাহেব জিনিয়াকে ডেকে ওপর তলায় নিয়ে গেলেন৷ গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওর সাথে আপনাদের কী হয়েছে, সত্যি করে বলুন তো ৷

জিনিয়া পাংশু মুখে এক মুহুর্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইল, তারপর বার দুই ঢোক গিলে ফেকাসে মুখে বলল, কিছুই হয়নি তো৷

ডাক্তার সাহেব দেখলেন, জিনিয়ার ভীতি বিহবল চোখের পাতা কাপছে ৷ তিনি বিশেষ আর ঘাটালেন না৷ কী একটা আন্দাজ করে নীচে এলেন। এসে দেখলেন, মাহাতাব বেঞ্চির ওপর উঠে বসেছে। মুখ চোখে তার উদ্ভ্রান্তির ছাপ ৷ দুমুহুর্ত পর সে বেঞ্চির ওপর উঠে সোজা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রোয়াকের ওপর দাড়াল ৷ তারপর ক্লান্ত কন্ঠে একটা রিকসা ডেকে তার ওপর উঠে বসল ৷


এই দৃশ্য দেখে জিনিয়াও মুহুর্ত খানিক দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল ৷ সে ও ম্লান মুখে রোয়াকে এসে দাড়াল ৷ মাহতাবের রিক্সাঅলা ছুটতে ছুটতে তার দিকেই আসছে ৷ কাছে পৌছে সে বলল, সাহেব আপনকে ডাকছে ৷ জিনিয়া আর অপেক্ষা না করে রিক্সাঅলার পিছু পিছু গিয়ে মাহতাবের পাশে বসে পড়ল ৷ ঝাকড়া চুলো যবকটি ওদের যাত্রাপথের দিকে বেশ কয়েক মুহুর্ত এক দৃষ্টে চেয়ে থেকে এক সময় উল্টো পথ ধরে হাটতে শুরু করল ৷


বাসায় ফিরে মাহতাব ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেল ৷ তারপর প্রবল অস্থিরতায় সে ছটফট করতে লাগল৷

রাগে দুঃখে ক্ষোভে জিনিয়াও সারাটা পথ মাহতাবের সাথে একটা কথাও বলে নি ৷ কাধের ভ্যানিটি ব্যাগটি টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে জিনিয়াও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল৷ দুজনেই কিছুক্ষণ বোবায় ধরা রোগীর মতন ভেতরে ভেতরে গোঙাতে লাগল ৷ কয়েক মিনিট এইভাবে কেটে যাওয়ার পর জিনিয়াই প্রথম মুখ খুলল ৷ বলল, তুমি ঐ রকম সিনক্রিয়েট কেন করলে, বলত? রাগে জিনিয়ার ঠোঁট দুটি ঠিরঠির করে কাঁপছে৷


মাহতাব রেগে উঠে বলল, ঐ বদমাশ কবি ছোখরাকে আমি দুচোখে দেখতি পারিনা ৷ তোকে সে কথা আমি বারবার করে জানিয়ে দিয়েছি৷ তবুও তুই তার সাথেই মিশিস কেন?

জিনিয়া ঝাঁ করে মাহতাবরে দিকে ফিরে তাকাল ৷ চোখ থেকে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে বলল, একজন চরিত্রবান লোকের হুকুম শুনে একটা বদমাশকে আমি কেন যে ত্যাগ করি নি , সে কথা পরে আমাকে জিজ্ঞেস করলে কি তোমার মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যেত? আমার সেই দুঃসহ অপরাধের জন্যে তুমি অন্য যে কোন সময় আমাকে জবাবদিহি করতে পারতে ৷ লোহা পুড়িয়ে আমার গায়ে ছ্যাকা দিতেও পারতে ৷ কিন্তু তা না করে, সেই একদঙ্গল লোকের মধ্যে তুমি অমন কেলেঙ্কারী করলে কেন শুনি? বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত কান্নায় জিনিয়ার কন্ঠরোধ হয়ে গেল৷


জিনিয়ার তীব্র অভিযোগের মুখে হতবুদ্ধি মাহতাব নির্বাক হয়ে বসে রইল। শক্ত জবাবের কথা দূরে থাক, কোন ভাষাই যেন এখন তার মুখে আসাছ না।

জিনিয়া কাঁদো কাঁদো মুখে বলতে লাগল, রেডিওতে অডিশান দিতে যাওয়ার দিন ঐ ছেলেটির সাথে আমার দেখা ৷ সে নাকি রেডিওর রেজিষ্টার্ড গীতিকার ৷ সেই সুবাদে আমার সাথে নিজেই সে পরিচয় করল৷ রেডিওতে দেখা হলে তার লেখা গান গাইবার জন্যে সে আমাকে পীড়াপীড়ি করে ৷ আমি নজরুল গীতি গাই৷ আধুনিক তো গাই না ৷ বেচারী চায় যে, তার গান শিল্পীরা বেশী বেশী গাক ৷ একজন গীতিকার তো তা চাইবেই৷ পথে আসার সময় হঠাৎ দেখা ৷ বলল, একটু দাঁড়ান, আপনার সাথে একটা কথা আছে ৷ আমি আর কী করি? বলতে তো পারি না যে, দাড়াব না ৷ দাড়ালাম ৷ বলল, চলুন হাটতে হাটতে কথা বলি ৷ শেষে বারবার আমাকে অনুরোধ করতে লাগল, আমার দুটো গান আপনি রেকর্ড করুন ৷ আমি তো আর বলতে পারি না যান, গান টান রেকর্ড করতে পারব না ৷ চক্ষু লজ্জা বলতেও একটা কথা আছে ? এটা আমার মস্ত-জবর অপরাধ ছিল, সে কথা আমি একশোবার স্বীকার করছি। কিন্তু তার জন্যে এক দঙ্গল লোকের মধ্যে তোমাকে অজ্ঞান হয়ে পড়তে হবে কেন? ক্রুদ্ধ জিনিয়া তীব্র দৃষ্টি মেলে মাহতাবের দিকে তাকাল৷


- আমার যাতে সন্দেহ হয় তুই সেই কাজ কেন করতে গেলি? মাহতাব তিক্ত কন্ঠে প্রশ্ন করল ৷

জিনিয়াও ঝাঁঝিয়ে উঠে পাল্টা প্রশ্ন করল, তোমার সাথে আমি কবে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, তুমি যাতে রাগ করবে, আমি কখনো সেটা করব না? কবে আমি বলেছি? যে, তোমার যাতে সন্দেহ হয় হবে, তা থেকে অবশ্যই আমি দুরে থাকব? কবে বলেছি?

জিনিয়ার এই ঔদ্ধত্যপুর্ন আচরন দেখে মাহতাব অবাক হয়ে গেল ৷ জিনিয়ার দিকে দৃস্টি পরতেই সে নতুন করে বুঝতে পারল, এ-এক বিষ্ময়কর মেয়ে৷ এ সেই মুনীরা নয় ৷ এর চাইতে ছোট অপরাধেও মাহতাব মুনীরার গালে চড় কষে দিয়েছে৷ অথচ এই মেয়েটির গালে হাত তোলা তো দুরেরর কথা ওর চোখের দিকে সরাসরি চোখ রাখতেও মাহতাবের এখন সাহস হচ্ছে না ৷ সব কিছু ভেবে-চিন্তে সংযত গলায় সে প্রশ্ন করল, তাই বলে তুই যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবি? স্যার কি এই জন্যেই তোকে এখানে রেখে গেছেন?


- কী জন্যে রেখে গেছেন, সেটা বুঝি শুধু তুমিই জানো? আমি তার কিছুই জানিনা ? এই জন্যে কি রেখে গেছেন, যে আমাকে নিয়ে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে, আর আমি কিছু করতে গেলে অমনি তোমার মনে নানা রকম সন্দেহ জাগবে? তাই যদি হয়, বাবা বলুক আর যেই বলুক , তার সাথে আমি একমত নই ৷ আর এটাও তোমার স্পষ্ট জেনে রাখা উচিত, তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্কও নয়, সুতারাং তা নিয়ে তোমার জোর ও সাজে না ৷

- তাই বলে তুই যার তার সাথে প্রেম করে বেড়াবি? মাহতাব আক্ষেপের ভঙ্গীতে বলল৷

জিনিয়া তিক্ত কন্ঠে বলে উঠল, আমাকে এমন বেহায়া ভাবতে একটুও লজ্জা হলোনা তোমার? আমি মেয়ে-মানুষ হয়েছি বলে কি আমার ঘাটে এতটুকু বুদ্ধি নেই যে, ঐ রকম পাগলাটে একটা ছোকরার সাথে আমি প্রেম করে ঢলে পড়ব?

তোমার কান্ডজ্ঞান অতি জঘন্য ৷ আমি ভাবতেও লজ্জা বোধ করি ৷

জিনিয়ার এই তীব্র কষাঘাতে মাহতাব হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেল! এমন তীব্র ঝাঁঝাঁল গাল-মন্দ মেশানা কথাটিও তার কাছে ফালির মত আঘাতের মতই মনে হল ৷ জিনিয়ার কথা শেষ হতেই মাহতাব বোবার মতন দৃস্টি মেলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷

জিনিয়া বলে যেতে লাগল, আমি তোমার সতী-সাধ্বী বৌ এর মতন কখনো সতী-সাধবী হবার দাবি করি নি, সেটা অন্তত তুমি ভাল করে জানো৷ কিন্তু তাই বলে তোমার মত আমি কান্ডজ্ঞানও হারাই নি সেটাও আজকে তুমি জেনে নাও৷ জিনিয়ার রুক্ষ কন্ঠস্বরের তীব্র অসহিষ্ণুতা ঝরে পড়ল৷


মাহতাব দুহাতের তালুর ওপর মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল ৷ শুয়ে শুয়েই ঠান্ডা গলায় বলল, কিন্তু ঐ রকম অবস্থায় মানুষের মনে একটা ধারনা তো জন্মাতে পারে? পারে কিনা তুই বল৷


- ধারনা হলেই ঐ রকম সিনক্রিয়েট করতে হবে? একজন মেয়ে মানুষকে এক দঙ্গল মানুষের মধ্যে ঐ ভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াতে হবে? সে অধিকার তুমি কেন, কোন মানুষের নেই৷ থাকা উচিতও নয়৷

মাহতাব মিনমিনে গলায় বলে উঠল রাইট ৷ ঐ সময় আমার সত্যি সত্যি কান্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল রে৷ তুই ঠিকই বলেছিস৷

জিনিয়া এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ৷ কান্না জড়িত গলায় বলল, আগামী কাল থেকে আমি আর এখানে থাকব না, মাতু ভাই ৷ তোমার করুনার জন্যে আমি জীবন ভর কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম ৷ কিন্তু সত্যি বলছি, ঐ করুনা দিন দিন মজবুত বড়শি হয়ে আমার গলায় আটকে যাচ্ছে ৷ তুমি বড় লোক, তোমার শিক্ষা ও সম্পদ দুটোই আছে আর তা নিয়ে তোমার গৌরব ও সাঝে ৷ আমার ঐ রকম কিছুই নেই ৷ একদিন হয়ত ঐ শিক্ষা ও সম্পদের পাশে আমার মতন একটি মেয়েকে তোমার করুনার পাত্রী বলেই মনে হবে ৷ সেদিনের ঐ দয়ার খোটাটি আমি সইতে পারব বলে আমার সহস হচ্ছে না ৷ তার চেয়ে আগে ভাগেই সব চুকে বুকে যাওয়া অনেক ভাল৷


জিনিয়ার ক্লান্তি মেশানো কথাগুলি শুনে মাহতাব দারুন ভাবে অভিভুত হয়ে পড়ল৷ তারও চোখে মুখে বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠল৷ মাহতাব কাতর কন্ঠে বলল, তোকে ভুল বুঝেছিলাম রে ৷ আমাকে তুই ক্ষমা কর, জিনি৷


জিনিয়ার চোখ থেকে দরদর করে অশ্রু ঝরতে লাগল৷


উত্তেজনার শুরু থেকে জিনিয়ার চোখে পানি দেখা পর্যন্ত গোটা সময়টুকু মাহতাবের চোখের ওপর এখন ছবির মতন ভাসছে ৷ জিনিয়াকে রহস্য-লোকের দুর্লভ নক্ষত্রের মতন তার মনে হচ্ছে ৷ যার মধ্যে জটিল রহস্যসময়তা লুকিয়ে থাকে, তার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ভাবেই আকর্ষন থাকে বেশী ৷ জিনিয়ার প্রতিও মাহতাবের তেমনি এক আকর্ষন নিত্য দিন যে দুর্বার হয়ে উঠছে ৷ তা মাহতাব সবর্দা আপন অন্তরে অনুভাব করে ৷


বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোদুল-দোলায় বেশ কিছুক্ষণ দুলছিল মাহতাব ৷ নন্দিতা ধুমায়িত চায়ের কাপটি সামনে রেখে বলল, নিন স্যার চা খান৷

- আপনি ? আপনার কাপ কই?

- বস্ এর সামনে বসে-বসে চা খাওয়া শোভন নয়, স্যার আমি অন্য সময় খেয়ে নেব৷

মাহতাব কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল, ওসব বাজে কাথা ছাড়ুন তো আপনি একটা কাপ আনুন.... যান৷

চাপে পড়ে নন্দিতা এক কাপ চা নিয়ে মাহতাবের মুখামুখি বসল৷ তারপর কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, যদি কিছু মনে না করেন স্যার তাহলে আমার একটা নিবেদন পেশ করতে পারি৷ বলব বলব করে বেশ কিছু দিন ধরে চিন্তা করছি, কিন্তু বলতে গিয়েও লজ্জা-শরমে আর বলা হচ্ছে না৷


- নিবেদন ? সেটা আবার কী?

- একটা পার্সোনাল ব্যাপার স্যার৷

- পার্সোনাল ব্যাপার? তার জন্যে আপনাকে এতদিন ধরে লজ্জা-শরমে কাটাতে হচ্ছে ? মাই গড ৷ আমাকে অবাক করলেন মিস্ নন্দিতা আপনি আমাকে নিশ্চয়ই ফ্রেণ্ডলি ভাবতে পারছেন না, তাই না?

- ওরে সব্বোনাশ! আপনি কী যে বলেন স্যার ৷ ভাবতে তো অনেক কিছুই মন চায়, কিন্তু আপনি আমার বস্ । বন্ধু ভাবাটা কি সহজ ব্যাপার? সিরাজ সাহেব গনি সাহেবের এসিস্টেন্ট ছিলেন ৷ গনি সাহেবকে বন্ধু ভেবে কী যেন বলতে গিয়েছিলেন ৷ আর গনি সাহেব চটে উঠে বলেছিলেন, সিরাজ মিয়া! আপনি আমাকে কি দোস্ত পেয়েছেন নাকি? সিরাজ সাহেবের তারপরে কত যে হেনস্তা। আমার ভয় হয় স্যার,বন্ধু ভাবতে গিয়ে আমার আবার ঐ সিরাজ সাহেবের দশা না হয়৷

মাহতাব হো হো করে হেসে উঠল বলল, আপনার সেই সিরাজ সাহেব তো পুরুষ মানুষ৷ পুরুষ বস্ আর পুরুষ সাবর্ডিনেটে বন্ধুত্ব হয় কখনো ? আপনি একটা পাগল দেখছি, যাকগে এখন আপনার নিবেদনটা শোনার জন্যে আমিও নিবেদন জানাচ্ছি ৷


নন্দিতা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গীতে পাংশু মুখে বলল, আমার কথায় ব্যাথা পেয়েছেন, স্যার আমি ক্ষমা চাইছি৷

মাহতাব আতঙ্কিত হয়ে বলল, আরে, আপনি কী বলছেন এসব ? আপনার সেই কথাটি বলে ফেলুন তো শীগগীর ৷ আই এম রেডি টু হেল্প য়ু ইন্ অল সারকামস্ট্যাস্নেস্ ৷ নন্দিতা রুমালে মুখটা মুছে নিল ৷ বলল, আমার একজন রিলেটিভ। একটা বিল নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন....

- কী রকম জটিলতা?

- লাখ দুয়েক টাকার একটা ডিসক্রিপেন্সি ধরা পড়েছে ৷ অফিসিয়ালি এখনও অবশ্যি কিছু হয় নি৷ কিন্তু হওয়ার ভয় আছে ৷ ভদ্রলোক কিছু টাকা নষ্টই করে ফেলেছে ৷ বলেই নন্দিতা চুপ করে গেল৷

মাহতাব জিজ্ঞেস করল তারপর?

নন্দিতা বলল, ভদ্রলোক এর টাকাটা তছরুপ করার অবশ্যি ইচ্ছে ছিল না ৷ কিন্তু একটা লোভে পড়ে তার মুসিবত হয়ে গেল ৷ আর জানেন তো, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ৷

মাহতাব ঐসব দার্শনিক কথাবার্তায় কান না দিয়ে প্রশ্ন করল, তারপর কী হল?

-ভদ্রলোক এক ফার্মের এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার ৷ ফান্ডের টাকা থেকে লাখ দুয়েক তিনি সরিয়েছিলেন ৷ উদ্দেশ্য কিছুদিনের জন্যে সেই টাকা দিয়ে একজন ভাইপোকে আর একজন শ্যালককে মিড্ল ইস্টে পাঠাবেন ৷ তারা চাকরী করে টাকা পাঠালেই ভদ্রলোক ফান্ডের টাকাটা আবার রিটার্ন করে দেবেন। তার ধারনা, টাকা তো আর একবারে সবটা লাগছে না৷ ধীরে ধীরে লাগছে৷ কিন্তু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত অন্যদিকে মোড় নিল ৷ বলে নন্দিতা আবার একটু থামল৷

মাহতাব ওকে থামতে দেখে বলল, তার পর কী হল?

নন্দিতা বলতে শুরু করল, ভদ্রলোকের অদৃষ্ট মন্দ, ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্যে যে এজেন্ট কে তিনি টাকা দিয়েছিলেন ৷ সেই এজেন্টটাই ছিল ভুয়া৷ পঞ্চশ হাজার টাকা তার সেখানেই গচ্চা গেল ৷

- আর শ্যালক? তার কী হল? মাহতাব প্রশ্ন করল৷

- শ্যালকের অবশ্যি চাকরি হয়েছে ৷ এখন সে আছে কুয়েতে ৷ সেইতো কিছু কিছু পাঠাচ্ছে এখন ৷ কিন্তু তা দিয়ে ঐ মোটা অঙ্কের ঘাটতি তো আর পুরন করা যাচ্ছে না ৷ এখন ভদ্রলোক এর ঠ্যাঙের দড়ি উঠেছে গলায় ৷ বাল-বাচ্চা নিয়ে তার পথে বসা ছাড়া আর কোন পথ নেই ৷ ঐ নন্দিতা বিনয়ের সাথে বলল ৷

মাহতাব এক মুহুর্ত কী যেন ভাবল ৷ তারপর নন্দিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রসাধন চর্চিত মুখখানি তার থম থম করছে ৷ তা দেখে মাতহতাব বলে উঠল, লেট মি সি টু ইট ৷ ইউ নিড নট বি ওরিড ৷



নন্দিতা সেদিনই বিকেল বেলা আনন্দিত মনে গজনফর আলীকে সংবাদটা পৌঁছে দিয়ে বলল, রাঘব বোয়াল এবার চারে মুখ দিয়েছে এবং বেশ ঠিক মতই বড়শির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ৷

গজনফর নন্দিতার সুখবরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলল, দে দে বড়শিতে একবার মুখটা ওকে লাগাতে দে, তারপরই উরিব্বাস, কষে একটা হ্যাচকা টান ৷ তখন আর খলবলিয়ে পার পাবে না বাছাধন ৷ হেঁ হেঁ হেঁ....

নন্দিতা বলল, ঐ দশ হাজারের মধ্যে আমিও হাজার পাঁচেক বাগাতে পারি, কিন্তু তা আমি নিচ্ছি না ৷ তুমি আমার দুর্দিনের বন্ধু সে-কথা আমি কোন দিন ভুলতে পারব?

বলতে গিয়ে নন্দিতার নিজের বুকটার মধ্যেই ধ্বক করে উঠল ৷ তার চোখের সামনেই তার নিজের দেওয়া দৃষ্টান্ত টি যেন মুর্তিমান হয়ে উঠেছে ৷ একটি রাক্ষুসে বোয়াল মাছ, খুব বড় মুখের হাঁ মেলে ধীরে ধীরে গজনফরের দেওয়া টোপের দিকে এগিয়ে আসছে সুমিষ্ট খাদ্যের লোভে ৷ কিন্তু সে জানে না ঐ খাদ্যের সুদৃশ্য আড়ালে একটি ধারাল বড়শি লুকিয়ে আছে। ভাবতে ভাবতে নন্দিতার মুখখানি মলিন হয়ে উঠল ৷



নন্দিতার কাছে সুখবর পেয়ে গজনফরের মনের কালো মেঘটা সরে গেল ৷ প্রথম দিকে এই সাংঘাতিক খেলা খেলতে গিয়ে তার মনে যে আশঙ্কা ছিল না, তা নয় ৷ একটা বকরিকে হিংস্র ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচার ভেতর ঠেলে দেওয়া এবং আস্তই সেটা ফিরিয়ে পাওয়া চাট্টিখানি কাথা নয় ৷ তার নিজের মন্ত্রের যে জোর আছে তারই প্রমান পেয়ে গজনফর মনে মনে পরিতৃপ্তির হাসি হাসল ৷ আর সেই হাসির আবেগেই গজনফর আলির ঘন ঘন পান-খাওয়া তেঁতুল বীচির মতন দাঁতগুলো পরিপূর্ণ বিকশিত হয়ে উঠল ৷ হাসি মুখেই সে বলল, জেন্দা বাবার নেক দোয়ার বরকতে তুই যে সাক্সেসফুল হবি, সে বিষয়ে হান্ড্রড পারসেন্ট ভরসা ছিল৷


নন্দিতা অদেখা বাবার উদ্দেশ্যে দুটি চোখ বন্ধ করে, ষুক্ত কর কপালে ঠেকাল৷

নন্দিতার এই অভাবনীয় ভক্তিভাবটি লক্ষ্য করে গজনফরের বুকের মধ্যেও একটি ভক্তিভাব সহসাই সংক্রমিত হল ৷

জিজ্ঞেস করল, নন্দিতা, তুই বাবার আস্তানায়?

নন্দিতা অবাক মুখে প্রশ্ন করল, আমি ? আমাকে বলছ, দাদা?

- তোকে না তো কাকে? তুই ছাড়া এখানে আর কে আছে শুনি?

- কিন্তু আমি যে বিজাত, নফর দাদা!

গজনফার আবার মুখের তেঁতুল বীচগলো বের করে বলল, এইটেই তোর ভয়, তাই না? কিন্তু তুই জানিস নি কিনা, তাই তোর সন্দেহ জাগছে ৷ বাবার কাছে জাত-বিজাত নেই , বাবার কত হিন্দু মুরীদ আছে, জানিস?

- তাই নাকি?

No comments: